দেশে করোনা ভাইরাসের পরে সবচেয়ে আলোচিত বিষয় হচ্ছে ধর্ষণ। এমনকি গত কয়েকদিন ধরে ধর্ষণের ঘটনা এতোটাই চাউড়ে আছে যে করোনা ভাইরাসের ইস্যুও ধামাচাপায় পড়ে গেছে। সাম্প্রতিক সময় ছাড়াও ধর্ষণ করোনা ভাইরাসের মতোই দীর্ঘদিন ধরে আলোচিত ও আতঙ্কিত। একটা ধর্ষণের ইস্যু যেতে না যেতেই আরেকটা তার স্থান দখল করে নেয়। মাঝে মাঝে একসাথে কয়েকটা পড়ে যাওয়াতে হুলস্থুল বাঁধে। প্রতিটা বছর শেষেই দেখা যায় ভাইরাল ইস্যুগুলোর মধ্যে ধর্ষণই এগিয়ে থাকে। ধর্ষণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ আন্দোলন বিক্ষোভ সভা সেমিনার ইত্যাদিও হয় দেদারছে। এসব দিকে লক্ষ্য রেখেই সরকার ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তির বিধান মৃত্যুদণ্ড রেখেছে। এতোকিছুর পরও ধর্ষণ দমিয়ে রাখা যাচ্ছে না। স্ফুলিঙ্গের মতো ক্রমশ বেড়েই চলেছে উর্ধে। এতোকিছুর পরও কেনো ধর্ষণের লাগাম টেনে ধরা যাচ্ছে না? এর উত্তর খুঁজতে মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন (এমজেএফ) সংগঠনটির পক্ষ থেকে ৩৪ জন ধর্ষণ মামলার আসামির বর্তমান অবস্থা তুলে ধরে গতকাল বৃহস্পতিবার(১৪জানু) অনলাইনে এক সংবাদ সম্মেলনে ধর্ষণ মামলা পরিচালনার প্রতিবন্ধকতা ও দীর্ঘসূত্রতার কারণগুলো তুলে ধরা হয়েছে। সেখানে ধর্ষণ মামলার ধীরে চলা চিরায়ত নিয়মকেই অগ্রাধিকার হিসেবে দেখানো হয়েছে। একইসাথে এসব মামলা ধীরগতিতে চলার কারণ হিসেবেও অনেকগুলো দিক তুলে ধরা হয়েছে।
সাতটি সহযোগী সংগঠন নারীপক্ষ, সিআরপি, প্রতিবন্ধী উন্নয়ন পরিষদ, পল্লীশ্রী, স্বাবলম্বী উন্নয়ন সমিতি, পিপলস অরিয়েন্টেড প্রগ্রাম এবং মহিদেব যুব কল্যাণ সমিতি এ কাজে সহায়তা করেছে। আর দেশের ১০টি জেলা ঢাকা, গাজীপুর, নীলফামারী, কুড়িগ্রাম, দিনাজপুর, কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোনা, শেরপুর, জামালপুর ও জয়পুরহাট থেকে এসব তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে।
২০১২ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত করা ২৫টি ধর্ষণ মামলায় আসামি ৩৪ জন। এর মধ্যে ২৭ জন আসামি জামিনে আছে। দুজন প্রভাবশালীদের ছত্রচ্ছায়ায় ঘুরে বেড়াচ্ছে আর পাঁচজন পুনরায় গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে আছে। দেখা যাচ্ছে, গ্রেপ্তারের পর ২৪ ঘণ্টা থেকে ১৫ দিনের মধ্যে ধর্ষণ মামলার আসামিরা জামিন পাচ্ছে।
ধর্ষণের শিকার এই ২৫ জন নারী ও শিশুর মধ্যে প্রতিবন্ধী নারী তিনজন, পাঁচ থেকে ১০ বছর বয়সী শিশু চারজন, ১১ থেকে ১৫ বছর বয়সী শিশু পাঁচজন, ১৬ থেকে ৩৫ বছর বয়সী কিশোরী ও নারী ১৬ জন। দুটি ধর্ষণের ঘটনায় দুজন প্রতিবন্ধী নারীর দুটি সন্তান হয়েছে। কিন্তু তারা পিতৃত্বের পরিচয় পায়নি। ধর্ষণের ফলে জন্ম হওয়া শিশুর দায়িত্ব রাষ্ট্রের নেওয়ার কথা থাকলেও তা কার্যকর হচ্ছে না।
