বেশ কয়েক বছর ধরে গ্রামে ও শহরে বাড়ছে পরিবেশবান্ধব এলপি (তরলীকৃত পেট্রোলিয়াম) গ্যাসের চাহিদা। রাজধানীতে গ্যাস সংকট নিত্য সমস্যা হওয়ায় রান্নার ক্ষেত্রে বিকল্প জ্বালানি হিসেবে বাড়ছে এলপিজির ব্যবহার। আর জীবনযাত্রার মানের উন্নয়ন ও লাকড়ির চুলার ঝামেলা এড়াতে গ্রামাঞ্চলে ও জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে এলপিজি গ্যাস।
গবেষকরা বলছেন, একেকটি এলপিজি সিলিন্ডার হতে পারে একেকটি সিলিন্ডার বোম। সিলিন্ডারের মানহীনতার কারণে ঘন ঘন ঘটছে সিলিন্ডার বিস্ফোরণের ঘটনা, যাতে ঘটছে প্রাণহানি। মানহীন সিলিন্ডারে গ্যাস সরবরাহের কারণে গত দুই বছরে প্রায় ১৮০০ দুর্ঘটনা ঘটেছে। এসব দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন অন্তত ৪০ জন।
আবাসিক ভবনে নতুন গ্যাস সংযোগ বন্ধ রয়েছে কয়েক বছর ধরে। গত পাঁচ বছরে দেশে এলপিজি সিলিন্ডারের ব্যবহার বেড়েছে পাঁচগুণ। চাহিদা বাড়ায় বাজারজাতকারী কোম্পানিগুলোর মধ্যে প্রতিযোগিতাও বেড়েছে। ফলে যেখানে সেখানে অবৈধভাবে মজুত করে এই ঝুঁকিপূর্ণ সিলিন্ডার বেচাকেনা বেড়েছে। সরকারও গ্যাসের চাহিদা মোতাবেক জোগান দিতে না পেরে এলপিজিতে যেতে গ্রাহকদের উৎসাহিত করে আসছে। বিদ্যুৎ ও জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী একাধিকবার বিভিন্ন অনুষ্ঠানে বলেছেন, মূল্যবান গ্যাস ও তার সংযোগ এখন যেনতেনভাবে আর আবাসিকে দেওয়া হবে না। আমাদের আস্তে আস্তে এলপিজিতে যেতে হবে।
বিস্ফোরক দফতরের সূত্র বলছে, বেশির ভাগ দোকানি বিস্ফোরক পরিদফতরের লাইসেন্স ছাড়াই এ ব্যবসা করছে। এলপিজি সিলিন্ডার এখন পাড়া-মহল্লার মুদি দোকানেও পাওয়া যাচ্ছে। এসব দোকানির অনেকেরই ট্রেড লাইসেন্স নেই। গ্যাস সিলিন্ডার বেচাকেনারও অনুমোদন নেই। এসব দোকানে নেই আগুন নির্বাপক যন্ত্র। বড় কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে প্রতিকারেরও কোনো ব্যবস্থা নেই। ঘনবসতিপূর্ণ বাণিজ্যিক ও আবাসিক এলাকায় গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণের কারণে ঘটছে দুর্ঘটনা। ফলে প্রাণহানির ঘটনাও ঘটছে। আর জনবল সঙ্কটের কারণে বিশেষ কোনো পদক্ষেপ নিতে পারছে না বিস্ফোরক পরিদফতর।
ফায়ার সার্ভিসের হিসাব মতে, ২০১৯ সালে এলপি গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে ৮১৮টি। এসব দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন ২৫ জন। আহত হয়েছেন ৬৯ জন। আর্থিক ক্ষতি হয়েছে ১২ কোটি টাকার ওপরে। পরের বছর অর্থাৎ ২০২০ সালে এ দুর্ঘটনার সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৯৫৭টিতে। এসব দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন অন্তত ১০ জন। আহত হয়েছেন ১০৭ জন। আর্থিক ক্ষতি হয়েছে প্রায় ৪ কোটি টাকা। গত বছরে সারা দেশের মোট অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে ২১ হাজার ৭৩টি। এর মধ্যে ইলেকট্রিক, গ্যাস ও মাটির চুলার আগুন ছিল ৩ হাজার ৫৬৪টি। এটি মোট আগুনের ১৬ দশমিক ৯১ শতাংশ। এ আগুনের অধিকাংশই ছিল গ্যাস চুলা ব্যবহারের ক্ষেত্রে সৃষ্ট।
