দুদকের ভুল তদন্তে সোনালী ব্যাংক ঋণ জালিয়াতি মামলায় জাহালম নামে এক নিরপরাধী তিন বছর সাজা খাঁটেন। চেহারার কিছুটা মিল থাকায় দুদকের এই ভুল হয়েছিল বলে তখন দুদক জানিয়েছিল। দুদকের ভুলে খাঁটা এক পাটকল শ্রমিকের কারাভোগের ঘটনা তখন দেশব্যাপী আলোচনার জন্ম দিয়েছিল। পরে আদালত জাহালমকে নির্দোষ প্রমাণ করে বেকসুর খালাস দেন। একইসাথে জাহালমকে ক্ষতিপূরণ দিতেও নির্দেশ দেন। এই ঘটনা বেশিদিন আগের নয়। জাহালম ২০১৯ সালে জেল থেকে মুক্তি পান। এর রেশ এখনো রয়ে গেছে চায়ের দোকান কিংবা কোনো আলোচনার টেবিলে। জাহালমের রেশ কাটতে না কাটতেই দুদকের ভুলে কামরুল ইসলাম নামের আরেকজন নিরপরাধ প্রায় পনের বছর সাজাভোগের দ্বারপ্রান্তে চলে গিয়েছিলেন। দুদক যে তড়িঘড়ি করে এই তদন্ত করেছে তেমনও না। দীর্ঘ ১০ বছর তদন্ত করে দুদক যাকে আসামি করে আদালতে তুলেছে আসলে সে প্রকৃত আসামি নয়। দুদকের নথিপত্রের প্রমাণে আদালতও নিরপরাধীকে পনেরো বছর সাজার রায় দিয়ে দেন। তবে জাহালমের মতো এটাও সংবাদ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে অবশেষে নিরপরাধ সেই মোহাম্মদ কামরুল ইসলামকে সাজার দায় থেকে অব্যাহতি দেন হাইকোর্ট।
দুদক ১০ বছর ধরে তদন্ত করে যে কামরুলের বিরুদ্ধে প্রতিবেদন দিয়েছে, সেই কামরুলের সঙ্গে অপরাধের কোনো সংশ্নিষ্টতা নেই। আদালত সেই প্রতিবেদনের ভিত্তিতে বিচার করে ১৫ বছর সাজা ঘোষণার পর গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করে ভুল আসামির বিরুদ্ধে। দিশাহারা নিরপরাধ এই ব্যক্তি শেষ পর্যন্ত হাইকোর্টের শরণাপন্ন হন।
রায়ে মোহাম্মদ কামরুলের ক্ষেত্রে সাজা পরোয়ানা (কারাদণ্ড ও অর্থদণ্ড) প্রত্যাহার করেছেন হাইকোর্ট। একই সঙ্গে এই ভুলের জন্য দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দিয়েছেন। কামরুল যদি মনে করেন, ক্ষতিপূরণের জন্য আবেনদনও করতে পারবেন।
এর আগে সোমবার মোহাম্মদ কামরুলের করা রিটের ওপর শুনানি নিয়ে হাইকোর্ট রায়ের জন্য দিন নির্ধারিত করে রেখেছিলেন। আজ বৃহস্পতিবার আদালতে মোহাম্মদ কামরুলের পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী মিনহাজুল হক চৌধুরী। সঙ্গ ছিলেন আইনজীবী বিজয়া বড়ুয়া। দুদকের পক্ষে ছিলেন আইনজীবী খুরশীদ আলম খান। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল মো. সারওয়ার হোসেন।
আইনজীবী মিনহাজুল হক চৌধুরী বলেন, মোহাম্মদ কামরুলকে জড়িয়ে দেওয়া সাজার রায় বাতিল করা হয়েছে। ফলে, মোহাম্মদ কামরুল এই মামলার দায় থেকে অব্যাহতি পেলেন।
অবশ্য সোমবার হাইকোর্টে প্রতিবেদন দাখিল করে দুদক জানিয়েছে, তাদের ‘সরল বিশ্বাসে’ চলা তদন্তে ভুল হয়েছে। এ ঘটনায় ক্ষমা চেয়ে সংস্থাটি দাবি করেছে, গ্রামের নামে সামঞ্জস্যের কারণে আসল অপরাধীর বদলে ভুল ব্যক্তির নামে প্রতিবেদন দেওয়া হয়েছে। নিরপরাধ এই ব্যক্তি নোয়াখালীর কামরুল ইসলাম।
নথি থেকে জানা যায়, এসএসসির ভুয়া নম্বর ও প্রশংসাপত্র তৈরি করে মাইজদী পাবলিক কলেজে একাদশ শ্রেণিতে (১৯৯৮-৯৯ শিক্ষাবর্ষ) ভর্তির অভিযোগে কামরুল ইসলামের (ঠিকানা: পূর্ব রাজারামপুর) নামে তৎকালীন দুর্নীতি দমন ব্যুরো ২০০৩ সালের জানুয়ারিতে সুধারাম থানায় মামলা করে। জব্দ করা ভর্তির আবেদনপত্রে কামরুলের জন্মতারিখ ১৯৭৯ সালের ১ জানুয়ারি ও গ্রাম পশ্চিম রাজারামপুর উল্লেখ রয়েছে। তদন্ত শেষে প্রায় ১০ বছর পর দুদকের তদন্ত কর্মকর্তা ২০১৩ সালের ২৮ নভেম্বর ওই মামলায় অভিযোগপত্র দেন, যেখানে কামরুল ইসলামের গ্রামের ঠিকানা পূর্ব রাজারামপুর উল্লেখ করা হয়।
তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়, এ মামলায় ২০১৪ সালের ৭ এপ্রিল আদালতে পুলিশের (পিঅ্যান্ডএ) এক প্রতিবেদনে এক সাক্ষীর বরাত দিয়ে বলা হয়, আসামি মো. কামরুল ইসলাম, বাবা আবুল খায়ের, গ্রাম পূর্ব রাজারামপুর ঠিকানা সঠিক নয়। প্রকৃত আসামি কামরুল ইসলাম, বাবা আবুল খায়ের, গ্রাম পশ্চিম রাজারামপুর, যিনি দেশের বাইরে আছেন। এই মামলায় নোয়াখালীর বিশেষ জজ আদালত ২০১৪ সালের ২৬ নভেম্বর রায় দেন। অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় কামরুল ইসলামকে (পিতা: আবুল খায়ের, গ্রাম: পূর্ব রাজারামপুর) দোষী সাব্যস্ত করে তিনটি ধারায় ৫ বছর করে সশ্রম কারাদণ্ড এবং ১০ হাজার টাকা করে অর্থদণ্ড দেওয়া হয় রায়ে। সব কারাদণ্ড একসঙ্গে চলবে বলা হয়।
এরপর ওই মামলায় সাজা পরোয়ানার ভিত্তিতে হয়রানি ও গ্রেপ্তার না করতে গত বছরের অক্টোবরে মোহাম্মদ কামরুল (পূর্ব রাজারামপুর) রিট করেন। এতে যুক্ত এক প্রত্যয়নপত্রে দেখা যায়, তিনি বর্তমানে নোয়াখালী চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের অফিস সহায়ক হিসেবে কর্মরত। তার সার্ভিস বুক ও এসএসসি পাসের সনদ অনুসারে তিনি ১৯৯০ সালের ১৫ অক্টোবর জন্মগ্রহণ করেন। অর্থাৎ মামলায় উল্লিখিত শিক্ষাবর্ষ (১৯৯৮-৯৯) সময়ে তার বয়স ছিল ৮ বছর। নোয়াখালীর হরিনাথপুর উচ্চবিদ্যালয় থেকে ২০০৬ সালে মোহাম্মদ কামরুল এসএসসি পাস করেন বলে ওই প্রত্যয়নপত্রে উল্লেখ রয়েছে।
রিটের প্রাথমিক শুনানি নিয়ে গত বছরের ৫ নভেম্বর হাইকোর্টের একই বেঞ্চ রুলসহ আদেশ দেন। ওই সাজা পরোয়ানার ভিত্তিতে ছয় মাসের জন্য মোহাম্মদ কামরুলকে কোনো ধরনের হয়রানি ও গ্রেপ্তার না করতে নির্দেশ দেওয়া হয়। মোহাম্মদ কামরুলকে শনাক্তকরণ বিষয়ে দুদককে চার সপ্তাহের মধ্যে আদালতে ব্যাখ্যা দিতে বলা হয়। এর ধারাবাহিকতায় দুদক ভুল স্বীকার করে আদালতে বক্তব্য দাখিল করে।
দুদকের আইনজীবী খুরশীদ আলম খান জানান, মামলার বাদী শহীদুল আলম এজাহারে অনিচ্ছাকৃত ভুলে অভিযুক্তের ক্ষেত্রে পশ্চিম রাজারামপুরের পরিবর্তে পূর্ব রাজারামপুর এবং তদন্ত কর্মকর্তা মো. মাহফুজ ইকবাল অভিযোগপত্রে ভুলবশত অভিযুক্তের ক্ষেত্রে পশ্চিম রাজারামপুরের পরিবর্তে পূর্ব রাজারামপুর উল্লেখ করেন।
সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, কিছু কিছু ক্ষেত্রে বিচার ব্যবস্থায় দক্ষতা, দুর্বলতা ও সংস্কারের অভাবে অবিচার হয়। ফলে বহু নিরীহ ব্যক্তি বিভিন্ন ধরনের ভোগান্তির শিকার হন। তারা মনে করেন, অন্যান্য মামলার মতো ইদানীং দুদকের মামলায় এ ধরনের ভুল ধরা পড়ছে। অতএব আরও দক্ষ ও জবাবদিহিমূলক ব্যবস্থা বাস্তবায়নের মাধ্যমে অবিচার দূর করতে দুদক ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী আরও সচেষ্ট হবে বলে প্রত্যাশা করি।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৮৪০
আপনার মতামত জানানঃ