বাংলাদেশে শ্বাসরুদ্ধর এক পরিস্থিতির আপাত অবসান হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। কোটা বিরোধী আন্দোলনকে কেন্দ্র করে টানা বিক্ষোভ, সহিংসতা, ইন্টারনেট বন্ধ, কারফিউ জারি – সব মিলিয়ে জীবনযাত্রা থমকে গিয়েছিল।
যদিও পুরোপুরি স্বাভাবিক হতে এখনো আরো সময় লাগবে বলে মনে হচ্ছে। সেনাবাহিনী কখন ব্যারাকে ফিরবে সেটি এখনো পরিষ্কার নয়, কারফিউ পুরোপুরি তুলে নেয়া হয়নি, ইন্টারনেট পুরোপুরি ফিরে আসেনি এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে।
গত ১৬ই জুলাই থেকে ২১ শে জুলাই পর্যন্ত টানা বাংলাদেশে নজিরবিহীন বিক্ষোভ আর সহিংস আন্দোলন হয়েছে। স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাসে এ ধরণের বিক্ষোভ কখনোই দেখা যায়নি। এতো কম সময়ের মধ্যে ১৫০-এর বেশি মানুষ নিহত হবার ঘটনা ঘটেনি।
অনেকে মনে করছেন, এই বিক্ষোভ শুরুতে কোটা সংস্কার শিক্ষার্থীদের থাকলেও শেষ পর্যন্ত সেখানে আর সীমাবদ্ধ থাকেনি। এর একটি বৃহৎ প্রেক্ষাপট যেমন রয়েছে, তেমনি রাজনৈতিক দিকও রয়েছে। বাংলাদেশের রাজনীতিতে এই বিক্ষোভ কী প্রভাব তৈরি করেছে? ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের জন্য এখানে কী বার্তা রয়েছে? এসব প্রশ্ন নিয়ে অনেকেই আলোচনা করছেন।
‘অনেক বড় একটি বার্তা দিয়েছে’
এই বিক্ষোভের দুটো দিক রয়েছে বলে অনেকে মনে করছেন। একটি হচ্ছে, এই আন্দোলনের মাধ্যমে সরকার রাজনৈতিকভাবে বড় একটি ধাক্কা খেয়েছে। বিরোধী রাজনৈতিক দল রাস্তায় বিভিন্ন কর্মসূচীর মাধ্যমে সক্রিয় হতে না পারলেও যে কোন দিক থেকে সরকার চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে পারে।
অন্যদিকে এতো তীব্র একটি আন্দোলন সামাল দেবার মাধ্যমে সরকার আপাতত বুঝিয়ে দিয়েছে যে তাদের ক্ষমতা থেকে সরানো সহজ কাজ নয়। “তারা ধাক্কা খেয়েছে কোন সন্দেহ নেই, ভয় পেয়েছে কোন সন্দেহ নেই। এখানে যে পরিমাণ প্রতিরোধ হয়েছে সেটাকে তারা হয়তো ধারণা করেনি। কিন্তু এটাকে ট্যাকেল (সামাল) করার মতো ক্ষমতা যে তার আছে সেটা সে মোটামুটি দেখাতে পারলো,” বলছিলেন রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মাহা মির্জা।
তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ যেহেতু দীর্ঘ ১৬ বছর ধরে ক্ষমতায় আছে সেজন্য আন্দোলন-বিক্ষোভ দমনের জন্য ‘মেকানিজম ও সারভেইল্যান্স’ তাদের রয়েছে। এসব জায়গায় সরকার বছরের পর বছর ধরে আর্থিক ও রাজনৈতিকভাবে মনোনিবেশ করেছে বলে তিনি উল্লেখ করেন। আবার সরকারের ভীত নাড়ানোর মতো ক্ষমতা যে মানুষজনের রয়েছে সেই বিশ্বাসও তৃণমূল পর্যায়ে তৈরি হয়েছে, বলেন মাহা মির্জা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক রাশেদা রওনক খান মনে করেন, সরকারের জন্য এই আন্দোলন অনেক বড় একটি বার্তা দিয়েছে, যদি সরকার সেটা গ্রহণ করে। এটা শুধু কোটা সংস্কার আন্দোলন ছিল না। এটা ছিল বৈষম্য বিরোধী আন্দোলন। তিনি বলেন, যদিও যে পরিমাণ রাষ্ট্রীয় সম্পদের ক্ষতি হয়েছে তাতে বোঝা যায় যে এই আন্দোলন ছিনতাই হয়ে গেছে।
“ওরা ছাত্র হিসেবে যে পরিমাণ বৈষম্যের মুখোমুখি হয়েছে সেগুলো আর মেনে নিতে পারছিল না। তাদের পিঠ দেয়ালে ঠেকে গেছে।” “জোর করে কখনো রাজনৈতিক মতাদর্শ তৈরি করা যায় না। বিশ্ববিদ্যালয়ে হলে সিট পাওয়ার জন্য অনেক ছাত্র কোন নেতার আন্ডারে যায়, এর অর্থ এই নয় যে সে ওই রাজনৈতিক দলের সমর্থক হবে। এই সত্যটা সরকারকে বুঝতে হবে।”
আওয়ামী লীগ কীভাবে দেখছে?
