ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর কুমিল্লা শহরতলির শাসনগাছা বাস টার্মিনালের চাঁদাবাজির নিয়ন্ত্রণ হাত বদল হয়েছে। আগে আওয়ামী লীগের সিন্ডিকেট টার্মিনাল নিয়ন্ত্রণ করত। এখন টার্মিনালের নিয়ন্ত্রণ বিএনপির হাতে। শুধু এখানে পরিবহন থেকে চাঁদা আদায়ই নয়, সরকারি অনুমোদনবিহীন ট্রান্সপোর্ট টার্মিনালে যুক্ত করেছে ওই সিন্ডিকেট।
পরিবহন নেতা, মালিক ও শ্রমিকরা বলছেন, আদর্শ সদর উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক রেজাউল কাইয়ুম ও তাঁর অনুসারীদের সিন্ডিকেট এখন টার্মিনাল নিয়ন্ত্রণ করছে। আগে ছিল মহানগর আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আহমেদ নিয়াজ পাভেলের সিন্ডিকেট। তবে এই দুই নেতাই টার্মিনালে চাঁদাবাজির সিন্ডিকেট গড়ার অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।
টার্মিনালে যানবাহনের চালকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এখান থেকে প্রতিদিন সিলেট রুটে কুমিল্লা ট্রান্সপোর্ট নামের ২৬টি বাস চলাচল করে। গাড়িপ্রতি ১ হাজার ১০০ টাকা আদায় করা হয়। এর মধ্যে গাড়িপ্রতি ১২০ টাকা দেওয়া হয় শ্রমিক ইউনিয়নকে। শ্রমিক ইউনিয়নের কুমিল্লা কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে পৌঁছায় তার অর্ধেক। বাকি অর্ধেক ৬০ টাকা শাসনগাছা বাসস্ট্যান্ডে শ্রমিক ইউনিয়ন শাখা অফিসে পৌঁছানোর কথা থাকলেও সরকার পতনের পর থেকে সেখানে পরিবহন শ্রমিক ইউনিয়নের কোনো শাখা বা কমিটি নেই। গাড়িপ্রতি সেই ৬০ টাকার পুরোটা চলে যাচ্ছে সিন্ডিকেটের পকেটে। পাপিয়া ট্রান্সপোর্টের ৫২টি, ২০টি রয়েল কোচ, ২০টি জনতা, ৩৫টি সততা, ৩৫টি একতা, ২৬টি লাব্বাইক, ৩৫টি সুগন্ধা, ৪০টি এশিয়া, ৩৫টি ফারহানা, ৩৫টি ফারজানা-১ এবং ২০টি ফারজানা-২ বাস যাতায়াত করে আন্তঃজেলা ও জেলার আঞ্চলিক বিভিন্ন সড়কে। টার্মিনাল-সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, প্রতিদিন এ টার্মিনাল থেকে ১২টি ট্রান্সপোর্টের ৩৮৫টি বাস চলাচল করে। এসব গাড়ি থেকে সিন্ডিকেট বিভিন্ন অঙ্কে প্রতিদিন বিপুল পরিমাণ চাঁদা আদায় করে। প্রতিদিন সন্ধ্যায় সিন্ডিকেট বিভিন্ন খাতে চাঁদার টাকা ভাগ করে নেয়।
একাধিক সূত্র জানায়, শ্রমিক ইউনিয়নের বাইরেও জেলা বাস মালিক সমিতির নামে বিভিন্ন অজুহাতে মোটা অঙ্কের চাঁদা আদায় হয়। বাস মালিক সমিতির শীর্ষ নেতারা আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে জড়িত। তারা এখন বিএনপির ওই সিন্ডিকেটের কাছে কোণঠাসা হয়ে প্রতিবাদ করার সাহস পাচ্ছেন না। আগে মহানগর আওয়ামী লীগ নেতা নিয়াজ পাভেলের সিন্ডিকেট টার্মিনাল নিয়ন্ত্রণ করত। তবে পাভেল এ অভিযোগ অস্বীকার করে বলেছেন, ‘গত ১৫ বছরে এ টার্মিনাল থেকে আমি এক টাকাও নিয়েছি বলে পরিবহন নেতারা বলতে পারবেন না। এমন অভিযোগ কখনও কেউ করেনি। এখন কেন এসব অভিযোগ উঠছে।’
পরিবহন-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ১২টি ট্রান্সপোর্ট থেকে চাঁদা আদায়ের জন্য নতুন সিন্ডিকেট প্রতিটি কাউন্টারে অতিরিক্ত আরও তিন-চারজন করে পছন্দের লোক নিয়োগ দিয়ে কৌশলে চাঁদার টাকা লুটে নিচ্ছে। নাম না প্রকাশের শর্তে এক কাউন্টার ম্যানেজার বলেন, শুধু মুখগুলো বদলেছে। চাঁদাবাজি বন্ধ হয়নি।
পরিবহন মালিক সমিতির কুমিল্লার সভাপতি অধ্যক্ষ কবির আহমেদ বলেন, পরিবহন খাতে কোনো নীতিমালা না থাকায় চাঁদাবাজি নিয়মে পরিণত হয়েছে। আমরা বিভিন্ন সময় সরকারের কাছে চাঁদাবাজি বন্ধের দাবি জানিয়ে এলেও কোনো প্রতিকার মেলেনি।
অভিযোগ প্রসঙ্গে বিএনপি নেতা রেজাউল কাইয়ুম বলেন, ‘আমার বিরুদ্ধে যে অভিযোগ আনা হয়েছে, এগুলো সঠিক নয়। আমার সেখানে কোনো বাসও নেই। ট্রান্সপোর্ট মালিকদের সঙ্গে কথা বলে দেখতে পারেন। একটি চক্র এসব অপপ্রচার চালাচ্ছে।’
কুমিল্লা দক্ষিণ জেলা বিএনপির আহ্বায়ক হাজি আমিন উর রশিদ ইয়াছিন বলেন, ‘কিছুদিন আগে রেজাউলের বিরুদ্ধে টার্মিনাল থেকে চাঁদা নেওয়ার অভিযোগ আমার কাছে এসেছিল। আমি তাকে এসব বিষয়ে জিজ্ঞেস করেছিলাম, সে সব অস্বীকার করেছে। অভিযোগগুলো সত্য হলে আমরা দলীয়ভাবে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেব।’
বিআরটিএর কুমিল্লার সহকারী পরিচালক মো. ফারুক আলম বলেন, শাসনগাছা বাস টার্মিনাল থেকে অনুমোদনহীন ট্রান্সপোর্টের গাড়ি চলাচল বন্ধে নিয়মিত অভিযান চালানো হচ্ছে। চাঁদা আদায়ের বিষয়ে কেউ অভিযোগ করলে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার মাধ্যমে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
আপনার মতামত জানানঃ