দেশে গত দেড় দশকে অনুসন্ধান কার্যক্রমে গ্যাস ক্ষেত্র আবিষ্কৃত হয়েছে ছয়টি—সবই স্থলভাগে। এসব গ্যাস ক্ষেত্রের মজুদ সব মিলিয়ে প্রায় এক ট্রিলিয়ন কিউবিক ফুট (টিসিএফ)। এ দেড় দশকে শিল্প ও বিদ্যুৎ উৎপাদনসহ নানা খাতে গ্যাসের চাহিদা ব্যাপক বাড়লেও পর্যাপ্ত সরবরাহ নিশ্চিত করা যায়নি। আমদানি করে গ্যাস সরবরাহ সামাল দেয়ার চেষ্টা হলেও প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে অর্থের অপর্যাপ্ত সংস্থান। জ্বালানিসংশ্লিষ্টদের মতে,গ্যাস খাতের এ সংকটের পেছনে বড় একটা কারণ হলো দীর্ঘ সময় প্রাথমিক জ্বালানি অনুসন্ধানের উদ্যোগ না নেয়া। গোষ্ঠীস্বার্থ, ভূরাজনীতি ও আমদানিনির্ভরতার প্রভাবও আছে বলে মনে করছেন তারা।
দেশে বিদ্যুৎ সক্ষমতা বৃদ্ধি, শিল্প খাত প্রসার ও বাণিজ্যিক খাতে গ্যাস সরবরাহ বাড়ানোর তৎপরতা ছিল ২০১০-১১ সালের দিকে। ওই সময় বিদ্যুৎ ও শিল্প খাতে গ্যাসনির্ভরতা ব্যাপক বেড়ে যায়। গ্যাসের বার্ষিক সরবরাহ ২০১০ সালে ছিল ৭০০ বিলিয়ন কিউবিক ফুট (বিসিএফ)। বর্তমানে সরবরাহ বছরে তিন হাজার বিসিএফ। অর্থাৎ গত দেড় দশকে গ্যাস সরবরাহ বেড়েছে ২ হাজার ৩০০ বিসিএফ। এর বড় অংশ শুরু থেকে ব্যবহার হচ্ছে বিদ্যুৎ উৎপাদনে। তবে যে হারে গ্যাসের চাহিদা বৃদ্ধি পায়, তার বিপরীতে উদ্যোগ নেয়া হলেও আমদানি গ্যাসে ভরসা ছিল বেশি, যথার্থ ছিল না উদ্যোগ বাস্তবায়নের পরিকল্পনাও।
জ্বালানি বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, ২০০৯ সালের জুন থেকে ২০২৩ সালের জুন পর্যন্ত ছয়টি নতুন গ্যাস ক্ষেত্র পাওয়া যায়। এ সময়ে কূপ খনন করা হয় ১৩২টি।
জ্বালানি বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, যেসব গ্যাস ক্ষেত্র আবিষ্কৃত হয়েছে, সেগুলোর মোট মজুদের পরিমাণ ৯০০ বিসিএফ। এর মধ্যে ২০১১ থেকে ২০১৪ সালের মধ্যে তিনটি গ্যাস ক্ষেত্র আবিষ্কার হয়। বাকি ১০ বছরে আবিষ্কৃত হয় বাকি তিনটি।
২০১০ সালের আগ পর্যন্ত দেশে দৈনিক স্থানীয় গ্যাসের সরবরাহ ছিল ১ হাজার ৭৪৪ মিলিয়ন ঘনফুট। বর্তমানে স্থানীয় গ্যাসের সরবরাহ ২ হাজার ১০০ মিলিয়ন ঘনফুট। গত দেড় দশকে স্থানীয় গ্যাসের উৎপাদন বেড়েছে মাত্র ৩৫০ মিলিয়ন ঘনফুটের মতো। আর এর সঙ্গে যোগ হয়েছে এক হাজার মিলিয়ন ঘনফুট এলএনজি।
স্থানীয় গ্যাস ক্ষেত্র অনুসন্ধানে ২০১০ সালের পরবর্তী সময়ে বাপেক্সের তৎপরতা ছিল সবচেয়ে বেশি। যে কারণে বাপেক্সের মাধ্যমে স্থলভাগে ছয়টি গ্যাস ক্ষেত্র আবিষ্কৃত হয়। এছাড়া বৃহৎ পরিসরে দেশে গ্যাস অনুসন্ধানে বাপেক্স রূপকল্প গ্রহণ করে। এর আওতায় ১০৮টি কূপ খননের উদ্যোগ নেয়া হলেও তা বাস্তবায়ন করা যায়নি।
