রাজধানীর বেইলি রোডে সাত তলা একটি বাণিজ্যিক ভবনে ভয়াবহ আগুনে নিহতদের মরদেহ পরিবারের কাছে হস্তান্তর চলছে। ঢাকার জেলা প্রশাসক আনিসুর রহমান জানিয়েছেন, নিহত ৪৬ জনের মধ্যে ৩৮ জনের পরিচয় সনাক্ত করা গেছে। এখনো পর্যন্ত সাত জনের পরিচয় সনাক্ত করা যায়নি।
এখনো ৮টি মরদেহ হস্তান্তর বাকি রয়েছে বলে স্বাস্থ্যমন্ত্রীর এক সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়েছে। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ৩৪ জন, শেখ হাসিনা বার্ন ইউনিটে ১০ জন এবং পুলিশ হাসপাতালে এক জন মারা গেছে।
এর আগে জেলা প্রশাসক আনিসুর রহমান বলেন, “আমরা ইতিমধ্যে ২৪টি লাশ হস্তান্তর করেছি। ২১ জন এখনো প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। স্বজনরা আসছেন। আমাদের কাজ চলমান আছে।”
মি. রহমান জানান, আগুনের ঘটনা কমপক্ষে ৬০ থেকে ৭০ জনের মতো আহত হয়েছে। এদের মধ্যে বেশিরভাগই তিনটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। এগুলো হচ্ছে, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, শেখ হাসিনা বার্ন ইউনিট এবং রাজারবাগ পুলিশ হাসপাতাল।
তবে ব্যক্তিগত উদ্যোগেও অনেকে আশেপাশের আরো অনেক হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন বলে জানিয়েছেন তিনি। অনেকেই চিকিৎসা নিয়ে বাড়িতেও চলে গেছেন বলে জানান তিনি।
হাসপাতালে যারা চিকিৎসাধীন আছেন তাদের মধ্যে অনেকের অবস্থা আশঙ্কাজনক বলে চিকিৎসকরা জানিয়েছেন। এর আগে ঘটনাস্থল থেকে ৭৫ জনকে জীবিত উদ্ধার করা হয়েছে।
অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় স্বাস্থ্যমন্ত্রী ডা. সামন্ত লাল সেন এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, নিহতের সংখ্যা বেড়ে ৪৬ হয়েছে। যারা মারা গেছেন তাদের মধ্যে বেশিরভাগ কার্বন মনোক্সাইড নামে বিষাক্ত গ্যাস নিঃশ্বাসের সাথে গ্রহণ করার কারণে মারা গেছেন। আহতদের মধ্যেও অনেকেই এই গ্যাস নিঃশ্বাসের সাথে গ্রহণ করেছেন।
বদ্ধ ঘরে আটকে পড়ার কারণে তারা এই গ্যাসের সংস্পর্শে এসেছেন। “একটা বদ্ধ ঘরে যখন বেরুতে পারে না, তখন এই ধোয়াটা শ্বাসনালীতে চলে যায়। প্রত্যেকেরই তা হইছে। যাদের খুব বেশি হইছে তারা বাঁচতে পারে নাই, অত্যন্ত দুঃখজনকভাবে তারা মারা গেছে। এখনো যারা আছে তারা কেউ শঙ্কামুক্ত না।”
তিনি জানান, বার্ন ইন্সটিটিউটের চিকিৎসকদের সাথে তিনি বৈঠক করে আহতদের চিকিৎসার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবেন।
হাসপাতালে ভিড় না করারও আহ্বান জানিয়েছেন তিনি।
স্বাস্থ্যমন্ত্রী জানিয়েছেন, আহতদের দ্বায়িত্ব নেয়ার কথা জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। সরকারের পক্ষ থেকে চিকিৎসার জন্য সব কিছু করা হবে বলে জানান তিনি।
৮ টা মরদেহ এখনো হস্তান্তর করা বাকি আছে। আহত অবস্থায় বার্ন ইন্সটিটিউটে ১০ জন, ঢাকা মেডিকেল কলেজে ০২ জন চিকিৎসাধীন রয়েছেন। বার্ন ইন্সটিটিউটে থাকা সবারই শ্বাসনালী পুড়ে গেছে এবং কেউই শঙ্কামুক্ত নন বলেও জানিয়েছেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী।
যা ঘটেছিল
বৃহস্পতিবার রাত দশটার দিকে গ্রিন কজি কটেজ নামে একটি ভবনে আগুনের সূত্রপাত হয়। এরপর খুব অল্প সময়েই পুরো ভবনে আগুন ছড়িয়ে পড়ে। ভবনটির নিচের দিকে আগুন লাগে এবং পড়ে তা উপরে ছড়িয়ে পড়ে।
