সরকার পতনের পর থেকে আওয়ামী লীগের শীর্ষ থেকে শুরু করে তৃণমূলের নেতাকর্মীরা এক অর্থে উধাও হয়ে গেছেন। আত্মগোপনে থেকে সম্পাদকমণ্ডলীর এক নেতা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেছেন, “আগে বাঁচা মরা, পরে রাজনীতি।” এ যেন আকাশ থেকে মাটিতে পতন! অথচ দুই মাস আগেও রাজনীতিতে ছিল দলটির ছিল একচেটিয়া দাপট।
ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত হয় আওয়ামী লীগ। প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করে দেশ ছাড়েন দলটির সভাপতি শেখ হাসিনা। এরপর থেকে আত্মগোপনে দলটির কেন্দ্র থেকে তৃণমূলের নেতারা। দেশজুড়ে শেখ হাসিনা ও নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে একের পর এক মামলা হচ্ছে।
প্রবল গণ আন্দোলনে ক্ষমতা হারিয়ে ভারতে চলে যাওয়া শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে একের পর এক হত্যা মামলা, মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে তার ও দল হিসেবে আওয়ামী লীগের বিচারের উদ্যোগ, সদ্য সাবেক হয়ে যাওয়া মন্ত্রী-সংসদ সদস্যদের রিমান্ডে নেওয়া, আদালতে আইনজীবী পর্যন্ত নিয়োগ করতে না পারা, এমন সব ঘটনা এখন ঘটছে।
টানা সাড়ে ১৫ বছর ক্ষমতায় থাকার পর সরকারি চাকরিতে কোটা নিয়ে ৩৬ দিনের এক আন্দোলনে পতন ঘটেছে আওয়ামী লীগ সরকারের। সব মিলিয়ে বিপর্যয়ে পড়ে গেছে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর সবচেয়ে বেশি সময় ক্ষমতায় থাকা দলটি।
প্রথমবারের মত আন্দোলন মোকাবিলা করতে ব্যর্থ হওয়া দলটির আত্মগোপনে থাকা শীর্ষ নেতারা তৃণমূল পর্যায়ের নেতাকর্মীদের কাছে কোনো দিক নির্দেশনাও পাঠাননি
এরই মধ্যে বেশ কয়েকজন হেভিওয়েট নেতাকে গ্রেফতারও করা হয়েছে। নেতাদের পক্ষে আদালতে আইনজীবীও মিলছে না। নেই কোনো দলীয় রাজনৈতিক কর্মসূচি। প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্যে করণীয় কোনো নির্দেশনা না পাচ্ছেন না বলে দলটির তৃণমূল নেতাকর্মীরা। এমন অবস্থায় প্রশ্ন উঠেছে- আওয়ামী লীগের ভবিষ্যৎ কী? আগামীর রাজনীতিতে তারা কীভাবে কী করবে?
নাম প্রকাশ না করার শর্তে দলটির তৃণমূলের কয়েকজন নেতা ডেইলি বাংলাদেশকে বলেন, সরকার পতন হওয়ার পর থেকে আমরা আতংকে রয়েছি। যে কোনো মুহূর্তে আমাদের ওপর হামলা-মামলা হতে পারে। দলের এই করুণ পরিস্থিতিতে কেন্দ্রীয় কোনো নির্দেশনাও পাচ্ছি না। যারা দলের নাম ভাঙিয়ে অর্থ-সম্পদ অর্জন করেছেন, তারা পালিয়ে গেছেন। আমরা কোথায় যাব?
টানা সাড়ে ১৫ বছর রাষ্ট্র শাসন করেও বর্তমানে চরম অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে দলটি। দেশের প্রাচীনতম দলটি ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার মাত্র ২০ দিনের মধ্যেই যেন হাওয়ায় মিলে গেছে। কোথাও কোনো পর্যায়ের নেতাকর্মীকে দেখা যাচ্ছে না। নেই কোনো কর্মসূচি। পরিষ্কারভাবে বর্তমানে রাজনীতিতে একটা কঠিন সময় পার করছে আওয়ামী লীগ। এরই মধ্যে দলটিকে নিষিদ্ধ ও নিবন্ধন বাতিলের দাবিতে রাজপথে সোচ্চার বিভিন্ন রাজনৈতিক সংগঠন। আওয়ামী লীগের নিবন্ধন বাতিলের বিষয়টি আদালত পর্যন্ত গড়িয়েছে।
আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ ও নিবন্ধন বাতিল চেয়ে হাইকোর্টে রিট করেছেন মানবাধিকার সংগঠন সারডা সোসাইটির পক্ষে নির্বাহী পরিচালক আরিফুর রহমান মুরাদ ভূঁইয়া। সব মিলিয়ে কঠিন এক দুঃসময় পার করছে দলটি।
এর আগে, গত ২৩ জুন দলের ৭৫তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর হিরকজয়ন্তীও পালন করেছে দলটি। জাঁকজমকপূর্ণ প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী পালনকালে সর্বত্র আধিপত্য বিস্তার করেন নেতাকর্মীরা। ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হওয়ার পর পুরো দৃশ্যপট পাল্টে যায়। দলটির সব পর্যায়ের নেতাকর্মী এখন পলাতক। কেউই এগিয়ে এসে দলের হাল ধরছেন না। পঁচাত্তরের আগে-পরেও আওয়ামী লীগ অনেক দুঃসময় পার করেছে। তবে কখনো নেতৃত্বের সংকট হয়নি দলটিতে।
রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ক্ষমতায় থাকাকালীন আওয়ামী লীগ দল ও সরকারের মধ্যে তফাৎ তৈরি করতে পারেনি। সরকারে বিলীন হয়ে যায় আওয়ামী লীগ। টানা ক্ষমতায় থাকায় সুযোগ-সুবিধা নেয়াই ছিল দলটির নেতাকর্মীদের প্রধান লক্ষ্য। দলের অভ্যন্তরে স্বার্থের দ্বন্দ্বে বিভক্তি বেড়ে যায়। ক্রমন্বয়ে দলটির নেতাকর্মীরা জনগণ থেকে দূরে সরে যায়। দায়িত্বশীল নেতারা আওয়ামী লীগের ভবিষ্যৎ নিয়ে তখন চিন্তা করেননি। ক্ষমতায় থেকে যে নির্বাচনগুলো আওয়ামী লীগ করেছে, তা নিয়ে বিস্তর বিতর্ক ছিল। শেখ হাসিনা সরকার এমন অনেক কাজ করেছে যা আওয়ামী লীগের ইতিহাস-ঐতিহ্যের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ ছিল না।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে আওয়ামী লীগের একজন কেন্দ্রীয় নেতা ডেইলি বাংলাদেশকে বলেন, কোটা সংস্কার আন্দোলনের শুরু থেকেই দূরদর্শী সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি দল। কোটা আন্দোলন ঘিরে পরিস্থিতি এত দ্রুত বদলাবে এটাও আমরা ভাবিনি।
তিনি বলেন, আন্দোলন ঘিরে শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করে দেশ ছাড়বেন- এটা ঘুণাক্ষরেও টের পায়নি দলের কেউ। তবে আওয়ামী লীগ দীর্ঘ সময় নানা প্রতিকূলতা পাড়ি দিয়েছে। নতুন করে এখন দুঃসময়ে পড়েছে দল। এখন সঠিক দিকনির্দেশনার জন্যে অপেক্ষা করা ছাড়া আমাদের আরও কোনো পথ নেই।
আপনার মতামত জানানঃ