বাংলাদেশে চাহিদার চেয়ে বিদ্যুৎকেন্দ্র বেশি স্থাপন করা হয়েছে। বিদ্যুৎ ঘাটতির দেশ বিদ্যুতে উদ্বৃত্ত থাকায় দেশে বিদ্যুতের দাম সহনীয় পর্যায়ে আসার কথা থাকলেও তা না হয়ে অন্যান্য পণ্যদ্রব্যের চেয়েও বেশি গতিতে বাড়ছে দাম। দেশে বিদ্যুতের উদ্বৃত্তি থাকা সত্বেও কেন বিদ্যুতের দাম বেশি? এবিষয়ে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, দেশে বিদ্যুৎ ব্যবস্থায় সমন্বয়হীনতার কারণে বিদ্যুতের দাম বেড়েছে। চাহিদার চেয়ে বিদ্যুৎকেন্দ্র বেশি স্থাপন করার কারণে দেশে মাত্র ৪০ শতাংশ বিদ্যুৎ ব্যবহার করা হয় আর বাকি ৬০ শতাংশ বিদ্যুৎকেন্দ্র অলস বসিয়ে রেখে কেন্দ্র ভাড়া দেওয়া হয়। এ কারণে বাংলাদেশে বিদ্যুতে ভর্তুকির পরিমাণ বাড়ছে। চাহিদার চেয়ে অনেক বেশি বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা (ওভারক্যাপাসিটি) তৈরি হওয়ায় সরকারের বিপুল আর্থিক ক্ষতি হচ্ছে। ভবিষ্যতে এ পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন সংশ্লিষ্টরা।
একটি আন্তর্জাতিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান এ বিষয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে গতকাল বুধবার। বাংলাদেশের বিদ্যুৎ খাতের প্রকৃত চাহিদা পুনরায় নিরুপণ করার সুপারিশ করেছে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক এ সংস্থাটি, তার আগে নতুন বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করা অর্থনীতির জন্য ভাল হবে না বলে মত দিয়েছে তারা।
যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ইনস্টিটিউট ফর এনার্জি ইকোনোমিকস ফাইনান্সিয়াল অ্যানালিসিস (আইইইএফএ) বিদ্যুৎ ও জ্বালানি বিষয়ক গবেষণা করে থাকে। গত বুধবার ‘বাংলাদেশেজ পাওয়ার সিস্টেম ওভারক্যাপাসিটি প্রবলেম ইজ গেটিং ওরস’ শিরোনামে প্রতিবেদনটি প্রকাশ করে আইইইএফএ। তাদের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) প্রকাশিত বার্ষিক প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী ২০১৯-২০ অর্থবছরে দেশের স্থাপিত বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতার (ইনস্টলড ক্যাপাসিটি) মাত্র ৪০ শতাংশ ব্যবহার হয়েছে, যা এক বছর আগেও ছিল ৪৩ শতাংশ। অর্থাৎ ৬০ শতাংশ বিদ্যুৎকেন্দ্র অলস বসে আছে। স্পষ্টতই ওভার ক্যাপাসিটি বাড়ছে। এর ফলে ২০১৯-২০ অর্থবছরে পিডিবিকে সরকারের প্রায় ৭ হাজার ৫০০ কোটি টাকা (৮৮০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার) ভর্তুকি দিতে হয়েছে।
আইইইএফএর প্রতিবেদনটি লিখেছেন জ্বালানি খাতে অর্থায়ন বিশ্লেষক সাইমন নিকোলাস। তিনি বলেন, আগামী পাঁচ বছরে নতুন যেসব বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের পরিকল্পনা রয়েছে, সেগুলো যোগ হলে পরিস্থিতি আরও খারাপের দিকে যাবে। ২০২৫ সাল নাগাদ আরও ২১ হাজার মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন বিদ্যুৎকেন্দ্র চালু হবে। এই সময়ে মাত্র সাড়ে ৫ হাজার মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন বিদ্যুৎকেন্দ্র অবসরে যাবে। এতে স্থাপিত সক্ষমতার ব্যবহার ৪০ শতাংশেরও নিচে নেমে যাবে যদি না বিদ্যুতের চাহিদা অনেক বেশি বাড়ে।
