ভারতের লোকসভা নির্বাচনের প্রথম তিন দফার ভোট গ্রহণ শেষ হলেও আশানুরূপ ভোটার উপস্থিতি না থাকায় চিন্তার ভাঁজ পড়েছে ক্ষমতাসীন বিজেপির কপালে। নির্বাচন শুরুর আগে দেশটির প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ৪০০ আসন জয়ের যে স্লোগান দিয়েছিলেন, তা কেবল স্বপ্নই থেকে যেতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে।
পরিস্থিতি এমন হবে, তা অনেকেই ভাবেননি। নির্বাচনের তপশিল ঘোষণার আগে তড়িঘড়ি করে অযোধ্যায় রামমন্দিরের প্রাণ প্রতিষ্ঠা, সিলিন্ডার গ্যাসে ভর্তুকি দিয়ে দাম কমানো, বিল গেটসের সঙ্গে নরেন্দ্র মোদির সাক্ষাৎ, জি২০ সম্মেলন ঘিরে ব্যাপক প্রচারণা, বিলবোর্ডে বড় বড় ছবি– এসবের কিছুই এবার আনতে পারেনি ‘মোদি জোয়ার’। তাই এখন ‘৪০০ পারে’র স্লোগানও খুব একটা শোনা যাচ্ছে না ক্ষমতাসীনদের মুখে।
এ অবস্থায় প্রচারণার মাঠে বিজেপি নেতৃত্বাধীন এনডিএ জোট ও বিরোধী কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন ইন্ডিয়া জোটের মধ্যে কথার লড়াই জমে উঠেছে। বিরোধীরা বিজেপি নেতা মোদির বিরুদ্ধে ধর্মকে ভিত্তি করে রাজনীতি ও ভোটারদের ভয় দেখিয়ে ফায়দা হাসিলের অভিযোগ আনছেন। তাদের দাবি, মোদি ১০ বছরে কী করেছেন, তা বলছেন না। তিনি রাজনৈতিক মেরূকরণ সৃষ্টির চেষ্টা করছেন।
মোদির কঠোর সমালোচকদের মধ্যে কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধী, সমাজবাদী পার্টির অখিলেশ যাদব, আরজেডির তেজস্বী যাদব ও আম আদমি পার্টি সঞ্জয় সিংয়ের নাম রয়েছে। তবে সবাইকে ছাপিয়ে চলতি নির্বাচনে ভারতের রাজনীতিতে জোরোশোরে আলোচনায় আসছে আরেকটি নাম। তিনি কংগ্রেসের প্রিয়াঙ্কা গান্ধী। মোদির নানা বক্তব্যের কৌশলী জবাব দিয়ে তিনি নজর কাড়ছেন।
সম্প্রতি রাজস্থানে এক জনসভা মোদি মুসলিমদের ‘অনুপ্রবেশকারী’ বলে মন্তব্য করেন। তিনি বলেন, ‘কংগ্রেস তাদের মেনিফেস্টোতে বলেছে, তারা মা-বোনের স্বর্ণের হিসাব করবে, তথ্য সংগ্রহ করবে এবং এ সম্পত্তি ভাগ করে দেবে। তারা আপনাদের মঙ্গলসূত্রও রাখতে দেবে না।’ জবাবে গুজরাটে এক জনসভায় প্রিয়াঙ্কা বলেন, ‘কেমন কেমন বিভ্রান্ত করার মতো কথা হচ্ছে। কংগ্রেস নাকি আপনাদের মঙ্গলসূত্র ও স্বর্ণ ছিনিয়ে নিতে চায়! ভারত স্বাধীন হওয়ার ৭০ বছর হলো; ৫৫ বছরই ক্ষমতায় ছিল কংগ্রেস– কেউ কি আপনাদের স্বর্ণ ছিনিয়ে নিয়েছে?’ রাজীব গান্ধীর মেয়ে বলেন, ‘যখন যুদ্ধ হয়েছিল, ইন্দিরা গান্ধী তাঁর স্বর্ণ দেশকে দিয়েছিলেন, আর আমার মায়ের মঙ্গলসূত্র তো এ দেশের জন্য আত্মোৎসর্গ করে দিয়েছে।’
গত বুধবার তেলেঙ্গানায় এক ভাষণে বিজেপি নেতা মোদি অপ্রত্যাশিতভাবে ভারতের দুই ধনকুবের মুকেশ আম্বানি ও গৌতম আদানির প্রসঙ্গে বলেন। রাহুল গান্ধী এ দু’জনের সঙ্গে মোদির সম্পর্ক নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে সমালোচনা করে আসছিলেন। জনগণের কথা ভুলে তাদের অতিরিক্ত সুবিধা দেওয়ার অভিযোগ তুলেছিলেন। ওই ভাষণে ভারতের প্রধানমন্ত্রী বলেন, কংগ্রেস নেতা এখন আর আম্বানি-আদানির কথা বলেন না। তাদের কাছ থেকে কংগ্রেস ‘কালো টাকা’ নিয়েছে।
দ্য হিন্দু অনলাইন জানায়, ভারতের প্রধানমন্ত্রীর এসব বক্তব্যের জবাব দিয়েছেন প্রিয়াঙ্কা। বৃহস্পতিবার তিনি বলেন, তাঁর ভাই কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধী প্রতিদিনই আম্বানি-আদানির কথা বলছেন। তিনি বলছেন দেখেই মোদি তাদের নাম নিতে বাধ্য হয়েছেন।
রাহুল গান্ধীকে ‘শাহাজাদা’ সম্বোধন করে মোদির বক্তব্যেরও সমালোচনা করেন প্রিয়াঙ্কা। তিনি মোদিকে ‘শাহেনশাহ’ সম্বোধন করেন। প্রিয়াঙ্কা বলেন, ‘মোদি যাকে শাহাজাদা বলছেন, তিনি কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারি পর্যন্ত চার হাজার কিলোমিটার হেঁটেছেন; জনগণের দাবি-দাওয়া, দুঃখকষ্টের কথা শুনেছেন। অথচ শাহেনশাহ থাকেন প্রাসাদে, পরিপাটি। তিনি কীভাব কৃষকের কষ্ট বুঝবেন?’
ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায়, যেসব লোকসভা নির্বাচনে ভোটের হার কম পড়েছে, সেগুলোতে ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) আসন পেয়েছে কম। ২০০৪ সালের নির্বাচনে ভোট পড়েছিল ৫৮ দশমিক ০৭ শতাংশ। তখন বিজেপি নেতৃত্বাধীন জোট ১৩৮টি আসনে জয় পায়। কংগ্রেস পেয়েছিল ১৪৫ আসন। ২০০৯ সালে ভোটের হার ছিল ৫৮ দশমিক ২১ শতাংশ। বিজেপি জোটের আসন সংখ্যা কমে হয় ১১৬; কংগ্রেস জয় পায় ২০৬ আসনে। ২০১৪ সালে ক্ষমতায় আসে বিজেপি। ওই বছর ভোটের হার ছিল ৬৬ দশমিক ৪৪ শতাংশ। বিজেপি পায় ১৬৬ আসন; কংগ্রেস ১৬২টি। ২০১৯ সালে পুলওয়ামা হামলাকে ঘিরে রাজনৈতিক উত্তাপের মধ্যে ভোট বাড়ে বিজেপির। ৬৭ দশমিক ৪০ শতাংশ ভোটের ওই নির্বাচনে বিজেপি জোট ৩০৩ আসনে জয়ী হয়; কংগ্রেস পায় ৫২টি আসন।
সর্বশেষ তৃতীয় দফায় গত মঙ্গলবার ৯৩টি আসনে ভোট গ্রহণ হয়। এতে আগের দুই দফার চেয়েও কম ৬১ দশমিক ৪৫ শতাংশ ভোট পড়ে। প্রথম দুই দফায় যথাক্রমে– ৬৬ দশমিক ১ শতাংশ ও ৬৬ দশমিক ৭ শতাংশ ভোট পড়েছিল, যা ছিল ২০১৯ সালের চেয়ে ৪ শতাংশ কম। পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা, আসাম ও গোয়ায় ভোটের হার বেশি থাকলেও বিহার, মহারাষ্ট্র, কর্ণাটক ও গুজরাটে ভোটের হার ছিল বেশ কম। বিজেপির অন্যতম ঘাঁটি উত্তরপ্রদেশেও এবার ভোট কম পড়েছে। এ পরিস্থিতিতে আগামী সোমবার চতুর্থ দফায় ৯৬টি আসনে ভোট গ্রহণ অনুষ্ঠিত হবে।
এবার উত্তরপ্রদেশে অখিলেশ বেশ কয়েকটি আসন ছিনিয়ে নিতে পারেন। মহারাষ্ট্রে শিবসেনার উদ্ধব ঠাকরে ও এনসিপির শরদ পাওয়ার যৌথভাবে বিজেপির জন্য বড় বাধা হতে পারেন। সামাজিক মাধ্যমে প্রকাশিত ভিডিও ফুটেজে বিহারে তেজস্বী যাদবের সমাবেশে বিপুল সংখ্যক জনতার উপস্থিতি দেখা গেছে। সেখানে বারবার দল পাল্টানোর বিজেপি মিত্র নিতিশ কুমারের গ্রহণযোগ্যতাও কমেছে।
এ অবস্থায় নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধে পক্ষপাতিত্বের অভিযোগও তুলছেন বিরোধীরা। ইন্ডিয়া টুডে জানায়, গত সপ্তাহে কংগ্রেস সভাপতি মল্লিকার্জুন খাড়গে কংগ্রেস নেতাকর্মীর প্রতি লেখা এক চিঠিতে বলেন, নির্বাচন কমিশন ভোটের হারের যে তথ্য দিচ্ছে, তাতে অসংগতি আছে। কমিশনের গ্রহণযোগ্যতা এখন সর্বকালের সর্বনিম্ন। সম্প্রতি নির্বাচনী আচরণবিধি পালন নিয়ে ভারতের নির্বাচন কমিশনের সমালোচনা করেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জিও। তিনি বলেন, বিজেপি নেতাদের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ চোখে দেখে না নির্বাচন কমিশন। তারা প্রচারণায় নেমে বিদ্বেষমূলক বক্তব্য দিয়েই চলেছেন; নির্বাচন কমিশনের ‘মডেল কোড অব কন্ডাক্ট’ এখন ‘মোদি কোড অব কন্ডাক্ট’ হয়ে গেছে।
বার্তা সংস্থা এপি লিখেছে, নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দেওয়া নানা বক্তব্যে মোদি রাজনৈতিক মেরূকরণ করছেন; বিশেষ করে তিনি মুসলিমদের টার্গেট করছেন। প্রচারণায় অর্থনৈতিক প্রসঙ্গ রেখে তিনি ও তাঁর দল বিজেপি হিন্দুত্ববাদী প্রচারণায় লিপ্ত। বিবিসি লিখেছে, ২০১৪ সালে ভারতে বিজেপি নেতৃত্বাধীন সরকার ক্ষমতায় আসার পর মুসলিমবিদ্বেষী বক্তব্য বেড়েছে।
আপনার মতামত জানানঃ