রফতানি পণ্যের চালান দেশ থেকে সমুদ্র, নৌ, আকাশ বা স্থলপথে বেরিয়ে যাওয়ার আগে কাস্টমস কর্তৃপক্ষ সংশ্লিষ্ট নথির সঙ্গে তা যাচাই-বাছাই করে। নিয়ম অনুযায়ী বন্দরে পণ্যবাহী চালান পরিবহনের আগে কাস্টমস তথা জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সফটওয়্যার অ্যাসাইকুডা ওয়ার্ল্ড সিস্টেমে রফতানির তথ্য প্রবেশ করানো হয়। এ পদ্ধতিতে এনবিআরের হিসাব রক্ষণাবেক্ষণের স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থা অ্যাসাইকুডায় স্থান পায় রফতানির শুল্কায়ন মূল্য বা অ্যাসেসড ভ্যালু।
কাস্টমস কর্তৃক সর্বশেষ সাত মাসে মোট রফতানির অ্যাসেসড ভ্যালু ২৬ বিলিয়ন ডলার। আবার গত ৪ ফেব্রুয়ারি রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) প্রকাশিত পরিসংখ্যান বলছে, এ সময়ে বাংলাদেশ থেকে রফতানি হয়েছে ৩৩ বিলিয়ন ডলারের পণ্য। যদিও ইপিবির দাবি, এনবিআর তথা কাস্টমসের তথ্যের ভিত্তিতেই তারা এ পরিসংখ্যান প্রকাশ করেছে।
অ্যাসাইকুডার তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩-২৪ অর্থবছরের সাত মাসে ৩৮ লাখ ৫২ হাজার ৫০৩ টন পণ্য রফতানি হয়েছে। এ পরিমাণ পণ্য রফতানির অর্থমূল্য ছিল ২ লাখ ৮৬ হাজার ৫২৪ কোটি ৬০ লাখ ৭২ হাজার ৮২০ টাকা। ডলারপ্রতি ১১০ টাকা বিনিময় হার ধরে হিসাব করলে অর্থমূল্যে রফতানির পরিমাণ দাঁড়ায় ২ হাজার ৬০৪ কোটি ৭৪ লাখ ৯১ হাজার ৫৭১ বা ২৬ বিলিয়ন ডলারের কিছু বেশি।
দুই সংস্থার পরিসংখ্যানে ৭ বিলিয়ন ডলারের বৈসাদৃশ্যের কারণ নিয়ে অনুসন্ধান করা প্রয়োজন বলে মনে করছেন বৈদেশিক বাণিজ্যের পর্যবেক্ষকরা। তারা বলছেন, অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ সূচক রফতানির তথ্য নিয়ে এ ধরনের বিভ্রান্তি কাম্য নয়। বিষয়টি এখন জাতীয় অর্থনীতির লক্ষ্য নির্ধারণ, নীতি প্রণয়ন থেকে শুরু করে সার্বিক পরিস্থিতিকে জটিল করে তুলছে। পরিসংখ্যানের এ বড় ফারাক কোনোভাবেই কাম্য নয়। আবার উভয় তথ্যেরই উৎস এক দাবি করা হচ্ছে। এ অবস্থায় সরকারের গোটা বাণিজ্য পরিসংখ্যান নিয়েই বড় ধরনের অনাস্থা তৈরি হচ্ছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্রতিবেশী দেশ ভারতে রফতানির সব তথ্য তৈরি হয় ভারতীয় কাস্টমসের কাছে পেশ হওয়া শিপিং বিল এবং চালানভিত্তিক তথ্যের পদ্ধতিগত সংকলনের মাধ্যমে। যেখানে ভারতীয় সমুদ্রবন্দর, আইসিডি, সিএফএস এবং বিমানবন্দর থেকে সমুদ্র ও বিমান চালানের সব রফতানির রেকর্ড থাকে। বাণিজ্য পরিসংখ্যান তৈরিতে কাস্টমস পর্যায়ের তথ্যকেই উৎস হিসেবে ব্যবহার করা হয় বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশে বসবাসরত যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য-সংশ্লিষ্টরাও। এসব দেশে সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর তথ্যেও বৈসাদৃশ্য দেখা যায় না।
বিষয়টি নিয়ে উষ্মা প্রকাশ করেছেন ব্যবসায়ীরাও। বিশেষ করে ইপিবির তথ্যকে অগ্রহণযোগ্য বলে মনে করছেন তারা। এ বিষয়ে তাদের বক্তব্য হলো এ তথ্যের সঙ্গে ছোট বা বড় কোনো প্রতিষ্ঠানের রফতানির বাস্তবতার কোনো সংগতি নেই। বরং কাস্টমস ও বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যকে বেশি গ্রহণযোগ্য বলা যায়।
বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম গণমাধ্যমকে বলেন, ‘সরকারি তথ্যের সঙ্গে আমাদের হিসাব কোনোভাবেই মিলছে না। পরিমাণ যদি না বাড়ে আর আমরা যদি ইউনিটপ্রতি দাম বেশি না পাই তাহলে রফতানি কীভাবে বাড়ে? ছোট-বড় সব রফতানিকারকই বলছেন, তাদের রফতানি কমেছে। তাহলে রফতানি আসলে কাদের বাড়ল?