এই বিক্ষোভ ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগকে বিচলিত করেছে তাতে কোন সন্দেহ নেই। দলটি গত ১৬ বছর একটানা ক্ষমতায় থাকলেও এ ধরণের পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়নি। যুদ্ধাপরাধের বিচারকে কেন্দ্র করে ২০১২ সাল থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত জোরালো রাজনৈতিক আন্দোলন সামাল দিয়েছে দলটি। এছাড়া ২০১৮ সালে কোটা বিরোধী আন্দোলন এবং পরবর্তীতে ‘নিরাপদ সড়ক চাই’ আন্দোলনও সামলে নিয়েছিল দলটি।
কিন্তু এই প্রথমবার বিক্ষোভ সামাল দিতে কারফিউ জারি এবং সেনা মোতায়েন করতে বাধ্য হয়েছে সরকার। বিক্ষোভের মাত্রা এতোটা তীব্র হবে সেটি ধারণা করতে পারেনি ক্ষমতাসীনরা। এর কারণ হচ্ছে, ২০২৪ সালের ৭ই জানুয়ারির নির্বাচনের পর আওয়ামী লীগ অনেকটা নির্ভার অবস্থায় ছিল।
অনেক পর্যবেক্ষক মনে করছেন, এই বিক্ষোভের ভেতর দিয়ে কি বোঝা যাচ্ছে যে আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক এবং সাংগঠনিক অবস্থা নড়বড়ে হয়ে পড়েছে?
“আসলে নড়বড়ে না। আসলে আমরা চিন্তাই করি নাই যে সন্ত্রাসের মাত্রাটা এই পর্যায়ে যাবে,” গণমাধ্যমকে বলছিলেন সাবেক মন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য আব্দুর রাজ্জাক।
আওয়ামী লীগ দল হিসেবে মনে করে এই আন্দোলন সহিংস হবার পেছনে মূল কারণ হচ্ছে ‘বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামের ভূমিকা’। মি. রাজ্জাকও সেটাই মনে করেন। এই আন্দোলন থেকে আওয়ামী লীগের বার্তা নেবার কিছু আছে?
“অবশ্যই আছে। আমাদের দুর্বল দিকগুলো আমাদের চিহ্নিত করতে হবে। কর্মীদের সুসংগঠিত করতে হবে, সুশৃঙ্খল করতে হবে, কমান্ড মানতে হবে। কিছু কিছু তো আছেই। একদম সহজভাবে নিলে তো হবে না। চলার পথেই তো অভিজ্ঞতা… আপনি যদি চোখ বুজে থাকেন তাহলে তো আপনাকে আরো মূল্য দিতে হবে,” বলছিলেন মি. রাজ্জাক।
আওয়ামী লীগ নেতারা স্বীকার করছেন যে গত ১৬ বছরে ক্ষমতাসীনরা এতোটা চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েনি। অতীতে বিভিন্ন সময় দেখা গেছে নানা আন্দোলনে আওয়ামী লীগের বিভিন্ন অঙ্গ সংগঠন রাস্তায় সক্রিয় হয়ে বিক্ষোভকারীদের সরিয়ে দিয়েছে কিংবা পুলিশের সাথে একত্র হয়ে তাদের ‘দমন’ করেছে। এবারও বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্যাম্পাস ও রাস্তায় ছাত্রলীগ বিক্ষোভকারীদের হঠিয়ে দেবার চেষ্টা করেছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেটি কোন কাজে আসেনি।
প্রশ্ন হচ্ছে, এই আন্দোলন থেকে আওয়ামী লীগের শিক্ষা নেবার কিছু আছে? “মানুষের জীবনে শেখার তো শেষ নেই। প্রতিটা পদে পদেই শেখা যায়। প্রতিটি পদে পদে জীবন থেকে শিক্ষা নিতে হয়। এখানে শিখলাম, সাম্প্রদায়িক শক্তি ও সন্ত্রাসী গোষ্ঠী সুযোগ পেলেই সন্ত্রাস চালিয়ে রাজনৈতিক ফায়দা লুটার অপচেষ্টা করে,” বলছিলেন আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক বাহাউদ্দিন নাসিম।
রাজনৈতিক পর্যেবক্ষকদের অনেকেই মনে করেন, বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক নির্বাচন পদ্ধতি না থাকায় ক্ষমতাসীনরা গত ১৬ বছরে জনমতকে গুরুত্ব দিচ্ছে না। বিভিন্ন ইস্যু যখন সামনে আসে তখন সেগুলোকে হয়তো উপেক্ষা করা নয়তো দাবিয়ে রাখার প্রবণতা স্পষ্ট হয়েছে ক্ষমতাসীনদের মধ্যে।
এই সমালোচনাকে আওয়ামী লীগ কিভাবে দেখছে?
