‘ঈশ্বর কণা’ নাম শুনে অনেকে হয়তো ভেবে বসতে পারেন, এর সঙ্গে নিশ্চয়ই ধর্মের কোনো যোগ আছে। আসলে তা নয়। হিগস-বোসন কণার আরেক নাম ঈশ্বর কণা। এ নামকরণের পেছনে আছে এক মজার ঘটনা।
পদার্থের ভর কীভাবে তৈরি হয়, তা জানতে গেল শতকের ষাটের দশক থেকেই বিজ্ঞানী মহলে বেশ তোলপাড় চলছিল। তবে এ বিষয়ে ১৯৯৩ সালে বিজ্ঞানী লিও লেডারম্যান প্রায় সাড়ে চারশ পৃষ্ঠার এক বই লিখেছিলেন। হিগস-বোসন কণা অনুসন্ধান কেন জরুরি, সেটা বোঝাতে বইটি লেখেন তিনি। তবে বইটির নামকরণ নিয়ে বেশ ভোগান্তিতে পড়েন। অনেক ভেবেচিন্তে কোনো নামই মনপূত না হওয়ায় অবশেষে বিরক্তি নিয়ে বইটির নাম রাখেন দ্য গড-ড্যাম পার্টিকেল। কিন্তু ওই নামও পছন্দ হলো না প্রকাশকের। নামটাকে আরও ছেঁটে ‘গড পার্টিকেল’ রাখার প্রস্তাব দিলেন তিনি। বইয়ের কাটতি বাড়াতে লেডারম্যান ওই নামেই রাজি হলেন। বইটির প্রভাবে বিজ্ঞানী মহলসহ সব জায়গায় হিগস-বোসন কণার নাম হয়ে গেল গড পার্টিকেল। বাংলায়—ঈশ্বর কণা।
এ তো গেল নামকরণের গল্প। কিন্তু ঈশ্বর কণা আসলে কী? এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ড কীভাবে সৃষ্টি হয়েছে, তা অনেক দিনে ধরেই বোঝার চেষ্টা করছেন পদার্থবিদরা। এ ক্ষেত্রে সবচে জনপ্রিয় তত্ত্বটির নাম বিগ ব্যাং থিওরি বা মহাবিস্ফোরণ তত্ত্ব। এ তত্ত্ব অনুসারে, বিশ্ব সৃষ্টির শুরুতে এ বিশ্বব্রহ্মাণ্ড অতি ক্ষুদ্র ও অসীম ভরের এক বিন্দুতে ঘণীভূত ছিল। এরপর আজ থেকে প্রায় ১ হাজার ৩৭০ কোটি বছর আগে এক মহাবিস্ফোরণে সেই বিন্দু থেকে দীর্ঘ ও জটিল প্রক্রিয়ায় প্রথমে মৌলিক কণা, তারপর তা থেকে এই মহাবিশ্বের সৃষ্টি হয়।
কিন্তু এ মহাবিস্ফোরণের সময় যেসব কণার জন্ম হয়েছিল, সেগুলো ছিল ভরহীন। (যেমন আলো ভরহীন বলেই ছোটে সেকেন্ডে প্রায় এক লাখ ৮৩ হাজার মাইল বেগে।) এ বিষয়টিই পদার্থবিদ্যায় অদ্ভুত এক ধাঁধার জন্ম দিল। তাই যদি সত্যি হয়, তাহলে আমরা ভরযুক্ত এ বিশ্ব পেলাম কেমন করে? ভরহীন কণার কারণে মহাবিস্ফোরণের পরপরই সবকিছু শূন্যে বিলীন হয়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু তা তো হয়নি। তার প্রমাণ এ পৃথিবী, গ্রহ-নক্ষত্র, ছায়াপথ কিংবা আমরা নিজেরাই।