২০২২-২৩ অর্থবছরের অর্ধেক পেরুনোর আগেই যখন রফতানির অর্থমূল্য ৫ বিলিয়ন ডলারের বেশি দেখানো হলো, তখন পোশাক রফতানিকারকদের অনেকেই বলেছিলেন হিসাব মিলছে না। পোশাক মালিকদের ইউটিলাইজেশন ডিক্লারেশনের তথ্যের সঙ্গে তুলনা করলেও হিসাব মেলে না। সরকারি তথ্য চ্যালেঞ্জ করছি না। কিন্তু এ হিসাব বাস্তবতার সঙ্গে মিলছে না।’
অনেকটা একই বক্তব্য রেখে আরডিএম গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক রাকিবুল আলম চৌধুরী গণমাধ্যমকে বলেন, ‘রফতানি তথ্য নিয়ে গত বছর একটি সভায় বাংলাদেশ ব্যাংক, ইপিবি ও এনবিআরের গরমিল হিসাব আমরা পাই। কয়েক বিলিয়ন ডলার কীভাবে গ্যাপ হয়, সেটি যখন জানতে চাওয়া হয় তার কোনো সদুত্তর ইপিবি আমাদের দিতে পারেনি।’
তথ্যের এ ব্যবধান নিয়ে এনবিআরের বেশ কয়েকজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলেছে বণিক বার্তা। নাম অপ্রকাশিত রাখার শর্তে তারা জানান, রফতানির তথ্যে ইপিবির সঙ্গে এনবিআরের ব্যবধানটিও বেশ বড়। আমদানি-রফতানির ক্ষেত্রে মাঠ পর্যায়ে কাজ করে এনবিআর। এখন শুল্ক-কর না থাকায় এনবিআরের কাছে যে রফতানি-সংক্রান্ত তথ্য সংরক্ষিত আছে সেটি কোনোভাবে বেশি-কম হওয়ারও সুযোগ নেই। এমনকি বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যের সোর্সও এনবিআর। বাংলাদেশ ব্যাংকে যেমন এলসি খোলার তথ্য থাকে কিন্তু সেই পণ্য রফতানি হলো কিনা সেটা বলতে পারবে এনবিআর।
একই উৎসের পরিসংখ্যানের পার্থক্য নিয়ে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন ইপিবির ভাইস চেয়ারম্যান এএইচএম আহসানও। গণমাধ্যমকে গতকাল তিনি বলেন, ‘পরিসংখ্যানের উৎস একই। এতে এতটা ব্যবধান হবে না। হয়তোবা ডলারের ভিন্ন ভিন্ন বিনিময় হার হিসাবের কারণে পার্থক্য হতে পারে, কিন্তু এত বড় ব্যবধান হওয়ার কথা না। যাচাই-বাছাই না করে এনবিআরের সঙ্গে কথা না বলে এ মুহূর্তে কোনো উত্তর দেয়া সম্ভব হবে না। বিষয়টি বিশ্লেষণ করে দেখা হবে।’
নাম অপ্রকাশিত রাখার শর্তে এনবিআরের এক সদস্য গণমাধ্যমকে বলেন, ‘দুই তথ্যের উৎস যদি অ্যাসাইকুডা হয়, তাহলে তো দুই ধরনের তথ্য আসার কোনো কারণ নেই। বর্তমানে রফতানি তথ্যের ভিন্নতা নিয়ে ইপিবি, এনবিআর ও বাংলাদেশ ব্যাংক সমন্বিতভাবে কাজ করছে।’
ব্যবসায়ীরা বলছেন, রফতানির তথ্যে অসামঞ্জস্যতা গোটা খাতের জন্য বড় ধরনের অসুবিধা তৈরি করতে পারে। তথ্যের অসামঞ্জস্যতা প্রাতিষ্ঠানিক পরিকল্পনা বাস্তবায়নের পথে বড় অন্তরায় হয়ে দেখা দিতে পারে উল্লেখ করে চট্টগ্রামভিত্তিক এশিয়ান গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ আবদুস সালাম গণমাধ্যমকে বলেন, ‘পোর্ট এন্ট্রি ও পোর্ট থেকে এক্সিট—এ দুইয়ের প্রকৃত হিসাব থাকে এনবিআরের কাছে। কারণ এই দুই জায়গায় পণ্যের পরিমাণ ও ভ্যালু হিসাব করে এনবিআরের অধীনে থাকা কাস্টমস কর্তৃপক্ষ। এখন ভুল তথ্য সরবরাহ হলে এটার ওপর ভিত্তি করে আমরা যে পরিকল্পনা করব সেখানে ভালো ফল আসবে না।’