জ্বালানি বিভাগের কর্মকর্তারা মনে করেন, গ্যাস অনুসন্ধানে গত দেড় দশকে উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। সেখান থেকে ফলও মিলেছে। তবে সাগরে বড় আকারে গ্যাস অনুসন্ধানে না যেতে পারার বিষয়টি অস্বীকার করেননি তারা।
২০০৯-১৪ সাল পর্যন্ত পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান ছিলেন ড. হোসেন মনসুর। গ্যাস খাতে অনুসন্ধান ও বিনিয়োগের বিষয়ে তিনি বণিক বার্তাকে বলেন, ‘গ্যাস খাতের অনুসন্ধান একটা সময় স্থানীয় কোম্পানি বাপেক্স দিয়েই করা হতো। বাপেক্স টুডি-থ্রিডি সার্ভে করেছে।
তাদের সার্ভে দিয়েই গ্যাস অনুসন্ধানে কাজ করা হয়েছে। ছোট গ্যাস ক্ষেত্র হলেও সেই সময় (২০১১-১৪) তিনটি গ্যাস ক্ষেত্র আবিষ্কার হয়েছে। এখন কেন তারা করতে পারছে না? কেন তাদের থামিয়ে দেয়া হলো?’ স্থলভাগে কূপ খননে কেন বাপেক্সের সঙ্গে বিদেশী কোম্পানিকে চুক্তিবদ্ধ হয়ে কাজ করতে হবে—এমন প্রশ্নও তুলেছেন ড. হোসেন মনসুর।
গ্যাস অনুসন্ধান জোরালো করার জন্য বিজয় রিগ ২০১০, ২০১১ ও ২০১২ কেনা হয়েছে। পেট্রোবাংলা এখন ৪৬টি কূপ খননের কাজ বাস্তবায়ন করছে। ২০২৮ সাল নাগাদ আরো ১০০টি কূপ খননের পরিকল্পনা নিয়েছে। ড. হোসেন মনসুর মনে করেন, সরকারি অনুমোদন, দরপত্র আহ্বান, কূপ খনন, যন্ত্রাংশ ক্রয়সহ নানা বিষয় হিসাব করলে এ পরিকল্পনা অবাস্তব।
তিনি বলেন, কূপ খননে বাস্তবসম্মত পরিকল্পনা করতে হবে।’ এলএনজি আমদানি প্রসঙ্গে পেট্রোবাংলার সাবেক এ কর্মকর্তা বলেন, ‘এলএনজি আমদানি আমাদের প্রয়োজন রয়েছে। তবে সেটি দীর্ঘমেয়াদি চুক্তি এবং কত দামে কেনা হচ্ছে সেটাই বিবেচ্য বিষয়।’
মিয়ানমার ও ভারতের সঙ্গে ২০১২ ও ২০১৪ সালে সমুদ্রসীমা নিষ্পত্তি হয়। নিষ্পতির আগে ও পরে সাগরে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানের উদ্যোগ নেয়া হলেও তাতে বড় কোনো সাফল্য মেলেনি, বরং বিদেশী কোম্পানিগুলোর সঙ্গে চুক্তি করা হলেও তারা ব্লক ছেড়ে চলে গেছে। পিএসসির আওতায় ২০০৮ সালে অফশোরের দুটি ব্লকে দরপত্র আহ্বান করা হয়।
ডিএস-৮ ও ডিএস-১০ ব্লকের আওতায় যৌথভাবে গ্যাস অনুসন্ধানে চুক্তি স্বাক্ষর করে কনোকো-ফিলিপস ও বাপেক্স। যদিও এতে বড় কোনো গ্যাস ক্ষেত্র আবিষ্কার হয়নি। একই পদ্ধতিতে ২০১২ সাল পর্যন্ত আরো তিনটি ব্লকের জন্য দরপত্র আহ্বান করা হয়। এর মধ্যে এসএস-৪ ও এসএস-৯ ব্লকে ভারতীয় কোম্পানি ওএনজিসি ভিদেশের সঙ্গে এবং এসএস-১১ ব্লকে সান্তোস-ক্রিসএনার্জির সঙ্গে বাপেক্সের যৌথ অনুসন্ধান কার্যক্রম চলে।