নিচতলায় আগুন লাগার কারণে ভবনটির উপরের তলাগুলোতে আটকে পড়েন অনেকে। প্রাণ বাঁচানোর জন্য উপর থেকে মানুষ লাফিয়ে পড়ে। সিঁড়ি দিয়ে নামার চেষ্টা করেও পারেনি অনেকে।
প্রত্যক্ষদর্শীরা কেউ কেউ জানিয়েছেন, দুই বা তিন তলা থেকে লাফিয়ে পড়ে অনেকে হাত পা ভেঙ্গে আহত হয়েছেন। তবে তারা বেঁচে গেছেন। ফায়ার সার্ভিস জানিয়েছে, সিঁড়িতে গ্যাস সিলিন্ডার থাকার কারণে পুরো সিঁড়িটি ‘অগ্নি চুল্লির’ মতো হয়ে গিয়েছিল। যার কারণে কেউ সিঁড়ি ব্যবহার করে নামতে পারেনি।
সিঁড়ি দিয়ে এক সাথে তিন জনের বেশি যাতায়াত করা যেতো না বলেও জানা গেছে।।
ফায়ার সার্ভিস বলছে, যারা মারা গেছে তাদের বেশিরভাগ আগুনে পুড়ে নয়, বরং তারা আসলে ধোয়ার কারণে নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে মারা গেছেন। এর আগে তারা অচেতন হয়ে পড়েছিল।
ভবনটির আগুন নেভানোর তেমন কোন ব্যবস্থা ছিল না বলেও জানিয়েছে ফায়ার সার্ভিস। তবে আগুন আশপাশের ভবনে ছড়িয়ে পড়েনি।
প্রত্যক্ষদর্শীদের বরাতে ও প্রাথমিক অনুসন্ধানে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে র্যাব-৩ এর এএসপি কামরুল হাসান বলেন, স্যামসাং শোরুমের পাশের কফি হাউস থেকে প্রথম আগুনের সূত্রপাত হয়। প্রত্যক্ষদর্শীরা নিচ থেকে আগুন উপরের দিকে উঠতে দেখেছেন। প্রথমে দোতলায় তারপর তা পুরো ভবনে ছড়িয়ে যায়। আগুনে পুরো ভবন ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার দৃশ্য রাতের অন্ধকারেও টের পাওয়া যাচ্ছিল বাইরে থেকে।
বেইলি রোডে নওরতন কলোনিতে থাকেন সাহাবুদ্দিন তালুকদার। প্রতিদিনের মতো শুক্রবার সকালে প্রাতভ্রমণের পোশাক পরে বাসা থেকে বেরিয়ে পুড়ে যাওয়া ভবনের কাছে দাঁড়িয়ে যান; বিমূঢ় চোখে দেখছিলেন বিভীষিকাময় ভবনটি।
সাহাবৃদ্দিন বলেন, “রাতে না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না যে, কী হয়েছিল এখানে। বিকট শব্দ আর আগুনের লেলিহান শিখা দেখে মনে হয়েছে এটা দোজখের আগুন।
“শুনেছি গ্যাস সিলিন্ডারগুলো থেকে আগুনের সূত্রপাত। এভাবে বিল্ডিংয়ে গ্যাস সিলিন্ডার প্রায় দোকানগুলোতেই আছে, চুটিয়ে ব্যবসা করছে। কিন্তু মানুষের জীবনের নিরাপত্তার দিকটা দেখার নেই।”
হাসপাতালের চিত্র কী?
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল এবং শেখ হাসিনা বার্ন ইউনিটে আহতদের বেশিরভাগ চিকিৎসাধীন রয়েছেন। এর মধ্যে ঢাকা মেডিকেলে ১৪ জন এবং শেখ হাসিনা বার্ন ইউনিটে আট জন চিকিৎসাধীন রয়েছে।
চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, যারা আহত রয়েছে তাদের মধ্যে অনেকের অবস্থা আশঙ্কাজনক।
কারণ অনেকের দেহের ৯০ শতাংশ পর্যন্ত পুড়ে গেছে। অনেকের শ্বাসনালীও পুড়ে গেছে বলে জানা যাচ্ছে। হাসপাতালে ভিড় করেছেন স্বজনরা। সকালেও কয়েকজনের মরদেহ নিয়ে চলে যেতে দেখা গেছে।
স্থানীয় সংবাদ মাধ্যমের খবরে বলা হয়, বৃহস্পতিবার রাতে ঢাকা মেডিকেলের জরুরি বিভাগে তিনটি মরদেহ এবং অচেতন অবস্থায় আরো ৩৩ জনকে আনা হয়।
পরে চিকিৎসকরা জানান, এদের মধ্যে বেশিরভাগকেই মৃত্যু অবস্থায় হাসপাতালে আনা হয়। আর হাসপাতালে আনার পরও মারা যান অনেকে।
জেলা প্রশাসক আনিসুর রহমান জানিয়েছেন, নিহতদের দাফনের খরচের জন্য ২৫ হাজার টাকার একটি তহবিল গঠন করা হয়েছে। তবে এখনো পর্যন্ত কেউই এই তহবিল থেকে খরচ নিতে আগ্রহ দেখাননি বলেও তিনি জানান।
আপনার মতামত জানানঃ