পতিত স্বৈরশাসক শেখ হাসিনার সাড়ে ১৫ বছরের শাসনামলে সবচেয়ে বেশি লুণ্ঠনের শিকার হয়েছিল ব্যাংকিং খাত, যার কারণে ৬১টি ব্যাংকের মধ্যে ১১টি দেউলিয়া হওয়ার দ্বারপ্রান্তে উপনীত হয়েছিল। দেশে ৬১টি ব্যাংকের প্রয়োজন না থাকা সত্ত্বেও হাসিনার খামখেয়ালি সিদ্ধান্তে তাঁর আত্মীয়স্বজন, আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতা ও অলিগার্ক ব্যবসায়ী ও ‘রবার ব্যারনে’ পরিণত হওয়া লুটেরাদের পুঁজি লুণ্ঠনের অবিশ্বাস্য সুযোগ করে দেওয়ার জন্য এতগুলো ব্যাংকের লাইসেন্স দেওয়া হয়েছিল।
প্রয়াত অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বারবার আপত্তি জানানো সত্ত্বেও এমন খামখেয়ালি সিদ্ধান্ত থেকে হাসিনাকে নিবৃত্ত করা যায়নি। গত ৫ আগস্ট হাসিনার স্বৈরশাসনের উৎখাতের পর বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার ৮ আগস্ট রাষ্ট্রক্ষমতা গ্রহণ করার পর আহসান এইচ মনসুরকে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর হিসেবে নিয়োগ দেয়। গত ছয় মাসে একের পর এক সাহসী সিদ্ধান্ত নিয়ে তিনি ব্যাংকিং খাতকে গিরিখাতে পতনের কিনারা থেকে উদ্ধারের মিশন চালিয়ে যাচ্ছেন, যার ফলও আমরা অনুধাবন করতে পারছি।
১১টি ব্যাংকের মধ্যে চট্টগ্রামের ব্যাংক লুটেরা এস আলম কর্তৃক লুণ্ঠিত নিচে উল্লেখিত ৭টি ব্যাংক অন্তর্ভুক্ত ছিল: ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ, এসআইবিএল, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক, কমার্স ব্যাংক, এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংক ও আল-আরাফাহ্ ইসলামী ব্যাংক।
ইসলামী ব্যাংক ২০১৭ সাল পর্যন্ত প্রধানত জামায়াতে ইসলামী নিয়ন্ত্রিত ব্যাংক ছিল। ওই সময় ওটা ছিল দেশের প্রাইভেট সেক্টরের ব্যাংকগুলোর মধ্যে বৃহত্তম ব্যাংক। দেশে আসা রেমিট্যান্স প্রবাহের প্রায় ৩০ শতাংশ আসত ইসলামী ব্যাংকের মাধ্যমে। এ রকম একটা শক্তিশালী ব্যাংককে এস আলমের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসা হয় স্বৈরশাসক হাসিনার প্রত্যক্ষ নির্দেশনায় ও মদদে। ২০১৭ থেকে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট পর্যন্ত ৭ বছরে এস আলম বিভিন্ন কায়দায় ইসলামী ব্যাংক থেকে লুট করে নিয়েছেন প্রায় ৭০ হাজার কোটি টাকা, যার ফলে ব্যাংকটি দেউলিয়া হওয়ার দ্বারপ্রান্তে উপনীত হয়েছিল।
এস আলম তাঁর নিয়ন্ত্রণাধীন সাতটি ব্যাংক থেকে প্রায় দেড় লাখ কোটি টাকা লুটে নিয়ে বিদেশে পাচার করে দিয়েছেন। পতিত সরকারের ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী লুটে নিয়েছেন ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংককে।
পতিত হাসিনার উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানের মালিকানাধীন বেক্সিমকো গ্রুপের বিভিন্ন ব্যাংকে অনাদায়ি ঋণ ৫০ হাজার কোটি টাকার বেশি। উল্লিখিত ১১টি ব্যাংক কয়েক মাস ধরে আমানতকারীদের আমানত ফেরত দিতে পারছিল না, যেখান থেকে ধীরে ধীরে কয়েকটি ব্যাংক ঘুরে দাঁড়াতে সক্ষম হয়েছে। ইসলামী ব্যাংক ও ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংকের সাফল্যের কথা খোদ আহসান এইচ মনসুর ঘোষণা করেছেন।
শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটি হাসিনার শাসনামলের অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে ‘চামচা পুঁজিবাদ’ (ক্রোনি ক্যাপিটালিজম) থেকে সরাসরি ‘চোরতন্ত্রে’ (ক্লেপ্টোক্রেসি) রূপান্তরিত হওয়ার দাবি করেছেন। হাসিনা তাঁর স্বৈরাচারী শাসনামলে তাঁর পরিবার, আত্মীয়স্বজন, দলীয় নেতা-কর্মী, কতিপয় অলিগার্ক-ব্যবসায়ী এবং পুঁজি লুটেরাদের সঙ্গে নিয়ে সরকারি খাতের প্রকল্প থেকে লাখ লাখ কোটি টাকা লুণ্ঠনের প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা গড়ে তুলেছিলেন। এই পুঁজি লুণ্ঠনের কেন্দ্রে ছিল হাসিনার পরিবার, লুটেরা অলিগার্ক ব্যবসায়ী, হাজারো লুটেরা রাজনীতিবিদ ও দুর্নীতিবাজ আমলা।
শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির গবেষণায় উঠে এসেছে, স্বৈরশাসক হাসিনার সাড়ে ১৫ বছরের লুটপাটতন্ত্রের মাধ্যমে প্রতিবছর গড়ে ১৬ বিলিয়ন ডলার হিসাবে মোট ২৩৪ বিলিয়ন ডলার লুণ্ঠিত হয়ে দেশ থেকে বিদেশে পাচার হয়ে গেছে। সবচেয়ে বেশি লুণ্ঠনের শিকার হয়েছে ব্যাংকিং ও ফিন্যান্সিয়াল খাত, তারপর জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাত, তারপর রয়েছে ভৌত অবকাঠামো খাত এবং এরপর তথ্যপ্রযুক্তি খাত। সংযুক্ত আরব আমিরাত, কানাডা, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, হংকং, ভারত ও কয়েকটি ‘ট্যাক্স হেভেন’ দেশে সবচেয়ে বেশি অর্থ পাচারের সুবিধাভোগী হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে।
হাসিনার স্বৈরশাসন উৎখাতের পর মাত্র কয়েকজন ব্যতীত উল্লিখিত লুটেরা ও পুঁজি পাচারকারীদের প্রায় সবাই নানাভাবে বিদেশে পালিয়ে গেছেন। কয়েক লাখ টাকা থেকে শুরু করে কয়েক কোটি টাকার বিনিময়ে এই পলাতক লুটেরারা একেকজন দেশের আন্তর্জাতিক সীমানার নানা গোপন পথে বিজিবি-বিএসএফ এবং সংগঠিত চোরাকারবারি সিন্ডিকেটের মদদে প্রধানত ভারতে পাড়ি দিয়েছেন। কয়েক মাস অতিবাহিত হওয়ার পর এখন তাঁদের বেশির ভাগেরই সাময়িক অর্থসংকটে পড়ার আশঙ্কাকে উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
অতএব তাঁদের পরিবারের সদস্য ও আত্মীয়স্বজনের সহায়তায় বিদেশে অবস্থানের অর্থসংকট কাটানোর জন্য ওই সব দেশে আরও বেশি বৈদেশিক মুদ্রার সরবরাহ তাঁদের জন্য প্রয়োজন হওয়াই স্বাভাবিক। আমাদের সন্দেহ হচ্ছে, হঠাৎ রেমিট্যান্স ডলারের বাজারে চাহিদার বড় ধরনের স্ফীতির পেছনে ওপরে বর্ণিত ব্যাপারটাই প্রধান ভূমিকা রেখে চলেছিল। অতএব এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের কঠোর হওয়া ছাড়া বিকল্প দেখছি না। ইতিমধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক নির্দেশ জারি করেছে, ডলারপ্রতি ১২৩ টাকার বেশি দাম দেওয়া যাবে না।
ওই নির্দেশনায় বলা হয়, ২০২৫ সালের ১ জানুয়ারি থেকে রেমিট্যান্স ডলার ও রপ্তানি আয়ের ডলারের জন্য একই দাম প্রযোজ্য হবে, কেউ এর ব্যত্যয় ঘটালে জরিমানা দিতে হবে। বাংলাদেশ ব্যাংক বৈদেশিক মুদ্রার দাম নির্ধারণে ‘ক্রলিং পেগ’ নীতি পরিত্যাগ করে দিনে দুবার ডলারের দাম (ভিত্তিমূল্য) নির্ধারণ করে বাজারের ওপর ডলারের দামের ওঠানামাকে ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, যা গত ১২ জানুয়ারি থেকে কার্যকর হয়েছে।
আমি এ পদক্ষেপকে সঠিক মনে করছি। (একই সঙ্গে ৫ জানুয়ারি থেকে কিছু বড় লেনদেনের প্রতিবেদন প্রতিদিন বাংলাদেশ ব্যাংককে পাঠাতে হচ্ছে)। আমি এর সঙ্গে যোগ করতে চাই, শুধু জরিমানা নয়, আরও কঠোর পদক্ষেপ হিসেবে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের গ্রেপ্তার করা এবং প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্স বাতিলের মতো দৃষ্টান্তমূলক সাজা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলে এক্সচেঞ্জ হাউস ও ব্যাংকগুলোর টনক নড়বে।
মনে রাখতে হবে, গণ-অভ্যুত্থানের পরবর্তী কয়েক মাসে অর্থনীতি ‘মেল্টডাউন’ এড়াতে সক্ষম হয়েছে প্রধানত বৈধ চ্যানেলে রেমিট্যান্সের জোয়ার, রপ্তানির প্রবৃদ্ধি ও আমদানি ব্যয়ের স্থিতিশীলতার কারণে। দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের পতন থামিয়ে রিজার্ভকে আবার প্রবৃদ্ধির ধারায় ফেরানো গেছে।
গত ৫ আগস্ট গণ-অভ্যুত্থানে ক্ষমতা থেকে উৎখাত হওয়ার পর গত সাড়ে ছয় মাসে অর্থনীতিবিদদের কাছে প্রমাণিত হয়ে চলেছে যে স্বৈরশাসক হিসেবে ক্ষমতা না হারালেও অর্থনৈতিক মেল্টডাউনের অবশ্যম্ভাবী পরিণতি থেকে দেশের অর্থনীতিকে রক্ষা করতে পারতেন না হাসিনা। এদিক থেকে দেখলে মহান আল্লাহ তাআলাকে শুকরিয়া জানাতে হয় যে তিনি আমাদের আরেকটি শ্রীলঙ্কা হওয়ার লজ্জা থেকে রক্ষা করেছেন।
অন্তর্বর্তী সরকারের সময়োচিত নীতি পরিবর্তন ধীরে ধীরে অর্থনীতিতে আবার গতি সঞ্চার করতে শুরু করেছে। কিন্তু বিদেশে পাচার হওয়া ২৩৪ বিলিয়ন ডলার অর্থ আদৌ দেশে ফেরত আনা যাবে বলে আমি মনে করি না।
আপনার মতামত জানানঃ