এই ২৫টি ধর্ষণ মামলার মধ্যে বেশির ভাগ বিচারাধীন ও সাক্ষ্যের পর্যায়ে রয়েছে। মামলা দায়েরের পর ছয় মাসের মধ্যে চার্জশিট হয়েছে ২২টি মামলায়। ২০১৪-১৫ সালে চার্জশিট হওয়া ৯টি মামলার রায় এখনো হয়নি। আর ২০১৬-১৭ সালে চার্জশিট হওয়া ১২টি মামলার রায় এখনো হয়নি। এই দুই ক্ষেত্রে কোনো অগ্রগতিও দেখা যাচ্ছে না। আর তিনটি মামলায় এখনো অভিযোগপত্রই দাখিল করা হয়নি।
২৫টি মামলার মধ্যে দুটি মামলা নিষ্ক্রিয় অবস্থায় আছে। চারটি মামলার নথি পাওয়া যাচ্ছে না। যে ২০টি মামলার চার্জশিট হয়েছে, সেগুলোর ছয় থেকে ২৩ বার শুনানি হয়েছে। একটি মামলার এখনো মেডিকো-লিগ্যাল টেস্ট হয়নি। দেখা গেছে, বেশির ভাগ মামলার সাক্ষী হাজির না হওয়ায় এসব মামলার তারিখ বারবার পিছিয়ে যাচ্ছে। অভিভাবকরা হতাশ হয়ে আর কোর্টে যেতে চাইছেন না। দরিদ্র অভিভাবকরা আর্থিক অসুবিধার কারণে মামলা চালাতে রাজি নন।
এসব মামলার বিচার দেরি হওয়ার কারণ অনুসন্ধানে দেখা গেছে, নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে বলা আছে, মামলা বিচারের জন্য নথি পাওয়ার তারিখ থেকে ১৮০ দিনের মধ্যে কাজ শেষ করা, মামলার শুনানি শুরু হলে তা শেষ না হওয়া পর্যন্ত প্রতি কর্মদিবসে একটানা পরিচালনার নির্দেশনা থাকলেও তা অনুসরণ করা হচ্ছে না।
তদন্তে দীর্ঘসূত্রতার কারণে নির্ধারিত সময়সীমা ৯০ দিনের মধ্যে তদন্ত রিপোর্ট দাখিল করা হচ্ছে না। এ ছাড়া পাবলিক প্রসিকিউটর ভিকটিম ও সাক্ষীকে মামলার তারিখে আদালতে হাজির করানোর ব্যাপারে কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করেন না। প্রতিবেদনে আরো উল্লেখ করা হয়, থানা পুলিশ এবং বিচার প্রক্রিয়ায় ধর্ষণের শিকার শিশু ও নারীকেই নানাভাবে দোষারোপ করা হয়।
আসামিপক্ষের আইনজীবীরা ধর্ষণের শিকার শিশু ও নারীদের প্রতি ইচ্ছাকৃত খারাপ আচরণ করেন। এমনকি আইনে ধর্ষণের অপরাধ আপস অযোগ্য হলেও পারিপার্শ্বিক চাপে আপসরফার ক্ষেত্রে আদালত অনেক সময় চুপ থাকেন।
সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, একসময়কার এসিড সন্ত্রাসকে আইন করে রুখা গেলেও এর পরে উদ্ভব ধর্ষণ সন্ত্রাস রুখা যাচ্ছে না মূলত আইনের দুর্বলতার কারণে। তারা মনে করেন, ধর্ষণ মামলার যথযথ ব্যবস্থা নেওয়া গেলে এবং এর বিষয়ে প্রশাসন কঠোর অবস্থানে গেলে দেশ থেকে ধর্ষণ ধীরে ধীরে এসিড সন্ত্রাসের মতোই হ্রাস পেতে থাকবে। ধর্ষণ বিষয়ে