প্রতিবেদনটিতে আরও বলা হয়, বাংলাদেশের অর্থনীতিতে কোভিড-১৯ মহামারীর প্রভাবে ২০১৯-২০ অর্থবছরে বিদ্যুৎ উৎপাদনের প্রবৃদ্ধি ছিল মাত্র ১ দশমিক ২৬ শতাংশ। আগামী ৫ বছর ধরে যদি বিদ্যুৎ উৎপাদনের প্রবৃদ্ধি ১০ শতাংশের ওপরে না থাকে, তবে স্থাপিত সক্ষমতার ব্যবহার (ক্যাপাসিটি ইউটিলাইজেশন) ৪০ শতাংশেরও নিচে নেমে যাবে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, ওভারক্যাপাসিটির বিরূপ প্রভাব পড়বে পিডিবির আর্থিক অবস্থা এবং বিদ্যুতের দামের ওপর। পিডিবির নিজস্ব বিদ্যুৎকেন্দ্র ছাড়া বেসরকারি ও সরকারি কোম্পানির বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর বিদ্যুৎ কেনার স্বল্প (রেন্টাল) ও দীর্ঘমেয়াদি (আইপিপি বা ইন্ডিপেডেন্ট পাওয়ার প্রডিউসার) চুক্তি (পাওয়ার পারচেজিং এগ্রিমেন্ট) থাকে। এসব কেন্দ্রগুলোতে ব্যবহৃত তেল, গ্যাস, কয়লা বা জ্বালানির মূল্য দেয় পিডিবি, দেওয়া হয় বিদ্যুতের দাম, সারা বছর কেন্দ্র রক্ষণাবেক্ষণের জন্য প্রতি ইউনিট অর্থ বরাদ্দ থাকে। এছাড়া কেন্দ্রটির একটি ভাড়া দেওয়া হয় যা ক্যাপাসিটি পেমেন্ট নামে পরিচিত। যখন কোনো কেন্দ্র থেকে সরকার বিদ্যুৎ নেয় না তখন জ্বালানি ও বিদ্যুতের দাম দেওয়া বন্ধ থাকে কিন্তু ক্যাপাসিটি চার্জ বা কেন্দ্র ভাড়া ও রক্ষণাবেক্ষণের অর্থ ঠিকই পরিশোধ করতে হয়। একটি ১০০ মেগাওয়াটের কেন্দ্রকে বছরে শুধু কেন্দ্র ভাড়াই দিতে হয় প্রায় ৯০ কোটি টাকা। সে কারণে বিদ্যুতের প্রয়োজন না থাকলে কেন্দ্র অলস বসে থাকলে বিপুল পরিমাণ অর্থ সরকারের লোকসান হয়। এর ফলে বছর শেষে পিডিবির আর্থিক ক্ষতি পোষাতে সরকারকে বিপুল অঙ্কের টাকা ভর্তুকি দিতে হয়। এতে খুচরা পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর প্রয়োজন হয়। আর নতুন আইনের ফলে বাংলাদেশে এখন থেকে বছরে একাধিকবার বিদ্যুতের দাম বাড়ানো সম্ভব।
আওয়ামী লীগ প্রথমবার ক্ষমতায় আসার পর থেকেই বিদ্যুৎ উৎপাদনে সক্ষমতা বৃদ্ধি করা ছিল দলটির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ প্রতিশ্রুতি। চলমান অর্থবছরের বাজেট ঘোষণার সময় বলা হয়েছিল ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশে ৬০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করার পরিকল্পনা হাতে নিয়ে এগুচ্ছে। ২০০৯ সাল থেকে গত বছরের জুলাই পর্যন্ত ১১১ টি নতুন বিদ্যুৎকেন্দ্র করা হয়েছে। বাংলাদেশ এখন চাহিদার তুলনায় দ্বিগুণ বিদ্যুৎ উৎপাদনে সক্ষম।
পিডিবির ওয়েবসাইটে দেওয়া তথ্য অনুসারে, জানুয়ারিতে দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদনের স্থাপিত ক্ষমতা (ইনস্টলড ক্যাপাসিটি) ২১২৩৯ মেগাওয়াট এবং ডিরেটেড ক্যাপাসিটি ২০৭৪৮ মেগাওয়াট। এর বিপরীতে গত ১৮ জানুয়ারি দিনের পিক আওয়ারে বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়েছে ৭৭৫৮ মেগাওয়াট ও সন্ধ্যার পিক আওয়ারে ৯২৯৭ মেগাওয়াট। তবে ওভারক্যাপাসিটি দেশের বিদ্যুৎখাতে শেষ সমস্যা নয় বলে মন্তব্য করেছে আইইইএফএ।
প্রতিবেদনে বলা হয়, ভবিষ্যতে আমদানীকৃত ব্যয়বহুল কয়লা এবং এলএনজি ইউনিট প্রতি তাপবিদ্যুতের দাম বাড়াবে। বেশি দামের কারণে ইতিমধ্যে গতবছর বাংলাদেশ এলএনজির একাধিক টেন্ডার বাতিল করেছে। ভবিষ্যতে এই উদ্বেগ আরও বাড়তে পারে কারণ ২০২১ এর শুরুতে এশিয়ান এলএনজির দাম রেকর্ড সর্বোচ্চ হয়েছে।
এছাড়া, পিডিবির তথ্য অনুসারে, চলতি বছরের শেষে এক হাজার মেগাওয়াট নতুন, ব্যয়বহুল তেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র গ্রিডে সংযুক্ত হতে পারে, যারা আমদানীকৃত কয়লা ও এলএনজির পাশাপাশি পিডিবির ওপর আর্থিক চাপ সৃষ্টি করবে।
সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, বাংলাদেশে প্রয়োজনের তুলনায় বিদ্যুতের স্থাপিত ক্ষমতা অনেক বেশি, সে কারণে বিদ্যুতে যে ভর্তুকি সরকার দিচ্ছে তা বেসরকারি কোম্পানির মালিকদের পকেটে চলে যাচ্ছে। তারা বলেন, আইইইএফএ নতুন কিছু বলেনি, এটি আমরা অনেকদিন ধরেই বলে আসছি। এখন দরকার গোটা বিদ্যুৎ খাতের পুনঃমূল্যায়ন। বাস্তবে বাংলাদেশের কতটুকু বিদ্যুৎ দরকার সেটা আগে নির্ধারণ করা দরকার। তা না হলে বিদ্যুৎ খাতের এই লোকসান গোটা বাংলাদেশের অর্থনীতিতে বিরুপ প্রভাব ফেলবে বলে মনে করেন তারা।
এসডব্লিউ/ডিআর/কেএইচ/১৪২০
আপনার মতামত জানানঃ