বর্তমান বাংলাদেশ এক ভয়াবহ নিরাপত্তাহীন বাস্তবতার মুখোমুখি। প্রতিদিনের খবরের পাতায় জায়গা করে নিচ্ছে খুন, ছিনতাই, ডাকাতি ও গণপিটুনির মতো ঘটনার মিছিল। দৈনিক বাংলাদেশ প্রতিদিন-এর প্রথম পাতার প্রতিবেদন ‘নিয়ন্ত্রণহীন আইনশৃঙ্খলা’ কেবল একটি সংবাদ নয়, বরং এটি দেশের সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থার গভীরতম দুর্বলতার নগ্ন প্রকাশ।
পুলিশের নিজস্ব পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বর্তমানে দেশে প্রতিদিন গড়ে ১০টি হত্যা সংঘটিত হচ্ছে। এই অঙ্কটি কেবল শংকাজনক নয়, এটি রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার গভীর ব্যর্থতার বার্তা বহন করে। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে মে পর্যন্ত পাঁচ মাসে ১,৫৮৭টি হত্যা মামলা হয়েছে, যা গত বছরের তুলনায় ২০ শতাংশ বেশি। এই সময়ের মধ্যে শুধু ঢাকা শহরেই ঘটেছে দেড় শতাধিক খুন। আক্রান্তরা শুধুমাত্র অপরাধজগতের কেউ নন—নারী, যুবক, পেশাজীবী, এমনকি শিক্ষার্থীও এই নৃশংসতার শিকার হচ্ছেন।
একই সময়ে ১০৩৯টি ডাকাতি ও দস্যুতার মামলা হয়েছে, যার মধ্য দিয়ে প্রতিমাসে গড়ে ২০৮টি এমন ঘটনা ঘটেছে। আগের বছর এই সংখ্যা ছিল ৬৫২। অর্থাৎ অপরাধ প্রবণতায় প্রবল বৃদ্ধি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। একইসাথে নারী ও শিশু নির্যাতনের ৯ হাজারের বেশি মামলা এবং রাজনৈতিক সহিংসতায় ৬৭ জন নিহত হওয়ার তথ্য এই সংকটকে আরও জটিল করে তুলেছে।
বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হয়ে উঠেছে সাম্প্রতিক মব জাস্টিস বা গণপিটুনি—যেখানে আইনের শাসনের জায়গা নিয়েছে উগ্র জনতার রোষ। ৩১ মে মিরপুরে দুইজনকে পিটিয়ে হত্যার ঘটনা সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হয়ে আলোচনার জন্ম দেয়। রাজধানীর একাধিক এলাকায় মাত্র ১২ ঘণ্টার ব্যবধানে তিনটি হত্যাকাণ্ড এ বাস্তবতাকে আরও ঘনঘোর করে তোলে। পুলিশের পক্ষ থেকে যদিও বলা হয়েছে ‘আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই’, বাস্তব চিত্র বলছে, সাধারণ মানুষ আজ ভীত, উদ্বিগ্ন এবং অসহায়।
প্রশ্ন উঠছে—আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর আন্তরিকতা ও দক্ষতা নিয়েও। সরকার ও প্রশাসন বারবার আশ্বস্ত করলেও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসছে না। সাবেক আইজিপি আশরাফুল হুদা যেমন বলেছেন, এখন সময় হয়েছে পুলিশের কার্যক্রমকে আরও গভীর মনিটরিং ও জবাবদিহিতার আওতায় আনার। পুলিশে নিয়োগে স্বচ্ছতা ও মেধার ভিত্তিতে পরিবর্তনের তাগিদ দিচ্ছেন তিনি। একইসাথে স্বতন্ত্র পুলিশ কমিশনের মতো কাঠামো গঠনের প্রস্তাবও উঠে এসেছে—যা হয়তো পুলিশকে রাজনৈতিক ও بيرৌক্রেটিক প্রভাবমুক্ত রাখতে সাহায্য করতে পারে।
অন্যদিকে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী গণপিটুনিকে ‘অগ্রহণযোগ্য’ উল্লেখ করে অপরাধ দমনে গোয়েন্দা তৎপরতা ও নজরদারি বাড়ানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। তবে এই প্রতিশ্রুতিগুলো বাস্তবায়নের চেয়ে প্রচারে বেশি সীমাবদ্ধ বলে মনে করছে সচেতন মহল।
রাজনৈতিক সহিংসতা ও প্রতিহিংসার ঘটনাও বাড়ছে উদ্বেগজনক হারে। মানবাধিকার সংস্থা এইচআরএসএস জানাচ্ছে, শুধুমাত্র জানুয়ারি থেকে মার্চের মধ্যে ৩২৫টি রাজনৈতিক সহিংসতায় ৪৭ জন নিহত হয়েছেন, বাকিরা এপ্রিল-মে সময়ে। রাজনৈতিক আধিপত্য, চাঁদাবাজি ও জমি দখলকে কেন্দ্র করেই ঘটছে অধিকাংশ সহিংসতা। এ বাস্তবতা সমাজে একটি অঘোষিত নিরাপত্তাহীনতা তৈরি করছে, যা ব্যক্তি থেকে পরিবার এবং সমাজ থেকে রাষ্ট্র পর্যন্ত সবাইকে আক্রান্ত করছে।
তবে এই ভয়াল পরিস্থিতির মাঝেও সরকারের পক্ষ থেকে দাবি করা হচ্ছে—পুলিশ আগের চেয়ে বেশি সক্রিয়, তাদের মনোবল বেড়েছে, এবং তারা ‘তাৎক্ষণিক রেসপন্স’ করছে। কিন্তু প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে, এত সক্রিয়তা সত্ত্বেও কেন অপরাধ সংখ্যা লাগামছাড়া হারে বাড়ছে? শুধু পরিসংখ্যান দেখেই বোঝা যায়, রাষ্ট্রীয় আইনশৃঙ্খলা ব্যবস্থা একটি গভীর আস্থার সংকটে ভুগছে।
জনগণের আস্থা অর্জনের জন্য প্রয়োজন শুধু আশ্বাস নয়, প্রয়োজন দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি, দ্রুত তদন্ত ও বিচার, স্বচ্ছতা এবং প্রশাসনিক সমন্বয়। আজকের বাংলাদেশে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখা এখন আর কেবল একটি দায়িত্ব নয়—এটি হয়ে উঠেছে রাষ্ট্রীয় অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার অপরিহার্য লড়াই। সমাজে যদি প্রতিদিন গড়ে ১০টি হত্যাকাণ্ড ঘটে, প্রতিমাসে শত শত ডাকাতি হয়, আর মানুষ যদি আইন নিজের হাতে তুলে নিতে শুরু করে, তবে তা কেবল আইনশৃঙ্খলা নয়—রাষ্ট্রীয় কাঠামোরও বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে।
এই বাস্তবতায় আর সময়ক্ষেপণের সুযোগ নেই। এখনই প্রয়োজন জাতীয়ভাবে গভীর বিশ্লেষণ, রাজনৈতিক সদিচ্ছা এবং প্রশাসনিক আন্তরিকতা—না হলে সামনের দিনগুলো আরও বেশি অনিশ্চয়তা, ভয় আর রক্তের গল্প লিখে যাবে বাংলাদেশের ভাগ্যে।
আপনার মতামত জানানঃ