মঙ্গলে জীবনের সম্ভাবনা আজকে মানবজাতির জন্য এক অভাবনীয় আলোচনার বিষয়। হাজার বছরের কল্পনা, দর্শন আর সাহিত্য এখন যেন বৈজ্ঞানিক বাস্তবতার মুখোমুখি দাঁড়িয়েছে। মানুষ বহু যুগ ধরে আকাশের দিকে তাকিয়ে ভেবেছে—আমরা কি মহাবিশ্বে একা? নাকি আরও কোথাও প্রাণের অস্তিত্ব আছে? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতেই বিজ্ঞানীরা মঙ্গলের দিকে তাকিয়েছে, আর প্রতিটি নতুন আবিষ্কার আমাদের কৌতূহলকে আরও উসকে দিচ্ছে।
নাসার পারসিভারেন্স রোভার ইতিমধ্যেই শিলা, মাটি এবং গ্যাসের নমুনা সংগ্রহ করছে। এসব বিশ্লেষণে দেখা গেছে, মঙ্গলে একসময় তরল পানির প্রবাহ ছিল। পানি ছাড়া প্রাণ সম্ভব নয়, অন্তত পৃথিবীর জীবনের সংজ্ঞা অনুযায়ী। পানির উপস্থিতি প্রমাণ করে যে মঙ্গল একসময় প্রাণধারণের উপযোগী পরিবেশ বহন করত। পাশাপাশি কিছু শিলার ভেতরে জৈব যৌগের চিহ্ন পাওয়া গেছে, যা সরাসরি জীবনের প্রমাণ নয়, কিন্তু এটি স্পষ্ট করে যে জীবনের মতো জটিল রাসায়নিক প্রক্রিয়া সেখানে ঘটেছিল।
পৃথিবীর প্রাথমিক ইতিহাস মনে করলে মঙ্গলের এই প্রমাণ আরও তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে ওঠে। পৃথিবী যখন লাভা, আগ্নেয়গিরি আর ঘন গ্যাসে ভরা ছিল, তখনও জীবন জন্ম নিয়েছিল ক্ষুদ্র অণুজীবের আকারে। যদি পৃথিবীর মতো প্রতিকূল পরিবেশেও জীবন গড়ে উঠতে পারে, তবে মঙ্গল কেন ব্যতিক্রম হবে? জীবনের জন্য যে মৌলিক শর্তগুলো লাগে—কার্বন, পানি, স্থিতিশীল তাপমাত্রা, খনিজ পদার্থ—সেগুলোর চিহ্ন মঙ্গলেও পাওয়া যাচ্ছে।
এই আবিষ্কার আমাদের একটা মৌলিক ধারণাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। আমরা মানুষ প্রাচীনকাল থেকেই নিজেদের মহাবিশ্বের কেন্দ্র ভেবে এসেছি। প্রথমে ভেবেছিলাম সূর্য পৃথিবীর চারপাশে ঘোরে, পরে শিখেছি আমরা কেবল সৌরজগতের এক ক্ষুদ্র গ্রহে বাস করি। এরপর ডারউইনের বিবর্তন তত্ত্ব আমাদের দেখিয়েছে আমরা আলাদা করে সৃষ্টি নই, বরং কোটি বছরের প্রাকৃতিক প্রক্রিয়ার ফল। আর এখন মঙ্গলে প্রাণের প্রমাণ আমাদের আরেক ধাপ নিচে নামাতে পারে—আমরা বিশেষ নই, মহাবিশ্বে হয়তো অনেক জীবন রয়েছে।
এটি কেবল বৈজ্ঞানিক প্রমাণ নয়, দার্শনিক ভাবনারও বিপ্লব। যদি মঙ্গলে জীবন থাকে, তবে তা মানব সভ্যতার আত্মকেন্দ্রিকতাকে ভেঙে দেবে। আমরা বুঝব যে মহাবিশ্বে জীবন এক বিরল ঘটনা নয়, বরং হয়তো একটি সাধারণ প্রক্রিয়া। এর মানে এই দাঁড়ায়, আমাদের গ্যালাক্সিতে বা অন্য গ্যালাক্সিতেও অসংখ্য প্রাণ থাকতে পারে, বিভিন্ন রূপে, বিভিন্ন পরিবেশে। আমরা হয়তো কেবল সেই সিম্ফনির একটি ক্ষুদ্র সুর।
প্রযুক্তিগত দিক থেকেও এই অনুসন্ধান বিশাল চ্যালেঞ্জ। মঙ্গলে জীবনের চূড়ান্ত প্রমাণ পেতে হলে সেখান থেকে নমুনা পৃথিবীতে ফিরিয়ে আনতে হবে। নাসা ও ইউরোপীয় মহাকাশ সংস্থা মঙ্গল স্যাম্পল রিটার্ন মিশনের পরিকল্পনা করছে। যদি সত্যিই সেখানে জীবনের ফসিল পাওয়া যায়, তবে এটি মানব ইতিহাসের সবচেয়ে বড় বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার হবে। এর প্রভাব পড়বে চিকিৎসাশাস্ত্রে, জীববিজ্ঞানে, এমনকি আমাদের দার্শনিক চিন্তায়।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, জীবনের সংজ্ঞা আমাদের নতুন করে ভাবতে হবে। আমরা এখনো জীবনকে কেবল পৃথিবীর দৃষ্টিকোণ থেকে দেখি—কার্বন-ভিত্তিক, পানিনির্ভর, অক্সিজেন-শ্বাসকারী। কিন্তু মঙ্গলে যদি অন্যরকম জীবন থাকে, তবে আমাদের বোঝাপড়া ভেঙে যাবে। আমরা শিখব জীবন একরূপ নয়, বরং বহুমাত্রিক।
অবশেষে, মঙ্গলে জীবনের সম্ভাবনা আমাদের মনে করিয়ে দেয় আমরা মহাবিশ্বে একা নই। জীবন হয়তো মহাবিশ্বের নিয়মিত বৈশিষ্ট্য, কোনো অলৌকিক ব্যতিক্রম নয়। এর মানে আমরা ক্ষুদ্র, আমাদের অহংকার ভেঙে যায়, আবার একইসাথে আমাদের জ্ঞানের তৃষ্ণা বেড়ে যায়। আমরা নতুন করে প্রশ্ন করি—যদি ওখানে জীবন থাকে, তবে তারা কেমন? তারা কি কখনো আমাদের মতো উন্নত হবে? আর আমরাই বা কেমন জায়গায় দাঁড়িয়ে আছি মহাবিশ্বের অসংখ্য জীবনের ভিড়ে?
এইসব প্রশ্নের উত্তর হয়তো আগামী কয়েক দশকের মধ্যে আমরা পেয়ে যাব। তবে নিশ্চিত হওয়া যায়, মঙ্গলে জীবনের প্রমাণ মানুষকে বদলে দেবে। আমাদের পৃথিবী-নির্ভর চিন্তা ভেঙে দেবে, আর মহাবিশ্বকে দেখার দৃষ্টিকে আরও ব্যাপক করে তুলবে।
আপনার মতামত জানানঃ