ইপিবির সঙ্গে শুধু এনবিআর নয়, বাংলাদেশ ব্যাংকেরও রফতানি পরিসংখ্যানে বড় ব্যবধান দেখা যাচ্ছে দীর্ঘদিন ধরে। সর্বশেষ ২০২২-২৩ অর্থবছরে তা রেকর্ড ১২ বিলিয়ন ডলার স্পর্শ করে। সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যের সঙ্গে ইপিবির রফতানির তথ্যের পার্থক্যের একাধিক কারণ থাকতে পারে। দুই সংস্থার পরিসংখ্যান সংকলন ও রক্ষণাবেক্ষণের ভিন্নতার কারণেই ওই পার্থক্য হয়। কিন্তু ইপিবি দাবি করছে প্রকাশিত পরিসংখ্যানের উৎস এনবিআর। সেক্ষেত্রে কাস্টমস তথা এনবিআরের সঙ্গেই এত বড় বৈসাদৃশ্যপূর্ণ পরিসংখ্যানের কোনো যৌক্তিকতা নেই।
এ বিষয়ে প্যাসিফিক জিন্স গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ এম তানভীর গণমাধ্যমকে বলেন, ‘ইপিবির যে ডাটা সেটা ই-এক্সপির ওপর, আবার বাংলাদেশ ব্যাংকের ডাটা রেমিট্যান্স যেটা আসে অর্থাৎ এক্সপোর্ট প্রসিডের ওপর। এ তথ্যগুলো যদি একসঙ্গে প্রকাশ করা হয় তাহলে তথ্যগত সমস্যাটা হওয়ার কথা ছিল না। যেমন বলে দিতে হবে কোনটা ই-এক্সপি আর কোনটা রিয়েলাইজেশন। ভিন্ন ভিন্ন সংস্থার ভিন্ন তথ্যের কারণে এক্সপোর্টের পুরো চিত্রটা আমরা সঠিকভাবে পাচ্ছি না। সেটা কি বোঝাপাড়ার ভুল কিনা সেটাও যাচাই করা প্রয়োজন। তাই এনবিআরের সঙ্গে ইপিবির কেন ডিফারেন্সটা হচ্ছে সেটা ক্লারিফাই করে নেয়াটা জরুরি।’
বাণিজ্য খাতসংশ্লিষ্ট বিশ্লেষকরা বলছেন, বিশ্বের সব দেশেই কাস্টমস পর্যায় থেকেই বাণিজ্য পরিসংখ্যান তৈরি করা হয়। সেটা পার্শ্ববর্তী ভারত হোক বা পশ্চিমা দেশ যুক্তরাষ্ট্র। সেই তথ্য প্রকাশের এখতিয়ার দেশভেদে ভিন্ন হতে পারে। কিন্তু সব দেশই কাস্টমস পর্যায় থেকেই বাণিজ্য তথ্য-উপাত্ত সংকলন করে।
ওয়েল গ্রুপের পরিচালক ও বিজিএমইএর প্রথম সহসভাপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম গণমাধ্যমকে বলেন, ‘আমরা বাস্তবে যেটা দেখছি তাতে ৮০ শতাংশ প্রত্যেক ম্যানুফ্যাচারার বলছে তাদের ক্যাপাসিটির তুলনায় ৩০ শতাংশ পর্যন্ত অর্ডার কম। বিশেষ করে বিভিন্ন নামিদামি ব্র্যান্ডের সঙ্গে বাংলাদেশের যেসব বড় প্রতিষ্ঠান কাজ করে তাদের পরিস্থিতি সবচেয়ে খারাপের দিকে। আমরা ইউডির যে ক্যালকুলেশন করি সেখানেও কম দেখাচ্ছে। এখন টোটাল রফতানির যে তথ্যচিত্র আমাদের সামনে আসছে সেটা কোনোভাবেই যৌক্তিক মনে করছি না। এ রেকর্ড কীভাবে কিসের ওপর ভিত্তি করে দিয়েছে সেটা জানি না। তবে এটা নিশ্চিতভাবেই বলতে পারি চলতি অর্থবছরের যে সময়টা পার হলো তাতে আমাদের ক্যাপাসিটির তুলনায় ব্যাপক হারে ক্রয়াদেশ কমেছে।’
আপনার মতামত জানানঃ