বাংলাদেশ ব্যাংকের আইটি কনসালটেন্ট হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল রাকেশ আস্থানাকে। ভারতের এই নাগরিক আইটি ডিরেক্টর হিসেবে কাজ করেছেন বিশ্বব্যাংকে। তাকে নিয়োগ দেওয়ার ক্ষেত্রে মানা হয়নি বাংলাদেশ ব্যাংকের কোন প্রকার নীয়মনীতি।
অথচ ভারতীয় এই নাগরিককে কার সুপারিশে বাংলাদেশ ব্যাংকের আইটি সেক্টরে বিশেষজ্ঞ হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়? এ নিয়ে যখন গণমাধ্যমে তোলপাড় চলছিল, তখন বাংলাদেশ ব্যাংক হঠাৎ করে অন্য সুর তুলেছিল। তাদের দাবি, রাকেশ আস্তানা শুধু কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আইটি বিভাগের পরামর্শক। অথচ রাকেশ আস্তানার সরবরাহকৃত নতুন সফটওয়্যার ইনস্টলের আদেশ এবং একই সঙ্গে তাকেই পরামর্শক নিয়োগের সময় বাংলাদেশ ব্যাংকের কয়েকজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বিক্ষুব্ধ হন বলে জানা গেছে। তারা রাকেশের সফটওয়্যারের কারণে নিরাপত্তার পরিবর্তে দেশের আর্থিক খাত নতুন করে নিরাপত্তা ঝুঁকিতে পড়তে পারে বলে আশংকা প্রকাশ করেছিলেন।
আইটি কনসালটেন্ট হিসেবে নিয়োগ পাওয়া রাকেশ আস্থানাকে নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে একেক সময়ে একেক রকম বক্তব্য দেয়া হয়। একবার বাংলাদেশ ব্যাংক জানায়, বাংলাদেশ ব্যাংকের অর্থ চুরির ঘটনায় আইটির বিষয়টি তদন্ত করছেন না রাকেশ আস্থানা। আইটি দলের সহযোগিতায় তাকে এ কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে।
সূত্র জানায়, ২০১৬ সালের ৭ মার্চ ঢাকার বনানীর একটি অভিজাত রেস্তোরাঁয় রাকেশ আস্থানার সঙ্গে একান্তে বৈঠক করেন বাংলাদেশ ব্যাংকের তখনকার গভর্নর ড. আতিউর রহমান। তারপরদিনই তাকে দেখা যায় বাংলাদেশ ব্যাংকে।
এর আগে বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, হ্যাকিংয়ের মাধ্যমে চুরি হওয়া অর্থ ফেরত পেতে বিশ্বব্যাংকের দীর্ঘ অভিজ্ঞতা সম্পন্ন একজন সাইবার বিশেষজ্ঞ পরামর্শক ও তার Forensic Investigation টিম বাংলাদেশ ব্যাংকের টীমের সাথে কাজ করছেন।
বাংলাদেশের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারি বাহিনী পুলিশ ও র্যাবে আইটি এক্সপার্ট হিসেবে বাংলাদেশীরাই রয়েছে। এর বাইরেও বুয়েটসহ বেশ কিছু আন্তর্জাতিকমানের বিশ্ববিদ্যালয় আছে যেখানে আইটি এক্সপার্ট রয়েছে। বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠিত অনেক আইটি ফার্মেও অভিজ্ঞতা সম্পন্ন ব্যক্তি রয়েছে। হঠাৎ করেই একজন ভারতীয় নাগরিককে আইটি কনসালটেন্ট হিসেবে নিয়োগ দেওয়ায় বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তাদের মাঝেও প্রশ্ন দেখা দিয়েছিল।
এ সময় বাংলাদেশ ব্যাংকের সকল কম্পিউটারেই একটি বিশেষ সফটওয়্যার ইনস্টল করার নির্দেশনা দেওয়া হয়। সফটওয়্যারটি রাকেশ আস্থানার তৈরি। এ নিয়ে ক্ষোভ দেখা দেয় খোদ বাংলাদেশ ব্যাংকের আইটি খাত রক্ষণাবেক্ষণ ও পরিচালনাকারী কর্মকর্তাদের মধ্যে।
