বাংলাদেশে ওষুধের বাজারে নৈরাজ্য ও প্রতারণার কারণে সাধারণ মানুষ চরম সংকটে পড়েছেন। নিত্য প্রয়োজনীয় ওষুধের দামে ক্রমাগত অস্বাভাবিক বৃদ্ধি, ভেজাল ওষুধের বাজারে উপস্থিতি, এবং প্রতারণার কারণে সাধারণ মানুষের চিকিৎসা ব্যয় বহন করা কঠিন হয়ে উঠেছে। দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ ওষুধ সঠিক দামে এবং সঠিক মানের পাওয়া অত্যন্ত জরুরি। কিন্তু বর্তমানে এই ক্ষেত্রে অনেক ধরনের ঝুঁকি তৈরি হয়েছে, যা শুধুমাত্র রোগীদের স্বাস্থ্যর জন্যই হুমকি নয়, সামগ্রিকভাবে জাতীয় স্বাস্থ্য ব্যবস্থার স্থিতিশীলতার জন্যও বিরূপ প্রভাব ফেলে চলেছে।
একাধিক ক্ষেত্রে পাওয়া গেছে যে, রোগীদের প্রয়োজনীয় ওষুধের পরিবর্তে ভেজাল ওষুধ বিক্রি হচ্ছে। কুমিল্লার মিজ ফারজানা আক্তারের ঘটনা এই বিষয়টি চিত্রিত করে। তিনি তার মাকে চিকিৎসার জন্য বেসরকারি মুন হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিলেন, যেখানে তাকে ‘অ্যাকলাস্টা’ নামের একটি ইনজেকশন কেনা হয়েছিল। পরে জানা যায়, আসলে ওই ইনজেকশনটি অন্য একটি কোম্পানির তৈরি ওষুধের মোড়কে আঠা দিয়ে ‘অ্যাকলাস্টার’ নামে বিক্রি করা হয়। মূলত ৬ হাজার টাকার ওষুধকে বিক্রি করা হয়েছিল প্রায় ৩৪ হাজার ৫০০ টাকায়, যা এক ধরনের মিথ্যা প্রলোভন ও প্রতারণার উদাহরণ। এই ঘটনা নিছক একক নয়, বরং এ ধরনের প্রতারণার শিকার হচ্ছেন দেশের নানা প্রান্তের অসংখ্য মানুষ।
অন্যদিকে, ওষুধের মূল্য বৃদ্ধি হয়েছে এমন মাত্রায় যা অনেক গরীব ও মধ্যবিত্ত পরিবারের জন্য গ্রহণযোগ্য নয়। ঢাকার মিরপুর এলাকার ফল বিক্রেতা আব্দুল মতিন জানান, তার মা গেঁটে বাতসহ একাধিক রোগে আক্রান্ত। আগের তুলনায় এখন একই ওষুধের জন্য দেড় থেকে দুইগুণ খরচ করতে হচ্ছে। একে যদি চিকিৎসা ব্যয়ের সঙ্গে মিলিয়ে দেখা হয়, তাহলে সাধারণ মানুষের উপর এই চাপ বহনযোগ্য নয়। এর ফলে অনেকেই চিকিৎসা থেকে দূরে সরে যাচ্ছেন, যা রোগব্যাধির জটিলতা বৃদ্ধি এবং মৃত্যুর ঝুঁকি বাড়াচ্ছে।
ওষুধের বাজারে এই অবস্থা শুধু প্রতারণার কারণে নয়, সরকারের পর্যাপ্ত নজরদারি ও নিয়ন্ত্রণহীনতার ফল। কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) ভাইস-প্রেসিডেন্ট এস এম নাজের হোসাইন বলেন, “ওষুধখাতে এক ধরনের নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। এভাবে চলতে থাকলে সাধারণ মানুষের পক্ষে ওষুধ কিনে খাওয়া আরও কঠিন হয়ে পড়বে, যা জাতীয় স্বাস্থ্যকেও ক্ষতিগ্রস্ত করবে।” তিনি আরও বলেন, বাজারে ভেজাল ওষুধের প্রবেশ রোধে, সঠিক মান নিশ্চিত করতে এবং দাম নিয়ন্ত্রণে সরকারের কঠোর ভূমিকা থাকা প্রয়োজন।
অনেক সময় বাজারে নকল ওষুধের প্রবেশ বন্ধে আইনগত ও প্রশাসনিক ব্যবস্থা সঠিকভাবে কাজ করছে না বলেই অভিযোগ আছে। এর ফলে অবৈধ ওষুধকারখানাগুলো তৈরি করছে ভেজাল ওষুধ, যা রোগীর শরীরের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর হতে পারে। রোগীদের সঠিক ওষুধ গ্রহণে বাধা সৃষ্টি করা হচ্ছে, যা স্বাস্থ্যসেবার মূল উদ্দেশ্যের পরিপন্থী।
দেশের স্বাস্থ্য খাতের উন্নয়নে সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, চিকিৎসক, এবং সচেতন নাগরিকদেরও ভূমিকা রাখতে হবে। জনগণকে সচেতন করতে হবে যাতে তারা সঠিক ওষুধ কেনার ক্ষেত্রে সতর্ক থাকে এবং নকল বা অতিরিক্ত মূল্যবান ওষুধ থেকে বিরত থাকে। বিশেষ করে গ্রামীণ ও দূরবর্তী এলাকার মানুষদের জন্য এই তথ্যপ্রবাহ জরুরি, কারণ তারা অনেক সময় নকল ওষুধের ফাঁদে পড়ে থাকেন।
সরকার যদি ওষুধের বাজারে নিয়ন্ত্রণ ও নজরদারি বৃদ্ধি করতে পারে, তাহলে ভেজাল ওষুধের প্রবেশ রোধ করা সম্ভব হবে। পাশাপাশি ওষুধের দাম নির্ধারণে স্বচ্ছতা ও যৌক্তিকতা আনতে হবে। এর ফলে সাধারণ মানুষের চিকিৎসা খরচ কমানো সম্ভব হবে এবং দেশের সামগ্রিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থার মান উন্নত হবে।
সাধারণ মানুষের স্বাস্থ্য সুরক্ষায় সঠিক ওষুধ ও চিকিৎসার গুরুত্ব অপরিসীম। কিন্তু যদি ওষুধের বাজারে এমন অনিয়ম ও প্রতারণা চলতে থাকে, তাহলে দেশের স্বাস্থ্য খাতের সাফল্য অসম্ভব। এ জন্য প্রয়োজন কঠোর আইন প্রয়োগ, নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার কার্যকর বাস্তবায়ন, এবং জনগণের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি। এছাড়া, চিকিৎসকদের দায়িত্বও গুরুত্বপূর্ণ, কারণ তারা রোগীদের সঠিক ওষুধ সঠিক দামে প্রাপ্য করানোর ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখতে পারেন।
বাংলাদেশে ওষুধের বাজারে বর্তমান অবস্থা অত্যন্ত শঙ্কাজনক। ভেজাল ওষুধ বিক্রি, প্রতারণা, এবং মূল্যবৃদ্ধির কারণে সাধারণ মানুষের চিকিৎসা ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় তারা নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। সরকারের উচিত দ্রুত ব্যবস্থা নিয়ে ওষুধের বাজারকে স্বচ্ছ, নিরাপদ এবং সাশ্রয়ী করে তোলা, যাতে প্রত্যেক মানুষ সঠিক চিকিৎসা সুবিধা পেতে পারেন এবং দেশের স্বাস্থ্য খাত সুদৃঢ় হয়।
আপনার মতামত জানানঃ