বগুড়ায় ধর্ষণ এবং ধর্ষণের পর মা ও ধর্ষিতা মেয়ের মাথা ন্যাড়া ও নির্যাতনের ঘটনা বহুল আলোচিত। তখন দেশবাসী ক্ষোভে ফেটে পড়েছিলেন আসামিদের বিরুদ্ধে। ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে ধর্ষণের অভিযোগ তোলা মা মেয়েকে প্রকাশ্যে ন্যাড়া করে দিয়েছিলেন তৎকালীন শ্রমিক লীগ নেতা তুফান সরকার সহ তার সহযোগীরা। ইতোমধ্যে মামলার অন্যান্য আসামিরা ছাড়া পেয়ে চলে গেছে। দীর্ঘ চার বছর পর বাদী ধর্ষণের অভিযোগ অস্বীকার এবং ভুল বোঝাবুঝিতে মামলা হয়ে গেছে মর্মে স্বীকারোক্তি দিলে, আজ রোববার(১৭ জানু) মামলার প্রধান আসামি বহিষ্কৃত শ্রমিক লীগ নেতা তুফান সরকারকে জামিন দেন আদালত। বগুড়ার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল আদালত-১–এর বিচারক এ কে এম ফজলুল হক আলোচিত এই মামলার প্রধান আসামি তুফান সরকারের জামিন আবেদন মঞ্জুর করেন।
আসামিপক্ষের আইনজীবী ছিলেন আবদুল মোন্নাফ, নুরুস সালাম ও রবিউল ইসলাম।
জানতে চাইলে আবদুল মোন্নাফ গণমাধ্যমকে বলেন, নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-১–এ বিচারাধীন থাকা মামলায় তার মক্কেল তুফান সরকার জামিন পেয়েছেন।
চুল কেটে দেওয়া ও মা-মেয়েকে নির্যাতনের অপর মামলায় তুফান সরকার জামিনে রয়েছেন কি না, জানতে চাইলে আইনজীবী আবদুল মোন্নাফ কোনো মন্তব্য করতে চাননি।
বগুড়ার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-১–এর রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলি নরেশ মুখার্জি জানান, রোববার ধর্ষণ মামলার জামিন শুনানির সময় তিনি আদালতে উপস্থিত ছিলেন। তিনি দাবি করেন, আদালতে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীরা তুফান সরকারের জামিনের ঘোর বিরোধিতা করেছেন। আদালত দুই পক্ষের যুক্তিতর্ক শেষে তাকে জামিন দিয়েছেন।
নরেশ মুখার্জি বলেন, মামলার প্রধান সাক্ষী বাদী নিজেই। এ ছাড়া ভিকটিম মেয়েটিও মামলার অন্যতম সাক্ষী। রোববার প্রধান আসামির জামিন শুনানির আগে মামলার গুরুত্বপূর্ণ এই দুই সাক্ষীর সাক্ষ্য গ্রহণ করা হয়। এ সময় আদালতে সাক্ষীর কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে মা-মেয়ে দুজনই বলেন, ঘটনার স্থান, কাল—কিছুই তারা জানেন না। তুফান সরকারের বিরুদ্ধে তাদের কোনো অভিযোগও নেই। কোনো ধর্ষণের ঘটনাও ঘটেনি।
বাদী আরো বলেন, মামলার এজাহারে বর্ণিত অভিযোগ সত্য নয়। জোরজবরদস্তি করে মামলার এজাহারে তার স্বাক্ষর নেওয়া হয়েছে। এজাহারে কী লেখা আছে, সেটাও তিনি পড়ে দেখেননি। ভুল–বোঝাবুঝি থেকে এ মামলা হয়েছে।
