স্বাধীনতার পর ঢাকা, রাজশাহী, জাহাঙ্গীরনগর ও চট্টগ্রাম—চারটি বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে পৃথক অধ্যাদেশ বা আদেশ জারি করা হয়। সে সময় বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) ও কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা আইন মন্ত্রণালয়ে যান তাঁদের বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্যও একই রকমের অধ্যাদেশ করে দিতে।
কিন্তু সেটি হয়নি। বুয়েট ও কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ধরন আলাদা। এ ধরনের বিশেষায়িত বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো হওয়া উচিত নয়। বুয়েটে পড়ানোর ধরন, শিক্ষক–শিক্ষার্থীদের সম্পর্কের ধরন আলাদা। এখানে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে পড়ানোর বাইরে রাজনীতিবিষয়ক আলাপ শিক্ষকদের সঙ্গে সাধারণত হয় না।
দেশের পরিস্থিতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে হবে। কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে নিজেদের স্বকীয়তা বদলে দেব। এত দিন ধরে দেখে আসছি, বুয়েটের কোনো বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলো বা যাঁরা দেশ চালাচ্ছেন, তাঁরা কোনো ধরনের প্রভাব বিস্তার করেন না। বুয়েটের সিন্ডিকেট অনেক ক্ষমতাশালী।
বুয়েটের শিক্ষার্থীদের মূল্যায়নে কোনো ধরনের রাজনৈতিক প্রভাব নেই। তবে রাজনীতি করা খারাপ নয়। অন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় শিক্ষার্থীরা করেন। কিন্তু যেগুলো বিশেষায়িত বিশ্ববিদ্যালয় সেগুলোর ধরন আলাদা। বুয়েটের ছাত্ররা সবারই রাজনীতিসচেতন। দেশে কী হচ্ছে না হচ্ছে তাঁরা বোঝেন। কিন্তু তাঁরা সক্রিয়ভাবে রাজনীতিতে অংশ নিতে চান না। ষাটের দশকে ছাত্রনেতারা অত্যন্ত সম্মানীয় ছিলেন। তাঁদের নীতিবোধ ছিল। কিন্তু এখন ছাত্রনেতৃত্ব কেমন যেন হয়ে গেছেন। সাধারণ মানুষের শ্রদ্ধাবোধ তাঁদের প্রতি দিন দিন কমে যাচ্ছে।
দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো শিক্ষা ও গবেষণা ছাড়া অন্য সব বিষয়ে একের পর এক খবরের শিরোনাম হচ্ছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকের চৌর্যবৃত্তি ও যৌন হয়রানির খবর শেষ হতে না হতেই জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ডেকে নিয়ে ধর্ষণের মতো ঘটনা ঘটেছে।
এরপর জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রীর আত্মহত্যাকে কেন্দ্র করে বের হয়ে আসে নিপীড়নের অনেক রকম ইতিহাস। এর মধ্যে এক মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসিকে বরণ করে নেওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে সেখানকার কর্মচারীদের অদ্ভুত ভঙ্গিতে নৃত্য করার ভিডিও–ও ভাইরাল হয়েছে। এসব ঘটনার সঙ্গে কোনো না কোনোভাবে রাজনীতি কিংবা রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতার খবরও পত্রপত্রিকার প্রতিবেদনগুলো থেকে জানা যায়।
এসব ঘটনা যখন চলমান, ঠিক তখনই বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) আবার খবরের শিরোনাম হয়েছে। কেন হয়েছে? শিক্ষা কিংবা গবেষণার কারণে? মোটেই নয়! সেখানে ছাত্ররাজনীতি যেন কোনোভাবেই আবার চালু হতে না পারে, এ জন্য সাধারণ ছাত্রদের ব্যানারে আন্দোলন চলে।
তাঁদের দাবি, সরকার দলীয় ছাত্রসংগঠন সেখানে আবার রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড চালু করার চেষ্টা করছে। এখানে জানিয়ে রাখা ভালো, শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদকে পিটিয়ে হত্যার পর ২০১৯ সালে এক ‘জরুরি বিজ্ঞপ্তি’ জারির মাধ্যমে বুয়েটে রাজনৈতিক কার্যক্রম নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছিল।
কিন্তু সোমবার হাইকোর্ট একটি রুল অধ্যাদেশ জারি করেছেন। এতে বলা হয়েছে, বুয়েটে ছাত্ররাজনীতির ক্ষেত্রে আর কোনো বাধা নেই। হাইকোর্টের এই রুলের পর বুয়েটের ভিসি বলেছেন, ‘আদালতের আদেশ শিরোধার্য।’ এদিকে সাধারণ ছাত্ররা আন্দোলন করে চলেছেন। কারণ হিসেবে তাঁরা বলছেন, আতঙ্ক নিয়ে তাঁরা পড়াশোনা করতে চান না।
বুয়েটে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালিত হবে কি হবে না, সেটা এখনো পুরোপুরি পরিষ্কার হওয়া যাচ্ছে না। ধরে নিচ্ছি, আবারও সম্পূর্ণরূপে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড ফিরে আসবে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এর ফলাফল কী হবে?
একটা বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল কাজ তো শিক্ষা ও গবেষণা। রাজনীতি ফিরে আসার পর কি বুয়েটের শিক্ষার মান বেড়ে যাবে? সেখানে কি গবেষণা আন্তর্জাতিক পর্যায়ে পৌঁছে যাবে?
বুয়েট কি আগামী দিনে পৃথিবীর সেরা এক শ বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে থাকবে? কিংবা বুয়েটের গবেষণার মান ভালো হতে হতে এমন হয়ে যাবে যে আমরা নিজেরাই চাঁদে পৌঁছাতে পারব? কিংবা কে জানে, মঙ্গলগ্রহে!
আজকাল তো অনেক উন্নয়ন হচ্ছে। দেশে বড় বড় সেতু, টানেল কিংবা মেট্রোরেল হয়েছে। এসব বড় বড় প্রকল্পগুলোতে সাধারণত বিদেশ থেকে বিশেষজ্ঞ আনা হয়। বুয়েটে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড ফিরে এলে আমাদের কি বিদেশ থেকে আর বিশেষজ্ঞ আনা লাগবে না? বুয়েট থেকেই আমরা বিশেষজ্ঞ পেয়ে যাব?
এর কোনো কিছু অদূর ভবিষ্যতে না হোক, সুদূর ভবিষ্যতেও কি হতে চলেছে? যদি না হয়, তাহলে ছাত্ররাজনীতি থেকে কিংবা না থেকে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ফায়দাটা আসলে কী হচ্ছে? রাজনীতি থাকলে বরং আমরা দেখতে পাচ্ছি, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষার্থী নিপীড়ন, যৌন হয়রানি কিংবা ধর্ষণের মতো ঘটনা বাড়ছে। আবরার ফাহাদের মতো ছাত্র হত্যাকাণ্ডের শিকার হচ্ছেন। কিংবা শিক্ষকেরা নিজেরা নিজেরা দলাদলি করে পদপদবি হাতিয়ে নিচ্ছেন।
রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড না থাকলে অন্তত এসবের হাত থেকে আমাদের ছেলে-মেয়েগুলো রক্ষা পাবে। কেউ কি এই নিশ্চয়তা দিতে পারবেন যে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড থাকলে এসব ঘটনা দিন দিন বাড়বে না? বাংলাদেশ নামক জনপদে একজন অন্ধও বোধ করি এই নিশ্চয়তা দেবেন না!
আপনার মতামত জানানঃ