কলকতা বন্দরের নাব্যতা বৃদ্ধির কারণ দেখিয়ে সৃষ্ট ফারাক্কা বাঁধের প্রভাবে বাংলাদেশ অংশে পদ্মা পরিণত হয়েছে একখণ্ড মরুভূমিতে। নদী হারিয়েছে নাব্যতা, আয়তন কমেছে প্রায় ৫০ শতাংশ। নদী গবেষকেরা বলছেন, গঙ্গা চুক্তির ন্যায্য হিস্যা আদায় করতে না পারলে অস্তিত্ব সংকটে পড়বে পদ্মা, অর্ধশতাধিক দেশীয় প্রজাতির মাছ।
চাঁপাইনবাবগঞ্জের পশ্চিম সীমান্ত থেকে ১৮ কিলোমিটার উজানে গঙ্গা নদীর ওপর তৈরি করা হয় ফারাক্কা বাঁধ। ১৯৬১ সালে বাঁধের মূল নির্মাণকাজ শুরু হয়ে ১৯৭৪ সালের ডিসেম্বর মাসে তা শেষ হয়। বাংলাদেশ ভাটি অঞ্চলে হওয়ায় উজানের যে কোনো ধরনের পানি নিয়ন্ত্রণে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে এ দেশে। ফলাফলে পদ্মা হারিয়েছে নাব্যতা, ধারণ করেছে ধুসর আকার।
স্থানীয়রা বলছেন, সত্তরের দশকে উত্তাল পদ্মার গর্জন ছিল ভয়ংকর। পদ্মার এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত দেখা যেত না। প্রচুর পরিমাণে বিভিন্ন প্রজাতির মাছ পাওয়া যেত। এখন এ সবই অতীত। মৃত পদ্মা এক মরুভূমির রুপ।
স্প্রিংগার থেকে প্রকাশিত আন্তর্জাতিক বিজ্ঞানসাময়িকীর তথ্য বলছে, ১৯৮৪ সালের তুলনায় শুকনো মৌসুমে পদ্মা নদীর আয়তন কমেছে প্রায় ৫০ শতাংশ। পানির গভীরতা কমেছে ১৭ দশমিক ৮ শতাংশ। প্রবাহ কমেছে ২৬ দশমিক ২ শতাংশ। আর মিঠা পানির সরবরাহ সর্বোচ্চ ৯০ শতাংশ পর্যন্ত কমেছে। পদ্মা অববাহিকায় বার্ষিক গড় বৃষ্টিপাত ১৯ দশমিক ২ শতাংশ কমেছে।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিশারিজ বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. শামস মুহাম্মদ গালিব বলেন, ‘রাজশাহীর গোদাগাড়ী থেকে চারঘাটের সারদা পর্যন্ত পদ্মার ৭০ কিলোমিটার অংশের নয়টি পয়েন্টে ১২৯ প্রজাতির মাছের অর্ধেকের বেশি অস্তিত্ব সংকটে। এক সময় পদ্মায় অনেক শুশুক বা ব্লাক ডলফিন দেখা গেলেও বর্তমানে তা বিলীনের পথে। মৃত পদ্মায় হুমকিতে জলজ উদ্ভিদ।’
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. শীতাংশু কুমার পাল বলেন, ‘যেভাবে পদ্মার পানি কমছে এতে করে এ অঞ্চলের জীববৈচিত্র্য মারাত্মক হুমকির মুখে রয়েছে। আপনি প্রকৃতিকে ক্ষতিগ্রস্ত করলে প্রকৃতি তার প্রতিশোধ নেবে। বর্তমানে সেটাই ঘটছে।’
১৯৭৪ সাল পর্যন্ত পদ্মায় প্রতি সেকেন্ডে পানি প্রবাহ ছিল ৩ লাখ ১৮ হাজার ৬৪৮ কিউসেক। বাঁধ চালুর পর প্রবাহ নেমেছে ১ লাখ ৮১ হাজার ৫৫০ কিউসেক। ১৯৯৬ সালের ভারত-বাংলাদেশের ৩০ বছর মেয়াদী গঙ্গা পানি চুক্তি অনুযায়ী, ফারাক্কা পয়েন্টে ৭০ হাজার কিউসেক পানি থাকলে উভয় দেশ পাবে ৩৫ হাজার কিউসেক পানি। ৭০ থেকে ৭৫ হাজার কিউসেক পানি থাকলে বাংলাদেশ পাবে ৩৫ হাজার কিউসেক অবশিষ্ট পাবে ভারত। আর ৭৫ হাজার কিউসেকের বেশি পানি থাকলে ভারত পাবে ৪০ হাজার কিউসেক অবশিষ্ট পাবে বাংলাদেশ। চুক্তি থাকলেও বাস্তব চিত্র ভিন্ন, বলছেন বিশ্লেষকেরা। পানিপ্রবাহ যে হারে কমছে, তা নিয়ে শঙ্কিত নদী গবেষকেরা।
নদী গবেষক মাহবুব সিদ্দিকী বলেন, গঙ্গা চুক্তির ন্যায্য হিস্যা আদায় করতে না পারলে অস্তিত্ব সংকটে পড়বে পদ্মা। যৌথ নদীকমিশনের ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন তোলেন এই গবেষক। পদ্মা বাঁচাতে বাংলাদেশের নীতি নির্ধারকদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে হবে। প্রতিবেশী রাষ্ট্রের কাছ থেকে ন্যায্য হিস্যা আদায় করতে না পারলে পদ্মা মরুভূমিতে পরিণত হবে।
নদীমাতৃক এই দেশে সাত শ নদী এবং এক শটির অধিক আন্তর্জাতিক নদীর কথা কাগজে-কলমে থাকলেও বাস্তবে টিকে আছে কয়টি, এর সঠিক কোনো হিসেব নেই।
আপনার মতামত জানানঃ