রানা দাশগুপ্ত। বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক ও মানবতাবিরোধী আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের প্রসিকিউটর। দুর্গোৎসব সামনে রেখে বাংলাদেশের সংখ্যালঘুদের অবস্থা নিয়ে প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেন এই আইনজীবী। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সোহরাব হাসান।
প্রথম আলো: করোনাকালে বাংলাদেশের সংখ্যালঘুরা কেমন আছে?
রানা দাশগুপ্ত: সংখ্যালঘুরা ভেবেছিল করোনাকালে এ দেশের সমাজ বহুলাংশে মানবিক হবে। কিন্তু বাস্তবতায় খুব একটা পরিবর্তন হয়নি। যা ছিল তা-ই আছে, কোনো কোনো ক্ষেত্রে পিছিয়ে গেছে। একদিকে মহামারির আতঙ্ক, অন্যদিকে বাস্তব পরিস্থিতির শঙ্কা। সবটা মিলে বলতে হয়, করোনাকালে বাংলাদেশের ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুরা তেমন ভালো নেই।
প্রথম আলো: হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ প্রতিষ্ঠার পটভূমি কী ছিল, আপনাদের আন্দোলন সফল না ব্যর্থ?
রানা দাশগুপ্ত: সেনাশাসক জেনারেল জিয়াউর রহমান ১৯৭৭ সালে সামরিক ফরমানবলে ১৯৭৭ সালের ৪ নভেম্বর গৃহীত গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানকে ধর্মীয় মোড়কে আবৃত করেন। এরই ধারাবাহিকতায় আরেক সেনাশাসক জেনারেল এরশাদ ধর্মের ভিত্তিতে ঐক্যবদ্ধ বাঙালি জাতিসত্তার পরিচয় মুছে দিতে ১৯৮৮ সালে রাষ্ট্রধর্ম ঘোষণা করেন। এর প্রতিবাদে-প্রতিরোধে গণতান্ত্রিক নিয়মতান্ত্রিক পন্থায় মানবাধিকারের আন্দোলন গড়ে তোলার উদ্দেশ্যে বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ গঠিত হয়। এ আন্দোলনের লক্ষ্য ছিল রাষ্ট্রীয়-রাজনৈতিক সাম্প্রদায়িক আগ্রাসন ঠেকানো এবং সংখ্যালঘুদের রাজনৈতিক অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামকে এগিয়ে নেওয়া। সেই প্রেক্ষাপটে বলব, আমাদের আন্দোলন ব্যর্থ নয়। তবে অধিকতর সফলতা পেতে হলে ১৯৭২ সালের সংবিধান পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে হবে।
প্রথম আলো: সম্প্রতি ঐক্য পরিষদের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে যেসব সাম্প্রদায়িক হামলা ও জবরদখলের ঘটনা উল্লেখ আছে, তার সঙ্গে আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মীরা জড়িত। কোনো প্রতিকার পেয়েছেন কি?
রানা দাশগুপ্ত: দু-একটি ঘটনার ক্ষেত্রে দেখেছি, তবে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে নয়।
প্রথম আলো: হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য ফ্রন্ট নামে একই দাবিতে আরেকটি সংগঠন গড়ে উঠেছে, যারা বিএনপির সমর্থক বলে পরিচিত। তাহলে আপনারাও কি আওয়ামী লীগ ও বিএনপি এ দুই শিবিরে ভাগ হয়ে গেলেন?
রানা দাশগুপ্ত: বিএনপি যখন ক্ষমতায় ১৯৯১ সালের দিকে, তখন আমরা তৎকালীন সরকারি দলের ছত্রচ্ছায়ায় ঐক্য ফ্রন্ট গঠিত হতে দেখেছি। তবে হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের জন্মের সঙ্গে আওয়ামী লীগ বা কোনো রাজনৈতিক দলের অবস্থান ছিল না, এখনো নেই। ঐক্য পরিষদ কোনো রাজনৈতিক দলের অংশ বা সহযোগী সংগঠন নয় বলে স্বাধীনভাবে সংখ্যালঘুদের স্বার্থ ও অধিকার নিশ্চিত করতে সব ধরনের অন্যায়, অবিচার ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে লড়াই করে আসছে। ঐক্য ফ্রন্টও যদি নির্মোহভাবে সংখ্যালঘুদের স্বার্থ ও অধিকার রক্ষায় কাজ করে, তাতে অসুবিধার কিছু দেখি না। তাদেরও উচিত আমাদের মতো ২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত সংঘটিত সাম্প্রদায়িক সহিংসতার পরিপ্রেক্ষিতে হাইকোর্টের আদেশে গঠিত সাহাবউদ্দিন কমিশন রিপোর্টের সুপারিশমালা বাস্তবায়নে সোচ্চার হওয়া।
প্রথম আলো: ওই কমিশন তো আওয়ামী লীগ আমলেই প্রতিবেদন দিয়েছে। বাস্তবায়ন হয়েছে কি?