তবে এগুলোয়ও কোনো গ্যাস ক্ষেত্রের সন্ধান পাওয়া যায়নি। এরপর ২০১৬ সালে বিদ্যুৎ, জ্বালানি দ্রুত সরবরাহ আইন-২০১০ (বিশেষ আইন)-এর আওতায় দুই ধাপে পসকো দাইয়ু করপোরেশনকে ডিএস-১০, ১১, ১২ ও এসএস-১০ ব্লক ইজারা দেয়া হয়। অফশোরে ভারতীয় কোম্পানি ওএনজিসি ভিদেশ ছাড়া ইজারা দেয়া অন্য সব প্রতিষ্ঠান ব্লক ছেড়ে চলে যায়।
গ্যাসের চাহিদা বৃদ্ধির সঙ্গে ঘাটতিও শুরু হয়। এরই প্রেক্ষাপটে ২০১৮-১৯ অর্থবছর থেকে শুরু হয় গ্যাস আমদানি। দীর্ঘমেয়াদি ও স্পট মার্কেট থেকে এলএনজি আমদানি করে সরবরাহ করায় ওই অর্থবছর থেকে লোকসানে পড়ে পেট্রোবাংলা। গ্যাস খাতে সরবরাহ ব্যবস্থাপনায় এলএনজির ভূমিকা ২৫ শতাংশ হলেও বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় হচ্ছে আমদানি করতে।
গ্যাস আমদানি করে জ্বালানি সরবরাহ ব্যবস্থা ঠিক রাখতে পেট্রোবাংলাকে কখনো গ্যাস উন্নয়ন তহবিল (জিডিএফ), কখনো অর্থ বিভাগ, আবার কখনো ঋণ করে পরিস্থিতি সামাল দেয়ার চেষ্টা করতে হয়েছে। বর্তমানে সংস্থাটি এলএনজি কিনতে ইসলামিক ট্রেড ফাইন্যান্স করপোরেশনের কাছ থেকে ৫০ কোটি ডলার ঋণ চুক্তি করেছে।
এলএনজি আমদানির পর গত পাঁচ অর্থবছরে (২০১৮-১৯ থেকে ২০২২-২৩) ১ লাখ ১৫ হাজার কোটি টাকার বেশি অর্থ ব্যয় হয়েছে পেট্রোবাংলার।
দেশের গ্যাস খাতের উন্নয়নে ২০১৭ সালে মহাপরিকল্পনা প্রণয়ন করা হয়। ডেনমার্কের প্রকৌশল ও পরামর্শক প্রতিষ্ঠান র্যাম্বলকে দিয়ে এ পরিকল্পনা করে জ্বালানি বিভাগ। সে সময় বাংলাদেশে গ্যাসের চাহিদা ও সরবরাহের ওপর মধ্যম মেয়াদি এক প্রক্ষেপণে সংস্থাটি বলে, ২০২১ থেকে ২০৩০ সাল পর্যন্ত প্রতি বছর বাংলাদেশের চাহিদা পূরণে গ্যাস আমদানিতে ব্যয় হবে ৩০০ কোটি ডলারের বেশি।
এ বিষয়ে র্যাম্বলের সুপারিশ ছিল, আন্তর্জাতিক জ্বালানি কোম্পানির বিনিয়োগের অপেক্ষায় না থেকে এ অর্থ স্থানীয় পর্যায়ে গ্যাস অনুসন্ধান-উন্নয়নে কাজে লাগানো হলে প্রত্যাশিত মাত্রায় সুফল মিলবে। গ্যাস খাতের মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নে র্যাম্বলের করা ওই সুপারিশ গত সাত বছরে বাস্তবায়ন হয়নি।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ও ভূতত্ত্ববিদ অধ্যাপক বদরূল ইমাম বণিক বার্তাকে বলেন, ‘গ্যাস খাতে বড় অনুসন্ধান কার্যক্রম না হওয়ার পেছনে মূলত এ খাতে ইনভেস্টিগেশন কম হয়েছে। যেসব এলাকায় গ্যাস আবিষ্কার হয়েছে, সেখানে আরো বেশি তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণের প্রয়োজন ছিল।
