বাংলাদেশের বর্তমান অর্থনৈতিক বাস্তবতায় একটি শব্দ প্রায় সবার মুখে মুখে ঘুরছে—মূল্যস্ফীতি। বাজারে গেলে সবকিছুর দাম বাড়তির দিকে। চাল, ডাল, তেল, মাংস—প্রতিটি জিনিসেই আগের চেয়ে অনেক বেশি টাকা খরচ করতে হচ্ছে। মানুষ বলছে, “সব কিছুর দাম বাড়ছে, টাকার দাম কমে গেছে।” কিন্তু আসলে কেন এমন হচ্ছে? মূল্যস্ফীতি কীভাবে কাজ করে? কেন তা বাড়ে? এবং এর হাত থেকে কীভাবে রক্ষা পাওয়া যায়?
মূল্যস্ফীতি মূলত এমন একটি অর্থনৈতিক অবস্থা, যেখানে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে জিনিসপত্রের দাম বাড়তে থাকে এবং একই পরিমাণ টাকায় আগের মতো পণ্য কেনা সম্ভব হয় না। এই অবস্থাকে অনেকে বলেন টাকার ক্রয়ক্ষমতা হ্রাস। ১৯৭২ সালে যেটা ৫ টাকায় পাওয়া যেত, আজ তার জন্য ৮৫ টাকা খরচ করতে হচ্ছে। কিন্তু এটা তো হঠাৎ করে ঘটে না। এর পেছনে কাজ করে কিছু গভীর কারণ।
বাংলাদেশে মূল্যস্ফীতির অন্যতম বড় কারণ হচ্ছে চাহিদা ও জোগানের ভারসাম্য হারানো। ধরুন, বাজারে চালের জোগান কমে গেছে বন্যার কারণে, কিন্তু মানুষের চাহিদা তো একই আছে। তখন সবাই মিলে যখন সেই অল্প পরিমাণ চাল কিনতে চায়, তখনই দাম বাড়ে। এটাকে বলে চাহিদাজনিত মূল্যস্ফীতি (demand-pull inflation)। আবার, যদি কোনো পণ্যের উৎপাদন খরচ বেড়ে যায়—যেমন বিদ্যুৎ, গ্যাস, কাঁচামাল—তাহলে সেই খরচ পণ্যের দামে যুক্ত হয়। একে বলা হয় ব্যয়চালিত মূল্যস্ফীতি (cost-push inflation)। বাংলাদেশে এই দুটি কারণই প্রায় একসঙ্গে কাজ করে।
আরো একটি বড় কারণ হচ্ছে অতিরিক্ত মুদ্রা সরবরাহ। যখন সরকার বেশি টাকা ছাপায় বা বেতন-ভাতা বাড়িয়ে দেয়, তখন মানুষের হাতে টাকা বাড়ে। কিন্তু বাজারে পণ্যের পরিমাণ না বাড়লে টাকার মান পড়ে যায়, এবং দাম বেড়ে যায়। এটি ঘটে যখন অর্থনীতিতে চাহিদা কৃত্রিমভাবে বাড়িয়ে দেওয়া হয়।
বাংলাদেশের মতো দেশে মূল্যস্ফীতি প্রায়শই খাদ্যপণ্যের ওপর বেশি প্রভাব ফেলে। কারণ, এখানকার মানুষ আয়ের একটি বড় অংশ ব্যয় করে খাদ্য কিনতে। ফলে চাল, ডাল, তেল, ডিমের মতো নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বাড়লে, নিম্ন ও মধ্যবিত্ত মানুষের জীবনযাত্রা কঠিন হয়ে পড়ে।
মূল্যস্ফীতি পরিমাপ করা হয় ভোক্তা মূল্যসূচক বা সিপিআই (Consumer Price Index) দিয়ে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (BBS) প্রতি মাসে সিপিআই প্রকাশ করে। এ জন্য তারা দেশের ৬৪ জেলার বিভিন্ন বাজার থেকে ১,০০০-এর বেশি পণ্যের দাম সংগ্রহ করে, যেগুলো বিভিন্ন শ্রেণির মানুষ প্রতিদিন ব্যবহার করে। তারপর সেগুলোর গড় হিসাব করে মূল্যস্ফীতির হার নির্ধারণ করা হয়।
মূল্যস্ফীতি সবসময় খারাপ, এমন নয়। বরং অল্প পরিমাণ মূল্যস্ফীতি (প্রতি বছর ২–৩%) অর্থনীতির জন্য ভালো। এতে মানুষ ভবিষ্যতে দাম বাড়বে ভেবে এখনই পণ্য কিনে নেয়, ফলে বাজার চাঙ্গা থাকে। কিন্তু যখন মূল্যস্ফীতি অনেক বেড়ে যায় (যেমন ১০% বা তার বেশি), তখন মানুষের প্রকৃত আয় কমে যায় এবং জীবনযাত্রার মান পড়ে যায়।
বিশ্বের অনেক দেশেই অতিমূল্যস্ফীতি (Hyperinflation) বড় সংকট তৈরি করেছে। জিম্বাবুয়েতে একসময় একটি রুটির দাম ছিল ১ বিলিয়ন ডলার। জার্মানিতে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর মানুষ টাকা দিয়ে চুলা জ্বালাত, কারণ তা কয়লার চেয়ে সস্তা ছিল। ভেনেজুয়েলায় ২০১৮ সালে মুদ্রাস্ফীতির হার ১ কোটি শতাংশ ছুঁয়েছিল। এই অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে দেশগুলো মুদ্রানীতি ও রাজস্বনীতির মাধ্যমে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করার কৌশল গ্রহণ করে।
বাংলাদেশে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের মূল দায়িত্ব কেন্দ্রীয় ব্যাংক—বাংলাদেশ ব্যাংকের। তারা মুদ্রানীতির মাধ্যমে সুদের হার নির্ধারণ করে। যদি সুদের হার বাড়ানো হয়, তাহলে ঋণ নিতে খরচ বাড়ে, ফলে বাজারে খরচ কমে যায় এবং মূল্যস্ফীতি কমতে শুরু করে। অন্যদিকে, সরকার রাজস্বনীতি দিয়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করতে পারে—যেমন কর বাড়ানো বা কমানো, সরকারি ব্যয় কমানো বা বাড়ানো ইত্যাদি।
তবে ব্যক্তি পর্যায়ে আমরা নিজেরা কিছু ব্যবস্থা নিতে পারি। সঞ্চয়ের পাশাপাশি বিনিয়োগ একটি ভালো উপায়। যেমন: সোনা কেনা, শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ, রিয়েল এস্টেট, বা সরকারি সঞ্চয়পত্র। কারণ, মূল্যস্ফীতি বাড়লেও এই বিনিয়োগের মাধ্যমে টাকার প্রকৃত মূল্য কিছুটা ধরে রাখা যায়।
মূল্যস্ফীতিকে বোঝা ও মোকাবিলা করা সময়ের দাবি। এটি বোঝার জন্য অর্থনীতিবিদ হতে হয় না, বরং সাধারণ কিছু ধারণা থাকলেই নিজের আর্থিক পরিকল্পনা অনেক ভালোভাবে সাজানো সম্ভব। মূল্যস্ফীতি যেন আপনাকে না পরিচালনা করে, বরং আপনি যেন নিজের অর্থনীতিকে বুঝে সামনের দিকে এগোতে পারেন।
আপনার মতামত জানানঃ