চলতি বছরের ২৯ জানুয়ারি, ২০২১ পর্যন্ত অন্তত দুটি এলপিজি সিলিন্ডার বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে। এতে প্রাণ হারিয়েছে পাঁচজন। আহত হয়েছেন আরো ১০ জন। গড় হিসাবে দেখা যায়, প্রতিদিন দেশের কোথাও না কোথাও তিনটি করে বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটছে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এসব বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটছে রান্নাঘরে। এর বাইরে যানবাহনেও এলপিজি সিলিন্ডার ব্যবহারের ফলে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটছে।
বাসাবাড়িতে গ্যাসের নতুন সংযোগ না আসায় সিলিন্ডার ব্যবহার করতে হচ্ছে জানিয়ে সিলিন্ডারের ব্যবহারকারী গৃহিনী শামীমা বেগম বলেন, নিত্যদিনে লাকড়ির চেয়ে সুবিধাজনক হওয়ায় সিলিন্ডার ব্যবহার করছি। সিলিন্ডারের ব্যপক চাহিদা হওয়ায় এখন বাজারে মানহীন নিত্যনতুন সিলিন্ডার আসছে এসব সিলিন্ডারে মাঝেমাঝেই লিকেজ হয়। অসাবধান থাকলে এসব লিকেজ থেকেই দূর্ঘটনা ঘটে।
সূত্র আরো জানায়, মেয়াদোত্তীর্ণ গ্যাস সিলিন্ডার এখন ভুক্তভোগীদের কাছে মৃত্যুদূত হয়ে আবির্ভূত হচ্ছে। গ্যাসের আগুনের মর্মন্তুদ দুর্ঘটনার দায় নিচ্ছে না কেউ। ওসব ঘটনায় থানায় অপমৃত্যু মামলা হলেও পুলিশ সদর দপ্তরে কারো সাজা পাওয়ার পরিসংখ্যান নেই। আর সংশ্লিষ্ট তদারক সংস্থা এর জন্য ব্যবহারকারীর অসচেতনতাকেই দায়ি করেছে। আর বিশেষজ্ঞরা শুধু অসচেতনতাই নয়, মেয়াদোত্তীর্ণ, মানহীন সিলিন্ডার তৈরি ও সরবরাহ, সিলিন্ডারের সঙ্গে চুলার সংযোগ পাইপ সঠিক ফিটিংস না হওয়া এবং নিয়মিত মনিটরিং না করাকেও দায়ি করছেন।
ঢাকা মেডিকেল কলেজের বার্ণ ও প্লাস্টিক সার্জারি বিভাগের প্রধান সমন্বয়ক ডা. সামন্তলাল সেন বলেন, বিস্ফোরণে দূর্ঘটনায় আহতের সংখ্যা বাড়ার পেছনে নিম্নমানের সিলিন্ডারের সাথে সাথে অসচেতনতা এবং নিরাপত্তা ব্যাবস্থা সম্পর্কে কোন জ্ঞান না থাকাও অনেকটা দায়ী।
ফায়ার সার্ভিসের মোহাম্মদপুর মোহাম্মদপুর এরিয়ার ওসি মঞ্জুরুল ইসলাম বলেন, নিম্নমানের সিলিন্ডার ও নিরাপত্তা ব্যবস্থা সম্পর্কে অবগত না থাকায় দুর্ঘটনা বৃদ্ধি পেয়েছে। আবার গ্রাহক নিজেও খুব বেশি আগ্রহী না সিলিন্ডারের পরীক্ষা করাতে। এজন্যে সবার মধ্যে প্রথমে সচেতনতা তৈরি করতে হবে। তিনি আরও বলেন, সরকারি দপ্তরের দায়িত্ব ছিলো এসব প্রত্যেকটি ঘটনার বিভাগীয় পরীক্ষা নীরিক্ষা ও তদন্ত করার। অথচ, এই দপ্তরের কারো এ বিষয়ে খুব বেশি মাথা ব্যাথা লক্ষ করা যায়নি। প্রতি ৬ মাস পরপর প্রতিটা সিলিন্ডারের পরীক্ষা করা হলে এসব দূর্ঘটনা কমিয়ে আনা সম্ভব।
সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, গ্যাস সিলিন্ডারের স্বাভাবিক আয়ুষ্কাল ১৫ বছর। অথচ ২৮ বছরের পুরনো সিলিন্ডারেও এলপিজি বিপণন হচ্ছে। মূলত মেয়াদোত্তীর্ণ এসব সিলিন্ডারে গ্যাস বিপণনের কারণেই দুর্ঘটনা ও প্রাণহানি বাড়ছে। বর্তমানে ব্যক্তি খাতের হাতে এলপি গ্যাস বাজারের ৮০ ভাগের নিয়ন্ত্রণ। সিলিন্ডারে সাধারণত গ্যাসভাল্ব, হোসপাইপ, রেগুলেটর ইত্যাদি লিকেজ হয়ে বিস্ফোরণ হয়। এজন্যে সিলিন্ডারে নিয়মিত সেফটি ভাল্ব লাগিয়ে রাখতে হবে এবং তা নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করতে হবে। আর ক্রেতাদেরও সিলিন্ডার কেনার সময় মেয়াদ আছে কি না যাচাই করে কিনতে হবে। যেহেতু গ্যাস সিলিন্ডারের চাহিদা বেড়েছে এই দিকের নিরাপত্তাও জোরদার করাটা এখন জরুরি। এজন্যে দ্রুত যেকোন দুর্ঘটনার কারণ খুঁজে তা সমাধানে রেগুলেটরি বডি করে দেয়া উচিৎ।
এসডব্লিউ/এমএন/ এফএ/১৩৪৮
আপনার মতামত জানানঃ