“বিষয়টা হচ্ছে, জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়ে আমাদেরকে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে হবে। এ বিষয়টি আওয়ামী লীগ সবসময় অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে বিবেচনায় নেয়।”
“আমরা কিন্তু বিষয়গুলোকে অ্যাড্রেস করেই যাচ্ছি। আমরা অ্যাড্রেস করি না এমন কোন জায়গা আপনি দেখাতে পারবেন না। সময়ে দিতে হয়, সময় দিলে বিষয়গুলোকে আমরা উপলব্ধিতে আনি। ….. আমাদের মাননীয় নেত্রীর কাছে যখনই সঠিক মেসেজটা পৌঁছায় তখনই উনি সেটা নিয়ে কাজ করেন।”
মাহা মির্জা প্রশ্ন তোলেন, ক্ষমতাসীনরা কি বার্তা বোঝার মতো অবস্থায় আছে? “সোশ্যাল মিডিয়া বন্ধ করে তারা পুরো মিডিয়া কন্ট্রোলে নিয়ে নিল। এর মাধ্যমে তারা তাদের ন্যারেটিভ সিস্টেমেটিকালি প্রচার করতেছে। এখন পুরো জিনিসটাই হয়ে গেল বিএনপি-জামায়াতের নাশকতা। এই ন্যারেটিভটা তারা প্রতিষ্ঠিত করলো”
ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ বিষয়টিকে ‘সরকার বিরোধী আন্দোলন’ হিসেবে বিবেচনা করেছে শুরু থেকেই । বিষয়টিকে তারা শুধুই কোটা সংস্কার আন্দোলন হিসেবে দেখেনি। কোটা সংস্কার আন্দোলনকে সমর্থন দিতে দ্বিধা করেনি অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক বিএনপি। মঙ্গলবার ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, শিক্ষার্থীদের আহ্বানে সাড়া দিয়ে সারা দেশের মানুষকে তাদের পাশে দাঁড়ানো উচিত।
বিএনপির মিডিয়া সেলের ফেসবুক থেকে কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের বিভিন্ন সভা-সমাবেশ-অবরোধ সরাসরি সম্প্রচার করা হয়েছে।
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বুধবার এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, ছাত্র আন্দোলনকে পাশ কাটানোর জন্য সরকার বিএনপির ওপর দোষ চাপাচ্ছে। তিনি অভিযোগ করেন, বিভিন্ন জায়গায় সরকার নিজেই নাশকতা করে বিএনপিকে অভিযুক্ত করছে।
কোটা বিরোধী আন্দোলনের শুরু থেকেই বিএনপি বলেছে এর প্রতি তাদের ‘নৈতিক সমর্থন’ রয়েছে। কিন্ত আন্দোলনে বিএনপির নেতা-কর্মীরা সক্রিয়ভাবে অংশ নেয়নি বলে দাবি করছেন দলটির নেতারা।
“বিএনপি কখনো সক্রিয়ভাবে তাদের নেতা-কর্মীদের থাকতে বলেনি ঐ আন্দোলনের সময়। বলেছে যে আমাদের সমর্থন আছে। যে কোন গণতান্ত্রিক শক্তি যখন ক্রিয়াশীল থাকে, তার প্রতি আমাদের সমর্থনটা থেকে যায়,” গণমাধ্যমকে বলেন বিএনিপির আইন বিষয়ক সম্পাদক কায়সার কামাল। তিনি বলেন, সরকার তাদের ব্যর্থতাকে আড়াল করার জন্য বিএনপির ওপর দোষ চাপিয়ে দিচ্ছে।
আপনার মতামত জানানঃ