রানা দাশগুপ্ত: দুঃখের বিষয়, ২০১২ সালে সরকারের কাছে কমিশন সুপারিশমালাসহ রিপোর্ট পেশ করা সত্ত্বেও আজও বাস্তবায়িত হয়নি। বাস্তবায়িত হলে জাতি উপলব্ধি করতে পারত সেদিনকার সহিংসতার সঙ্গে কারা জড়িত এবং দেশ বিচারহীনতার অব্যাহত সংস্কৃতি থেকে মুক্তি পেত।
প্রথম আলো: সংখ্যালঘুদের অধিকার রক্ষার প্রশ্নে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে কোনো পার্থক্য দেখেন কি? দুই সরকারের আমলেই তো সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা ও সম্পত্তি দখলের ঘটনা ঘটছে।
রানা দাশগুপ্ত: সংখ্যালঘুদের অধিকার রক্ষার প্রশ্নে বিএনপির কোনো ভূমিকা রাজনৈতিকভাবে দৃশ্যমান নয়। ধর্মভিত্তিক জাতীয়তাবাদী ধারা থেকে তারা বেরিয়ে আসতে পারেনি। বেরোতে পারবে বলেও মনে হয় না। অন্যদিকে আওয়ামী লীগ দলগতভাবে ধর্মনিরপেক্ষতা ও অসাম্প্রদায়িকতার কথা বলে। এ দল ক্ষমতায় থাকাকালে কোনো কোনো সাম্প্রদায়িক শক্তির সঙ্গে প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ আঁতাতের চোরাগলিতে হাঁটলেও এটা ঠিক, শেখ হাসিনার সরকার নিবন্ধন আইনের বৈষম্য দূর করেছে, গণবিরোধী কালাকানুন শত্রু (অর্পিত) সম্পত্তি আইন বাতিল করে অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যর্পণ আইন করেছে। এতে বেশ কয়েকটি ইতিবাচক সংশোধনী এনেছে। সংবিধান জিয়া ও এরশাদের শাসনের অপচ্ছায়া থেকে বেরিয়ে আসতে পারেনি। তবে ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ ফিরে এসেছে।
প্রথম আলো: অভিযোগ আছে, আওয়ামী লীগ আমলে প্রশাসনে সংখ্যালঘুরা অনেক ক্ষেত্রে অন্যায্য সুবিধা পাচ্ছে।
রানা দাশগুপ্ত: এ অভিযোগ ঠিক নয়। বরং বলব, রাষ্ট্রীয় সাম্প্রদায়িকতার অবসান ঘটেছে। অতীতে সরকারি নিয়োগ-পদোন্নতি ইত্যাদিতে ধর্মীয় পরিচয়ের প্রাধান্য ছিল। বর্তমানে মেধা ও যোগ্যতার পরিচয় মুখ্য হওয়ায় প্রশাসনে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের অংশীদারত্ব-প্রতিনিধিত্ব আগের চেয়ে বেড়েছে। পার্বত্য ভূমি কমিশন আইনে ইতিবাচক সংশোধনী এসেছে। বিগত সংসদ নির্বাচনের আগে পার্বত্য শান্তি চুক্তি, অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যর্পণ আইনের বাস্তবায়ন ছাড়াও সংখ্যালঘু সুরক্ষা আইন, জাতীয় সংখ্যালঘু কমিশন গঠনসহ সংখ্যালঘুদের স্বার্থ ও অধিকার রক্ষায় আরও কিছু প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। এসব প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে সরকার অনতিবিলম্বে উদ্যোগ নেবে—এ প্রত্যাশা আমাদের। তবে সংখ্যালঘুদের ওপর রাষ্ট্রীয় হামলার অবসান হলেও সামাজিক ও রাজনৈতিক সাম্প্রদায়িকতার অবসান হয়নি।
প্রথম আলো: দল হিসেবে বিএনপিকে কি সংখ্যালঘুদের স্বার্থবিরোধী মনে করেন?
রানা দাশগুপ্ত: গত নির্বাচনের আগে বিএনপি সংখ্যালঘুদের স্বার্থ রক্ষার জন্য খানিকটা হলেও প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেছিল। এটি নিঃসন্দেহে ইতিবাচক। যে যেখানে থাকুক না কেন, সংখ্যালঘুদের স্বার্থ ও অধিকার রক্ষায় কাজ করলে আমরা সমর্থন করব। তবে তারা (বিএনপি) পারবে কি না, সেটি রাজনৈতিক ভবিষ্যৎই বলে দেবে।
২০১৮ সালের নির্বাচনের আগে আপনারা ৩১ জন সাংসদের কাজকে সংখ্যালঘু স্বার্থবিরোধী হিসেবে চিহ্নিত করে তাঁদের মনোনয়ন না দেওয়ার জন্য আওয়ামী লীগের প্রতি আহ্বান জানিয়েছিলেন। তারা কি এ দাবি আমলে নিয়েছিল?
