বাংলাদেশে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর এক বছর কেটে গেলেও দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি এখনো স্থিতিশীল হয়নি—এমন বাস্তবতা সাম্প্রতিক পরিসংখ্যান, মানবাধিকার সংস্থার প্রতিবেদন এবং বিশেষজ্ঞদের মন্তব্যে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। ২০২৪ সালের আগস্টে সরকারের পতনের পর পুলিশ বাহিনী কার্যত ভেঙে পড়ে। অনেক পুলিশ কর্মকর্তা ও সদস্য নিজেদের নিরাপত্তাহীন মনে করে কর্মস্থলে ফেরেননি, কেউ কেউ আবার সহিংস হামলার শিকার হয়েছেন। এই শূন্যতার সুযোগে রাজনৈতিক প্রতিশোধ, চাঁদাবাজি, দখলদারি ও মব সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে, যা আইনশৃঙ্খলা ব্যবস্থাকে আরও নড়বড়ে করে দেয়। যদিও অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পক্ষ থেকে ‘ডেভিল হান্ট’ ও ‘চিরুনি অভিযান’-এর মতো কর্মসূচি হাতে নেওয়া হয়েছিল, তবুও অপরাধের প্রবণতা থামেনি, বরং বহু ক্ষেত্রে তা বেড়েছে বলেই পুলিশের নিজস্ব পরিসংখ্যান প্রমাণ করছে।
পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৫ সালের প্রথম ছয় মাসে দেশে মোট ১,৯৩০ জন খুন হয়েছেন। জানুয়ারিতে খুনের সংখ্যা ছিল ২৯৪, যা জুনে এসে দাঁড়ায় ৩৪৩-এ—এটাই বছরের সর্বোচ্চ। একই সময়ে ৩৬৬টি ডাকাতি এবং নারী ও শিশু নির্যাতনের ১১,০০৮টি ঘটনা রেকর্ড হয়েছে। খুনের পরিসংখ্যানে একটি ধারাবাহিক ঊর্ধ্বগতি লক্ষ্য করা গেছে, যা এই সময়ে সরকারের অপরাধ নিয়ন্ত্রণের সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং দাবি করছে, বড় ধরনের অপরাধের হার স্থিতিশীল, তবে পুলিশের বার্ষিক ও মাসিক তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, সহিংস অপরাধ, বিশেষত খুন, অপহরণ, গণপিটুনি এবং মব সহিংসতা নিয়ে উদ্বেগ বাড়ছেই।
মানবাধিকার সংস্থাগুলোও এই অস্থির পরিস্থিতির দিকে বারবার আঙুল তুলেছে। মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশন মে মাসে ৫৫টি এবং জুন মাসে ৪৯টি অজ্ঞাতনামা লাশ উদ্ধারের তথ্য প্রকাশ করেছে, যা নাগরিকদের মধ্যে গভীর নিরাপত্তাহীনতার অনুভূতি সৃষ্টি করেছে। আইন ও সালিশ কেন্দ্র জানাচ্ছে, বছরের প্রথম ছয় মাসে অন্তত ১৪১টি মব সহিংসতার ঘটনায় ৮৩ জন নিহত হয়েছেন, যার প্রায় অর্ধেক ঘটনাই ঢাকা শহরে। একই সময়ে ৩৩০টি ধর্ষণ হয়েছে, যার মধ্যে ৬৬টি ছিল দলবদ্ধ ধর্ষণ এবং ২২টি ধর্ষণের পর হত্যার ঘটনা। রাজনৈতিক সহিংসতায় ৪৪ জনের মৃত্যু ঘটেছে, আর বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ও হেফাজতে মৃত্যু ঘটেছে ১৫ জনের।
শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর থেকে রাজনৈতিক সহিংসতার পাশাপাশি চাঁদাবাজি ও ক্ষমতার অপব্যবহার বেড়েছে। কিছু রাজনৈতিক কর্মী ও আন্দোলনকর্মীর বিরুদ্ধে ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে অর্থ আদায়, সচিবালয়ে তদবির, এমনকি প্রকাশ্যে হামলার অভিযোগ এসেছে। অনেক ক্ষেত্রে এই অভিযোগের বিরুদ্ধে পুলিশের সক্রিয় পদক্ষেপ ছিল না বললেই চলে। তবে গুলশানে সাবেক এক এমপির বাসায় ৫০ লাখ টাকা চাঁদা দাবির ঘটনায় কয়েকজনকে গ্রেফতার করার মধ্য দিয়ে প্রথমবারের মতো পুলিশ দৃশ্যমান কঠোর পদক্ষেপ নেয়। এর আগে ধানমন্ডির একটি বাসায় হামলা চালিয়ে আটককৃতদের থানা থেকে ছাড়িয়ে নেওয়ার ঘটনাও ব্যাপক সমালোচনার জন্ম দিয়েছিল।