বিজ্ঞানীরা বলেন, মহাবিস্ফোরণের পর সৃষ্ট কণাগুলো থেকে প্রায় ৪ শতাংশ ভরযুক্ত পদার্থের সৃষ্টি হয়। এই ৪ শতাংশই হচ্ছে গ্রহ-নক্ষত্র, ছায়াপথ ইত্যাদি। এই মহাজাগতিক বস্তুর ভর আছে বলেই বিশ্ব চলছে ঠিকঠাক। নইলে পুরো বিষয়টাই হতো অন্যরকম।
বিষয়টি উপলদ্ধি করার পর বিজ্ঞানীদের নতুন জিজ্ঞাসা—বস্তু তাহলে ভর পেল কোথা থেকে? ১৯৬৪ সালে পদার্থবিদ পিটার হিগস গণিত কষে বললেন কাল্পনিক এক কণার কথা। তাঁর মতে, সেই কণাই আসলে বস্তুর ভর সৃষ্টি করে। এ কণার নাম কালক্রমে হয়ে যায় হিগস-বোসন কণা। হিগস হলো বিজ্ঞানী পিটার হিগসের নামের অংশ। আর বোসন হচ্ছে বাঙালি বিজ্ঞানী সত্যেন্দ্রনাথ বসুর নামের অংশ। বসু ইংরেজিতে বোস, সেখান থেকেই বোসন। আসলে এ কণাটির বৈশিষ্ট্য কেমন হবে, সে ধারণা পাওয়া যায় সত্যেন্দ্রনাথ বসুর পরিসংখ্যান থেকে, যেটি বোস-আইনস্টাইন পরিসংখ্যান নামে পরিচিত। অর্থাৎ কণাটি বোস- আইনস্টাইন পরিসংখ্যান মেনে চলে বলে বাঙালি এ বিজ্ঞানির নাম এতে জড়িয়ে যায়।
যাই হোক, এই ঈশ্বর কণা বা হিগস-বোসনের জন্যই সব বস্তু ভর পায়। মহাবিশ্বের কণাদের চরিত্র ব্যাখায় বিজ্ঞানীরা দীর্ঘ প্রচেষ্টায় তিলে তিলে গড়ে তুলেছেন স্ট্যান্ডার্ড মডেল নামের এক তত্ত্ব। এর মাধ্যমে বোঝা সম্ভব মহাবিশ্বের জন্মরহস্য। আর এ তত্ত্বের প্রাণভোমরা হচ্ছে ওই ঈশ্বর কণা। তাই কাল্পনিক এই কণাটি ধরতে বিজ্ঞানিরা রীতিমতো যুদ্ধে নেমে পড়েন।
সে জন্য ২০০৮ সালে সুইজারল্যান্ডের মাটির নিচে প্রায় ৩০ কিলোমিটার পরিধির সুড়ঙ্গ খুঁড়ে তাতে বসানো হয় এ যাবৎকালের সবচেয়ে বড় যন্ত্র—লার্জ হ্যাড্রন কলাইডার বা এলএইচসি। সেখানে আলোর গতিতে ধাবমান দুটি বিপরীতমুখী প্রোটনের মধ্যে সংঘর্ষ ঘটানো হয়। বলা যায়, এভাবে তৈরি করা হয় ছোট আকারের বিগ ব্যাং বা মহাবিশ্বের আদি অবস্থা। এ সংঘর্ষে সৃষ্টি হয় বিপুল পরিমাণ শক্তি আর অসংখ্য অতিপারমাণবিক কণা। সেখান থেকেই বিজ্ঞানীরা খোঁজ পান বহু কাঙ্খিত ঈশ্বর কণার। ২০১২ সালের ৪ জুলাই ইউরোপিয়ান কাউন্সিল ফর নিউক্লিয়ার রিসার্চ (সার্ন) এ কণার অস্তিত্ব আবিস্কারের ঘোষণা দেয়। এ জন্য ২০১৩ সালে পিটার হিগস ও ফঁসোয়া এংলার্টকে পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়।
আপনার মতামত জানানঃ