রানা দাশগুপ্ত: আমলে নিয়েছিল কি না, বলতে পারব না। তবে এর মধ্যে অন্তত অর্ধেক গত নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পাননি, এটুকু বলতে পারি।
আপনি কি মনে করেন না, ভারতে মোদি সরকারের নাগরিকত্ব আইন ও নাগরিকপঞ্জি বাংলাদেশের সংখ্যালঘুদের অবস্থানকে দুর্বল করেছে? এ নিয়ে আপনি সংবাদ সম্মেলনও করেছিলেন। এখন আপনাদের অবস্থান কী?
রানা দাশগুপ্ত: আমরা আগের অবস্থান থেকে সরে আসিনি। দুই দেশের রাষ্ট্রনায়ক ও রাজনীতিবিদদের উপমহাদেশের সার্বিক স্বার্থে তা গভীরভাবে ভেবে দেখার সময় এসেছে। বাংলাদেশের সংখ্যালঘুদের অবস্থান দুর্বল হলে ভারতে সংখ্যালঘুদের অবস্থান সবল থাকবে, এটা ভাবার কারণ নেই।
আপনারা একসময় অভিযোগ করতেন, বাংলাদেশ থেকে সংখ্যালঘুরা দেশ ত্যাগ করছে। কিন্তু ২০১৫ সালের পর পরিসংখ্যান বলছে, হিন্দু জনগোষ্ঠীর সংখ্যা নিকট অতীতের চেয়ে বেড়েছে। সংখ্যালঘুদের জন্য সুসংবাদ বলে মনে করেন?
রানা দাশগুপ্ত: এখন সংখ্যালঘুরা দেশ ত্যাগ করছে না, এটি অবশ্যই সুসংবাদ। পাকিস্তান আমলের মতোই ১৯৭৫ সালের বঙ্গবন্ধু হত্যা-পরবর্তী সরকারগুলো এথনিক ক্লিনজিং পলিসি বা সংখ্যালঘু নিঃস্বকরণ নীতি গ্রহণ করে রাষ্ট্রীয় সাম্প্রদায়িকতার মাধ্যমে তাদের দেশত্যাগে বাধ্য করেছিল। রাষ্ট্রীয় সাম্প্রদায়িকতার ক্রমাবসানের কারণে হিন্দু জনগোষ্ঠীর সংখ্যা বাড়ছে। তা ছাড়া ভারত সরকারের নতুন নাগরিকত্ব আইনে আছে, ২০১৪ সালের পর কোনো সংখ্যালঘু দেশত্যাগ করে ভারতে গেলে তাদের নাগরিকত্ব দেওয়া হবে না। এ কারণেও আর কেউ ভারতে যেতে উৎসাহ বোধ করছে না।
রামু, নাসিরনগর ও সাঁথিয়ার সাম্প্রদায়িক হামলার জন্য কাকে দায়ী করবেন? বিচারপ্রক্রিয়া কোন অবস্থায় আছে?
রানা দাশগুপ্ত: স্বাধীনতাবিরোধী সাম্প্রদায়িক শক্তি ও সরকারি দল আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ সাম্প্রদায়িক শক্তি—এ দুয়ের ঘনিষ্ঠ মেলবন্ধনে রামু, নাসিরনগর, সাঁথিয়ার ঘটনা ঘটেছে। বিচারপ্রক্রিয়া থমকে আছে। কোনোভাবে অগ্রসর হতে পারছে না। এ প্রসঙ্গে রামু বৌদ্ধবিহারের প্রয়াত অধ্যক্ষ ভদন্ত সত্যপ্রিয় মহাথেরোর বক্তব্য উদ্ধৃত করতে চাই। তিনি বলেছিলেন, ‘কাঠের মন্দির পাকা হয়েছে। কিন্তু রাতের বেলা তো ঘুম আসে না। যারা মন্দির জ্বালিয়ে দিয়েছে, দিনের বেলা দল বেঁধে তারা মন্দির ও এর আশপাশের এলাকায় ঘুরে বেড়ায়। সাহস করে আদালতে সাক্ষ্য দিতে যাবে কে?’ অন্যান্য ঘটনার দৃশ্যটাও প্রায় একই রকম। বিচার নিয়ে আমাদের শঙ্কা ও সংশয় আছে।
এবারের শারদীয় দুর্গোৎসব নিয়ে কোনো শঙ্কা করছেন কি?
রানা দাশগুপ্ত: করোনাভাইরাসের অতিমারিতে পূজার্থীরা সারা দেশে উৎসবের আনুষ্ঠানিকতা পরিহার করে স্বাস্থ্যবিধি মেনে শুধু পূজার্চনার মধ্য দিয়ে মা দেবী দুর্গার আরাধনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এর খুব বেশি ব্যতিক্রম হবে বলে মনে হয় না। আর শঙ্কার প্রশ্নে বলতে হয়, পূজার প্রাক্কালে কয়েকটি মন্দিরে ইতিমধ্যে হামলার ঘটনা ঘটেছে, প্রতিমা ভাঙচুর হয়েছে। সংখ্যা কম হলেও শঙ্কা একেবারেই নেই, এ কথা বলা যাবে না।
প্রথম আলো: আপনাকে ধন্যবাদ।
রানা দাশগুপ্ত:প্রথম আলোকেও ধন্যবাদ।
আপনার মতামত জানানঃ