ঢাকার মিটফোর্ড হাসপাতালের সামনে সংঘটিত ভাঙারি ব্যবসায়ী মো. সোহাগের নির্মম হত্যাকাণ্ড বাংলাদেশের নগর রাজনীতি, ব্যবসায়িক আধিপত্য এবং আইনশৃঙ্খলার দুর্বলতার এক ভয়াবহ প্রতিচ্ছবি হয়ে উঠেছে। ২০২৫ সালের ৯ জুলাই বিকেল সাড়ে পাঁচটার দিকে, পুরান ঢাকার প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ৩ নম্বর গেটসংলগ্ন রজনী ঘোষ লেনে, এই নৃশংস ঘটনা ঘটে। স্থানীয়ভাবে পরিচিত ও প্রতিষ্ঠিত ভাঙারি ব্যবসায়ী মো. সোহাগকে কুপিয়ে ও পিটিয়ে হত্যা করা হয় প্রকাশ্যে, শত শত মানুষের উপস্থিতিতে। ঘটনা ঘটার পরই এলাকায় চাঞ্চল্য ছড়িয়ে পড়ে, এবং সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে হত্যার ভিডিও ও ছবি।
নিহত সোহাগের বাড়ি বরিশালে হলেও তিনি দীর্ঘদিন ধরে ঢাকার কেরানীগঞ্জে বসবাস করতেন এবং মিটফোর্ড রোডসংলগ্ন এলাকায় ভাঙারি ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তার ব্যবসা মূলত পুরনো তার, অ্যালুমিনিয়াম, ও ইলেকট্রিক পণ্যের স্ক্র্যাপ নিয়ে। এলাকাটি অনেক দিন ধরেই অবৈধ চাঁদাবাজি ও প্রতিপক্ষ দখল নিয়ে আলোচিত। পুলিশ সূত্রে জানা যায়, সোহাগ একসময় যুবদলের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, যদিও সাম্প্রতিক সময়ে তার সক্রিয় রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা নিয়ে কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। তার নাম বেশ কিছুদিন ধরেই এলাকায় আধিপত্য বিস্তারের সংঘাতে আলোচনায় ছিল। বিভিন্ন সুত্র থেকে জানা যায়, সোহাগের সঙ্গে স্থানীয় প্রতিপক্ষ গ্রুপের কয়েকজনের দীর্ঘদিন ধরে দন্দ্ব চলছিল। মূলত ভাঙারি ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ ও চাঁদাবাজির ভাগ নিয়ে তার সঙ্গে মনির, মঈন, টিটু, অপু দাস নামের ব্যক্তিদের সঙ্গে বিরোধ ছিল।
পুলিশ জানায়, পূর্বপরিকল্পিতভাবেই সোহাগকে হামলার শিকার করা হয়। প্রথমে কথাকাটাকাটি, এরপর একপর্যায়ে লাঠিসোঁটা, রড, এবং ধারালো অস্ত্র নিয়ে তাকে এলোপাতাড়ি আঘাত করা হয়। প্রত্যক্ষদর্শীদের ভাষ্য অনুযায়ী, হামলাকারীরা এতটাই নির্মম ছিল যে, সোহাগ মাটিতে পড়ে যাওয়ার পরেও তার ওপর লাফিয়ে লাফিয়ে আঘাত করছিল। ভিডিও ফুটেজে দেখা যায়, একজন তার মাথার ওপর পাথর ছুঁড়ে মারছে, আরেকজন ধারালো অস্ত্র দিয়ে পেট্রোল পাম্পের পাশে দাঁড়িয়ে থেকে আঘাত করছে। আশেপাশে অনেকে দাঁড়িয়ে থাকলেও কেউ সাহস করেনি এগিয়ে যেতে। ঘটনাস্থলেই সোহাগ প্রাণ হারান। পরে তার মরদেহ উদ্ধার করে ময়নাতদন্তের জন্য মিটফোর্ড হাসপাতালের মর্গে পাঠানো হয়।
কোতোয়ালি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. মনিরুজ্জামান ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করে বলেন, এটি একটি পূর্বশত্রুতার জের। এই ঘটনায় একজনকে তাৎক্ষণিকভাবে আটক করা হয়েছে, এবং বাকিদের গ্রেপ্তারে অভিযান চলছে। হত্যার সময়কার সিসিটিভি ফুটেজ সংগ্রহ করা হয়েছে, যা তদন্তের কাজে সহায়তা করবে। মামলায় ১৯ জনের নাম উল্লেখ করে এবং আরও অজ্ঞাত ১৫–২০ জনকে আসামি করে হত্যা মামলা করা হয়েছে। সন্দেহভাজনদের মধ্যে অনেকেই এলাকায় প্রভাবশালী ও রাজনৈতিক পরিচয়সম্পন্ন বলে পুলিশ সূত্রে জানা গেছে। তারা ভাঙারি ব্যবসার মাধ্যমে অবৈধ অর্থ উপার্জনের পাশাপাশি স্থানীয় প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করছিল।
এ ঘটনায় রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা নিয়ে নানা আলোচনা শুরু হয়েছে। স্থানীয়দের দাবি, এইসব চাঁদাবাজি ও দখলবাজির পেছনে রাজনৈতিক ছত্রছায়া রয়েছে। যারা এই হত্যাকাণ্ডে অংশ নিয়েছে, তাদের বেশ কয়েকজন ছাত্রদল ও যুবদলের সঙ্গে যুক্ত ছিল বলে জানা গেছে। যদিও দলীয়ভাবে বিষয়টি অস্বীকার করা হয়েছে, কিন্তু সোহাগের এক সময়ের রাজনৈতিক পরিচয় এবং দখল নিয়ে বিরোধকে কেন্দ্র করে তার ওপর এই হামলার বিষয়টি প্রশ্ন তোলে—সাম্প্রতিক সময়ে রাজনৈতিক পরিচয় কীভাবে অপরাধ ঢাকতে ব্যবহৃত হচ্ছে। এ ঘটনায় রাজনীতিকদের দায় এড়ানোর সুযোগ নেই।