বিশেষ করে পার্বত্য অঞ্চলে গ্যাস অনুসন্ধানে জোরালো উদ্যোগ নেয়ার দরকার ছিল। ২০১২ ও ২০১৪ সালে সমুদ্রসীমা নিষ্পত্তি হওয়ার পরও আমরা গ্যাস অনুসন্ধান করতে পারিনি। গ্যাসের সংকট মোকাবেলায় সহজ উপায় হিসেবে আমদানিনির্ভরতা বাড়িয়েছি, ব্যবসায়িক স্বার্থসংশ্লিষ্টতা বাড়িয়েছি। এখন পেট্রোবাংলা গ্যাস খাতের উন্নয়ন করতে গিয়ে অর্থ সংকটে পড়েছে। উচ্চ মূল্যে গ্যাস কিনে গ্রাহকের কাছ থেকে সে তুলনায় অর্থ পাচ্ছে না।’
সরকারের বিদ্যুৎ ও গ্যাসের সমন্বিত মহাপরিকল্পনা অনুযায়ী, ২০৩৪ সাল নাগাদ গ্যাসের মজুদ শেষ হয়ে যাবে। স্থানীয় গ্যাসের উৎপাদন বাড়াতে পেট্রোবাংলা ৪৬টি কূপ খননের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করছে। ২০৩০ সাল নাগাদ আরো ১০০টি কূপ খননের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। সেই সঙ্গে সমুদ্রে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে আন্তর্জাতিক দরপত্র আহ্বান করেছে সরকার। এরই মধ্যে দরপত্র আহ্বান চেয়ে বিজ্ঞাপন দিয়েছে।
বাপেক্সের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের সাবেক সদস্য মকবুল ই-ইলাহী চৌধুরী বণিক বার্তাকে বলেন, ‘গ্যাস খাতে বড় অনুসন্ধান কার্যক্রমে না যেতে পারার পেছনে কারণ গ্যাসের সহজপ্রাপ্যতা ও সহজ সমাধান হিসেবে আমদানিনির্ভরতা। এর পাশাপাশি যেসব নিয়ম-প্রক্রিয়া অনুসরণ করে এ খাতে কাজ করার দরকার ছিল, সেগুলো করা যায়নি।’ তিনি মনে করেন, দেশের গ্যাস খাতে বড় অনুসন্ধানে বিদেশী কোম্পানিকে আনতে হলে তথ্য-উপাত্ত উন্মুক্ত-অবারিত রাখার প্রয়োজন ছিল।
তিন হাজার লাইন কিলোমিটার অফশোরে জরিপ আগেই করা ছিল। পেট্রোবাংলা বিদেশী বিভিন্ন কোম্পানি দিয়ে ১০ হাজার লাইন কিলোমিটার জরিপ করিয়েছিল। এসব তথ্য উন্মুক্ত থাকলে আন্তর্জাতিক তেল কোম্পানিগুলো (আইওসি) স্টাডি করে একটা সিদ্ধান্তে আসতে পারত। জার্মানির স্লামবার্জার কোম্পানিকে দিয়ে জরিপ করানোর কোনো প্রয়োজন ছিল না।
গ্যাসের অনুসন্ধান কার্যক্রমে ভূরাজনৈতিক কোনো প্রভাব ছিল কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আসলে ভূরাজনৈতিক কারণ থাকার কোনো কারণ নেই। সমুদ্রসীমা কিংবা স্থলভাগের সীমানায় গ্যাসের অস্তিত্ব আরো বেশি পাওয়া গেলে সেটি প্রতিবেশী দেশগুলোর জন্য আরো ভালো।’
আপনার মতামত জানানঃ