আইনশৃঙ্খলার অবনতির সবচেয়ে ভয়াবহ উদাহরণ হিসেবে উঠে এসেছে মিটফোর্ড হাসপাতালে প্রকাশ্য দিবালোকে সংঘটিত নৃশংস হত্যাকাণ্ড। পাথর ও লাঠি দিয়ে আঘাত করে একজনকে হত্যা করা হয়, যা সারাদেশে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। এর মাত্র দুই দিন পর খুলনায় যুবদলের এক সাবেক সহসভাপতিকে গুলি করে ও রগ কেটে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। মাদারীপুরে মসজিদের ভেতরে আপন দুই ভাইসহ তিনজনকে হত্যার ঘটনাও একই সময়ে আলোড়ন তোলে। এই ধারাবাহিক সহিংসতা, বিশেষ করে জনসম্মুখে ও সামাজিক মাধ্যমে পূর্বঘোষণা দিয়ে সংঘটিত হামলা, আইনশৃঙ্খলা ব্যবস্থার দুর্বলতাকে নগ্নভাবে প্রকাশ করেছে।
পুলিশ বাহিনীর শীর্ষ কর্মকর্তারা বলছেন, তারা এখন সর্বোচ্চ পেশাদারিত্বের সঙ্গে কাজ করছেন এবং অপরাধ ঘটলেই দ্রুত ব্যবস্থা নিচ্ছেন। কিন্তু সাবেক আইজিপি মোহাম্মদ নূরুল হুদার মতে, নিরাপত্তাহীনতার বোধ তৈরি হওয়ার মূল কারণ হলো—পুলিশ ও কর্তৃপক্ষের প্রতি মানুষের ভয়ের অনুভূতি হারিয়ে যাওয়া এবং বহু ঘটনায় হার্ড অ্যাকশন না নেওয়া। তিনি মনে করেন, পুলিশের গোয়েন্দা নেটওয়ার্ক সঠিকভাবে কাজ করেনি, আর বাহিনীর মধ্যে আত্মবিশ্বাসের ঘাটতি ছিল স্পষ্ট। মানবাধিকার কর্মী নূর খান লিটনও মনে করেন, দীর্ঘদিন রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহৃত হওয়ার ফলে এবং পরবর্তীতে হামলার শিকার হয়ে পুলিশ মনোবল হারিয়েছে। তাঁর মতে, পুলিশকে সক্রিয় করতে হলে কেবল ছাত্র হত্যার বিচার নয়, পুলিশ হত্যার বিচারও জরুরি।
সমাজ অপরাধ বিশেষজ্ঞ তৌহিদুল হকের মতে, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি অনেকাংশে দেশের রাজনৈতিক আবহ ও নির্বাচনের সঙ্গে সম্পর্কিত। সরকারের পক্ষ থেকে রাজনৈতিক দলগুলোকে আস্থায় না নেওয়ার কারণে আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে সহযোগিতা পাওয়া যায়নি। তিনি আরও মনে করেন, কিছু ক্ষেত্রে পুলিশ দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি, আবার কিছু সিদ্ধান্ত মাঠপর্যায়ে বাস্তবায়িত হয়নি। পুলিশের কাজ শুধু বিবৃতি দেওয়া নয়, বরং কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া—কিন্তু বাস্তবে অনেক পুলিশ সদস্য দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে নিজেরাই নিরাপত্তা সংকটে পড়েছেন এবং যথাযথ সমর্থন পাননি।
সব মিলিয়ে বলা যায়, শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর থেকে বাংলাদেশে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি এক অনিশ্চিত অস্থিরতার মধ্যে রয়েছে। রাজনৈতিক প্রতিশোধ, ক্ষমতার অপব্যবহার, চাঁদাবাজি, মব সহিংসতা ও সংগঠিত অপরাধের ঘনঘটা জনজীবনে নিরাপত্তাহীনতা বাড়িয়ে দিয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকার ও আইন প্রয়োগকারী বাহিনী চেষ্টা চালাচ্ছে—এমন দাবি থাকলেও পরিসংখ্যান বলছে, অপরাধের ধারা এখনো ঊর্ধ্বমুখী। এই পরিস্থিতি কাটিয়ে উঠতে হলে শুধু বাহিনীর মনোবল ফেরানোই নয়, রাজনৈতিক সহযোগিতা, বিচার প্রক্রিয়ায় গতি, এবং অপরাধ দমনে ধারাবাহিক ও কঠোর পদক্ষেপ নেওয়াই হতে পারে একমাত্র পথ। নতুবা অপরাধীরা ভয় হারিয়ে আরও বেপরোয়া হয়ে উঠবে, আর জনগণের মধ্যে নিরাপত্তাহীনতার অনুভূতি গভীর থেকে গভীরতর হবে।
আপনার মতামত জানানঃ