পুরান ঢাকার মিটফোর্ড হাসপাতাল ঘিরে গড়ে ওঠা ভাঙারি মার্কেট বহুদিন ধরেই অবৈধ কর্মকাণ্ডের আখড়া হয়ে উঠেছে। এখানে প্রতিদিন কোটি টাকার পুরাতন বৈদ্যুতিক যন্ত্রাংশ ও ধাতব পদার্থ কেনাবেচা হয়, যার বড় একটি অংশ চোরাই ও কর ফাঁকি দেওয়া পণ্য। এই ব্যবসাকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে একাধিক চাঁদাবাজ চক্র। এরা রাজনৈতিক আশ্রয় নিয়ে এলাকায় আধিপত্য বিস্তার করে, ব্যবসায়ীদের ভয় দেখিয়ে নিয়মিত চাঁদা আদায় করে। সোহাগ এমন এক চক্রের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিলেন বলেই তার প্রাণ দিতে হলো বলে অনেকে মনে করেন।
এই হত্যাকাণ্ড দেশজুড়ে উদ্বেগের সৃষ্টি করেছে। রাজধানীর কেন্দ্রস্থলে, একটি সরকারি হাসপাতালের সামনে, জনসমক্ষে এমন নৃশংস ঘটনা আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির ভয়াবহ চিত্র তুলে ধরে। একদিকে পুলিশ ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর ব্যর্থতা, অন্যদিকে রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়নের বাস্তব উদাহরণ। এ ঘটনা শুধু সোহাগ হত্যার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং এটি দেশের সমাজ ও রাজনীতিতে গভীর অবক্ষয়ের ইঙ্গিত বহন করে। সাধারণ মানুষ আতঙ্কিত—আজ সোহাগ, কাল হয়তো কেউ আরেকজন। অপরাধীরা যদি ধরা পড়েও যায়, তারা রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে পার পেয়ে যাবে—এই ধারণা জনমনে প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে।
বিশ্লেষকেরা মনে করছেন, এই ধরণের অপরাধ প্রতিরোধে কেবল পুলিশি ব্যবস্থা যথেষ্ট নয়। অপরাধীদের দ্রুত বিচারের আওতায় আনতে হবে, পাশাপাশি রাজনৈতিক দলগুলোকে নিজেদের কর্মীদের অপরাধ ঢাকতে না দিয়ে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। সামাজিক পর্যায়ে সচেতনতা গড়ে তুলতে হবে যেন কেউ ভয় না পায় অপরাধ প্রকাশ করতে। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে আরও স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার সঙ্গে কাজ করতে হবে।
এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে কয়েকটি করণীয় জরুরি হয়ে উঠেছে। প্রথমত, মিটফোর্ড ও পুরান ঢাকা এলাকায় চাঁদাবাজি ও অবৈধ ভাঙারি ব্যবসার বিরুদ্ধে কঠোর অভিযান চালাতে হবে। দ্বিতীয়ত, সমস্ত ভাঙারি ব্যবসা নিবন্ধন ও নিয়ন্ত্রণের আওতায় আনতে হবে, যাতে অসাধু ব্যক্তিরা এর সুযোগ নিতে না পারে। তৃতীয়ত, সিসিটিভি নজরদারি বাড়িয়ে অপরাধ নিয়ন্ত্রণ করতে হবে, বিশেষ করে হাসপাতাল, মার্কেট ও ব্যস্ত এলাকাগুলোতে। চতুর্থত, বিচারপ্রক্রিয়া দ্রুত শেষ করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির মাধ্যমে অপরাধীদের রক্ষা করার প্রবণতা ভাঙতে হবে। পঞ্চমত, রাজনৈতিক দলগুলোকে স্বচ্ছ নৈতিকতা প্রতিষ্ঠা করতে হবে, যাতে অপরাধীরা রাজনৈতিক পরিচয়ের আশ্রয়ে অপরাধ করে পার না পায়।
এই ঘটনাটি স্পষ্ট করে দেয়, আমাদের সমাজে রাজনীতি ও অপরাধের মিশ্রণ কতটা ভয়াবহ হয়ে উঠেছে। যে ভাঙারি ব্যবসা একসময় ছিল সাধারণ মানুষের রুজি-রোজগারের একটি পথ, তা এখন অপরাধজগতের আখড়ায় পরিণত হয়েছে। মো. সোহাগ ছিলেন এক সময়ের রাজনৈতিক কর্মী, পরে হাল ধরেছিলেন স্বাবলম্বী জীবনের। কিন্তু অপরাধীদের চোখে তিনি হয়ে ওঠেন প্রতিবন্ধক। তাই তাকে সরিয়ে দেওয়া হয় নির্মমভাবে। এই ঘটনা যদি দেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, বিচারব্যবস্থা ও রাজনৈতিক নেতৃত্বকে না নাড়া দেয়, তবে আরও অনেক সোহাগের রক্তে রঞ্জিত হবে আমাদের রাজপথ। দেশের মানুষের নিরাপত্তা, ন্যায়বিচার ও সুশাসনের দাবিতে এই ঘটনার কঠোর এবং দৃষ্টান্তমূলক প্রতিকার এখন সময়ের দাবি।
আপনার মতামত জানানঃ