এজাহার সূত্র জানায়, তুফান সরকার এক ছাত্রীকে বগুড়ার ভালো কলেজে ভর্তি করে দেবার নামে তার সঙ্গে সখ্যতা গড়ে তোলেন। গত ২০১৭ সালের ১৭ জুলাই সহযোগিদের মাধ্যমে ওই ছাত্রীকে তার বগুড়া শহরের চকসুত্রাপুর চামড়া গুদাম এলাকার বাড়িতে নিয়ে ধর্ষণ করেন। তার স্ত্রী আশা সরকার বিষয়টি জানতে পেরে বোন বগুড়া পৌরসভার ২ নম্বর সংরক্ষিত আসনের কাউন্সিলর মারজিয়া হাসান রুমকির সঙ্গে পরামর্শ করে উল্টো ওই ছাত্রীকে শায়েস্তা করার পরিকল্পনা করেন।
ওই বছরের ২৮ জুলাই ওই ছাত্রী ও তার মাকে ক্যাডারের মাধ্যমে তুলে শহরের বাদুড়তলার বাড়িতে আনা হয়। সেখানে মা ও মেয়েকে রড দিয়ে মারপিট, শ্লীলতাহানী এবং নাপিত ডেকে দুজনের মাথা ন্যাড়া করে দেয়া হয়।
এছাড়া তাদের অবিলম্বে বগুড়া ত্যাগের নির্দেশ দেয়া হয়েছিল। এক প্রতিবেশি ওই মা ও মেয়েকে উদ্ধার করে বগুড়া শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করেন।
বিষয়টি জানাজানি হলে পুরো জেলায় তোলপাড় শুরু হয়। ছাত্রীর মা ২৮ জুলাই সদর থানায় তুফান সরকারসহ ১২ জনের বিরুদ্ধে নারী ও শিশু নির্যাতন আইনে মামলা করেন। পুলিশ একজন ছাড়া সকল আসামিকে গ্রেফতার করে। তুফান সরকার ছাড়া আসামিদের প্রায় সকলে আদালত থেকে জামিনে ছাড়া পান। আজ মামলার প্রধান আসামি তুফান সরকার জামিনে ছাড়া পান।
সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, দেশজুড়ে নাড়া দেওয়া একটি আলোচিত ধর্ষণ মামলার পৌনে চার বছর পর আদালতে দাঁড়িয়ে ঘটনা সত্য নয়, বাদীর এ ধরনের সাক্ষ্য দেওয়ার বিষয়টি অত্যন্ত দুঃখজনক। এমন আলোচিত মামলার বিচার না হলে দেশে বিচারহীনতার সংস্কৃতি চলতেই থাকবে। এতে অপরাধীরা আরো উৎসাহিত হবে, ধর্ষণের ঘটনাও চলতেই থাকবে। তারা বলেন, বাদী কোন পরিস্থিতিতে থাকলে এতোদিন পর এসে ঘটনা অস্বীকার করে, আদালত ও প্রশাসনের উচিত তা খতিয়ে দেখা এবং এবিষয়ে দেশবাসীকেও পরিষ্কার তথ্য দেওয়া। বাদীকে ভয় দেখিয়ে আদালতে মিথ্যা স্বীকারোক্তি আদায় করা এদেশে নতুন কিছু নয়, পুরনো রেওয়াজ। আদালত সেটা বিনা বাক্য ব্যয়ে গ্রহণ করলে ধর্ষণ মামলার উপযুক্ত বিচার হয় না বলে মনে করেন তারা। বাদীদের শুরু থেকেই নিজেদের প্রভাব দেখিয়ে ভয় ভীতি দেখিয়ে আসছে। এমনকি ঘটনা ঘটেছেও আসামিদের প্রভাব আর ক্ষমতার অপব্যবহারের কারণেই। এসব দেশজুড়ে সকলেই জানে। এমন একটি আলোচিত ঘটনার মীমাংসা এমন হলে দেশে এর প্রভাব পড়বে। এমন ঘটনা আরো বহু ঘটনার অনুপ্রেরণা হতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেন সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা।
এসডব্লিউ/পিএ/কেএইচ/১৯০০
আপনার মতামত জানানঃ