প্রশাসনের লোকদের মানসিকতা এখনো উন্নত নয় বলে মামলা হওয়ার আগেই ধর্ষণের অনেক ঘটনা ঝরে যায়। অনেকে প্রশাসনের লোকদের দ্বারা দ্বিতীয়বার ধর্ষণের স্বীকার হয় বলে অভিযোগ করেন সংশ্লিষ্টরা। যার ফলে ভুক্তভোগীরা প্রশাসনের সহায়তা নিতেও ভয় পান। অপরদিকে ধর্ষণের মতো অধিকাংশ ঘটনাই স্থানীয় রাজনৈতিক প্রভাবশালীদের প্রশ্রয়ে চলে যায় বলে ক্ষমতার বলে এসব মামলা অঙ্কুরেই বিনষ্ট হয়ে যায়। সরকার ধর্ষণের শাস্তির যে দুয়েকটা উদাহরণ তৈরী করে তার প্রায় সবটাই যাদের রাজনৈতিক ও অন্যান্য প্রভাব প্রতিপত্তির অভাব, তাদের ক্ষেত্রে সম্ভব করেন বলে অভিযোগ তোলেন। একইসাথে ধর্ষণ মামলা অতোটা গুরুত্বের সাথে না নিয়ে যে কচ্ছপ গতিতে পরিচালিত হয় এবং এক সময় আসামি মুক্ত হয়ে বাইরে ঘুরে বেড়ায় এতে সমাজে ধর্ষণ করার দিকে উৎসাহ দেওয়া হয়ে থাকে বলে মনে করেন তারা। ধর্ষণ মামলাগুলো অতোটা আলোচিত না হলে, সরকারকে বেকায়দায় না ফেললে সেসব মামলা থেকে ধীরে ধীরে প্রশাসনের আগ্রহ কমে যায় বলে ধারণা পেশ করেন সংশ্লিষ্টরা। ধর্ষনের মামলাকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে যথাযথ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে দ্রুত নিষ্পত্তি করা গেলে সমাজ থেকে ধর্ষণ অনেকটাই কমে যাবে বলে মনে করেন তারা।
এবিষয়ে মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন (এমজেএফ) ধর্ষণের শিকার নারীর ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে কয়েকটি প্রস্তাব দিয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে ধর্ষণসংক্রান্ত আইন সংস্কার করা, সাক্ষী সুরক্ষা আইন প্রণয়ন করা, নির্ধারিত সময়ে তদন্ত ও বিচার শেষ করা, আইনের বিধানগুলো সঠিকভাবে প্রতিপালিত হচ্ছে কি না, সে বিষয়ে শক্তিশালী মনিটর করা, দায়ীদের বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ করা, ধর্ষণের মামলা আপস বা আপসের চেষ্টা করাকে কঠোর শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে গণ্য করা, মেডিক্যাল রিপোর্টে কোনো রকম ত্রুটি শাস্তিযোগ্য হিসেবে চিহ্নিত করা, ভিকটিমের আইনি সহায়তা নিশ্চিত করা। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে পুলিশ, বিচারক, আইনজীবী, চিকিৎসক, কোর্ট স্টাফ ও ধর্ষণ মামলার বিচারসংশ্লিষ্ট সব স্টেকহোল্ডারকে জেন্ডার সমতা, হাইকোর্টের নির্দেশনা, সংস্কার করা আইন, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের প্রটোকল সম্পর্কে নিয়মিত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা।
এসডব্লিউ/কেকে/কেএইচ/২১১৫
আপনার মতামত জানানঃ