এরপর ৮ মার্চ বাংলাদেশ ব্যাংকে এসে প্রথম দিনই কাজ শুরু করেন রাকেশ আস্থানার টিম। প্রথম দিনে বাংলাদেশ ব্যাংকের সকল ফ্লোরের ইন্টারনেট পয়েন্ট লাইন চেক করে। কোন পয়েন্টে ইন্টানেটের স্পিড কত তা লিপিবদ্ধ করা হয়। এসময় টুকে নেওয়া হয় প্রতিটি পয়েন্টের আইপি এড্রেস ও সিরিয়াল নম্বর।
নিয়োগ বিষয়ে বিশ্বব্যাংকের সাবেক এই আইটি ডিরেক্টর রাকেশ আস্থানা তখন জানান, হ্যাকিংয়ের ওই ঘটনা সংঘটিত হওয়ায় তাকে নিয়োগ দেওয়া হয়। বাংলাদেশ ব্যাংক জানায়, বৈদেশিক মুদ্রা চুরির ঘটনার আইটি ও সাইবার বিষয়ের তদন্ত তিনিই করছেন। তার নেতৃত্বে একটি ফরেনসিক ইনভেস্টিগেশন টিম কাজ করছে বলেও জানানো হয়।
রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের আইটি ছিল ভারতের দখলে
ইনকিলাবের ২০২০ সালের ১৭ জুলাই প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ব্যাংকগুলো ৪/৫ গুণ বেশি দাম দিয়ে ভারতীয় কোম্পানির কাছ থেকে সফটওয়্যার কিনছে। সরকারি ব্যাংকগুলোর কিছু অসাধু কর্মকর্তার একটি সিন্ডিকেট নিজেদের স্বার্থ হাসিলে ভারতীয় সফটওয়্যার কোম্পানির পক্ষে কাজ করছে। এতে বছরে শুধু ব্যাংক খাত থেকেই ৫০০ কোটি টাকার বেশি বিদেশে চলে যাচ্ছে। সব মিলিয়ে প্রতি বছর কয়েক হাজার কোটি টাকা দেশের বাইরে চলে যাচ্ছে। পাশাপাশি দেশের ব্যাংকিং খাতসহ সকল অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের তথ্য চলে যাচ্ছে ভারতের কাছে, যা দেশের জন্য হুমকিস্বরূপ। এছাড়া কর্মসংস্থানও যাচ্ছে ভারতের দখলে।
দেশে তখন ৬২টি ব্যাংকের মধ্যে ৬০ শতাংশেই বিদেশি কোর ব্যাংকিং সফটওয়্যার ব্যবহৃত হতো। দেশি সফটওয়্যার ব্যবহৃত হতো বাকি ৪০ শতাংশ ব্যাংকে। দীর্ঘদিন ধরেই ব্যাংকসহ সরকারি কেনাকাটায় দেশি সফটওয়্যারের ব্যবহারকে আরো বেশি প্রাধান্য দেয়ার দাবি জানানো হচ্ছে। ২০১৯ সালের ১৭ এপ্রিল অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ থেকে যুগ্ম সচিব মো. রিজওয়ানুল হুদা স্বাক্ষরিত এক নির্দেশনায় বাংলাদেশ ব্যাংকের মাধ্যমে দেশের রাষ্ট্র মালিকানাধীন ব্যাংকগুলোকে দেশীয় কোর ব্যাংকিং সফটওয়্যার ব্যবহারের নির্দেশ দেয়া হয়, যা পরবর্তীতে আবার ওই বছরের ১০ জুলাই রাষ্ট্র মালিকানাধীন ব্যাংকগুলোকে নির্দেশ দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। বাস্তবায়নে সোনালী, জনতা, অগ্রণী, রূপালী ব্যাংকসহ সিইও ও ব্যবস্থাপনা পরিচালককে নির্দেশনাটি দেয়া হয়। এই নির্দেশনা প্রতিপালনের মাধ্যমে দেশে নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং বৈদেশিক মুদ্রার অপচয় রোধ করা সম্ভব হবে বলে আশা করা হয়।
অথচ ওই নির্দেশের পর এক বছর অতিবাহিত হলেও কৃষি ব্যাংক ছাড়া কেউই এই নির্দেশ এখনো বাস্তবায়ন করেনি। এটিকে গোড়ায় গলদ বলছেন খাত সংশ্লিষ্ট অনেকেই। কারণ নির্দেশনা প্রদানকারী বাংলাদেশ ব্যাংকের আইটি খাতও ভারতীয় নাগরিক রাকেশ আস্তানার প্রতিষ্ঠানের দখলে ছিল।
আপনার মতামত জানানঃ