বিএনপি এবং তার মিত্র জোটের বর্জনের মধ্যেই টানা চতুর্থবার নির্বাচনে জয়ী হয়ে সরকার গঠন করেছে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। দ্বাদশ সংসদের প্রথম অধিবেশন শুরু হচ্ছে ৩০শে জানুয়ারি।
গত এক বছরের বেশি সময় ধরে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন এবং সরকারের পদত্যাগের দাবিতে আন্দোলন করে আসছিল বিএনপি। শেষ পর্যন্ত বিএনপি এবং তার রাজনৈতিক মিত্ররা নির্বাচন বর্জন করে।
নির্বাচনের কয়েকদিন আগে থেকে দলটি কঠোর কর্মসূচি থেকে সরে এসে লিফলেট বিতরণের মতো কর্মসূচি দেয়। নির্বাচনের পর বিএনপি এবং সমমনা দলগুলো কালোপতাকা মিছিল কর্মসূচি পালন করছে ঢাকা এবং সারাদেশে।
ফলে এখন প্রশ্ন উঠেছে, নির্বাচন বর্জন করে কি কোনো রাজনৈতিক অর্জন হলো বিএনপির? যদিও দলটির ভাইস চেয়ারম্যান নিতাই রায় চৌধুরী বিবিসি বাংলাকে বলেছেন, নির্বাচন বর্জন করে বিএনপি জয়লাভ করেছে।
তবে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, একটি নির্বাচন হয়ে যাওয়ার পরে বাংলাদেশে আন্দোলনের মাধ্যমে সরকার পতনের তেমন কোনো সুযোগ থাকে না। ফলে বিএনপি যে লক্ষ্যের কথা বলছে সেটি অর্জন করা দুরূহ।
রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ নিয়ে আলোচনা
বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব বলছেন, ভোট বর্জন করে আন্দোলনের সিদ্ধান্তই সঠিক ছিল। তারা মনে করেন, সাতই জানুয়ারির নির্বাচনে কম ভোটারের উপস্থিতিই বিএনপির সবচেয়ে বড় সফলতা।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদের মেয়াদ শুরু হচ্ছে মঙ্গলবার। এখন নতুন করে বিএনপির রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ নিয়েও আলোচনা চলছে। দলটির বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মীরা বলছেন, এখন আন্দোলনে সফলতা এবং ব্যর্থতা নিয়ে দলের মধ্যে নানা মূল্যায়ন যেমন চলছে, তেমনি আলোচনা হচ্ছে আন্দোলনের ভবিষ্যৎ নিয়েও।
বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান নিতাই রায় চৌধুরী বিবিসি বাংলাকে বলেন, “এই নির্বাচন বর্জনে বিএনপি জয়লাভ করেছে, পরাজিত হয়েছে আওয়ামী লীগ।”
শিগগিরই নতুন নতুন কর্মসূচির মাধ্যমে ‘কর্মীদের মনোবল ফিরিয়ে সফল আন্দোলনে’র আশার কথাও বলছেন তারা। এক্ষেত্রে মাঠের আন্দোলনে নেতাকর্মীদের সক্রিয় করার পাশাপাশি, কূটনীতিক তৎপরতা বাড়ানোর কথা বলছে দলটি।
দলের তৃণমূল থেকে শুরু কেন্দ্র পর্যন্ত বেশিরভাগ নেতাকর্মীই মনে করেন, সাতই জানুয়ারির নির্বাচনের না যাওয়ার সিদ্ধান্তের কোনো বিকল্প ছিল না তাদের কাছে।
মি. চৌধুরী দাবি করেছেন, “নানা ধরনের ভয়ভীতি দেখানোর পরও এ নির্বাচন দেশের ৯০ থেকে ৯৫ ভাগ মানুষ প্রত্যাখ্যান করেছে।” তিনি বলেন, “নির্বাচন বিএনপি বর্জন করেছে, প্রতিহত করেনি। বিএনপি যদি নির্বাচন প্রতিহত করতে চাইতো, তাহলে নির্বাচন হতো না। সাতই জানুয়ারির নির্বাচন বর্জনের সিদ্ধান্ত ২০০ পার্সেন্ট সঠিক ছিল।”
সাতই জানুয়ারির নির্বাচনে সারাদেশে ভোটার উপস্থিতি ছিলও তুলনামূলক অনেক কম। ভোটের পর এর হার নিয়ে নির্বাচন কমিশনের বক্তব্য নিয়েও বিভ্রান্তি ছিল। শেষ পর্যন্ত আনুষ্ঠানিক যে ফল ঘোষণা হয় সেখানে দেখা যায় ভোট পড়েছে ৪১ দশমিক ৮ শতাংশ।
বিএনপির সাবেক সংসদ সদস্য এবং যুগ্ম মহাসচিব হারুন অর রশিদ বিবিসিকে বলেন, “বিএনপির আহবানে মানুষ যে সাড়া দিয়েছে তা সারা বিশ্বের মানুষ দেখেছে। জনগণ এই সরকারের অধীনে প্রহসনের নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে নাই। এটাই বিএনপির সবচেয়ে বড় অর্জন।”
ভোট বর্জনে বিএনপির অর্জন কী?
বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব নির্বাচনে না গিয়ে দল রাজনৈতিকভাবে লাভবান হয়েছে বলে দাবি করলেও রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, একটি নির্বাচন হয়ে যাওয়ার পরে বাংলাদেশে আন্দোলনের মাধ্যমে সরকার পতনের তেমন সুযোগ থাকে না। ফলে বিএনপিকে অপেক্ষা করতে হবে আরও পাঁচ থেকে দশ বছর।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক মহিউদ্দিন আহমদ বিবিসি বাংলাকে বলেছেন, কম ভোটার উপস্থিতি ছাড়া বিএনপির এই আন্দোলনে প্রাপ্তি তেমন কিছু নাই।
মি. আহমদ বলেছেন, “আওয়ামী লীগ শুরু থেকেই চায়নি বিএনপি এ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করুক। এজন্য তারা বিএনপির কাউকে কাউকে হয়তো উৎকোচ দিয়ে ভোটে আসতে বাধা দিয়েছে।”
তিনি বলছেন, আন্তর্জাতিক তৎপরতা ও দেশের এত মানুষের সমর্থন নিয়ে বিএনপি যে জনপ্রিয় দল তা প্রমাণে নির্বাচন ছাড়া অন্য তো কোনো পথ খোলা নেই। তিনি প্রশ্ন তোলেন, “তাহলে বর্জন করে আন্দোলন করলে লাভ কী?”
তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিলের পর ২০১৪ সালের দশম সংসদ নির্বাচন বিএনপি বর্জন করে প্রতিহত করার ঘোষণা দিলেও শেষ পর্যন্ত নির্বাচনে জিতে ক্ষমতায় টিকে যায় আওয়ামী লীগ।
নির্বাচনের পর টানা কয়েক মাস বিএনপি অবরোধের কর্মসূচি পালন করার পর এক পর্যায়ে সেটি ব্যর্থ হয়ে যায়। এরপর ২০১৮ সালের নির্বাচনে বিএনপি অংশ নেয় এবং বিতর্কিত সে নির্বাচনে দলটির সাতজন এমপি সংসদেও ছিলেন অনেক দিন।
কয়েক বছরের বিরতির পর ২০২২ সালের অক্টোবরে দেশের সব কয়টি বিভাগে টানা বিভাগীয় সমাবেশের কর্মসূচি দিয়ে বিএনপি সারাদেশের নেতাকর্মীদের মধ্যে এক ধরনের উদ্দীপনা তৈরি করে। প্রায় প্রতিটি সমাবেশে বিপুল সংখ্যক নেতাকর্মীর উপস্থিতি দলের কর্মীদের মনোবল অনেকটাই বাড়িয়ে দিয়েছিল।
এছাড়া ২০১৪ সাল এবং ২০১৮ সালের নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা প্রশ্নের মুখে পড়েছিল দেশে-বিদেশে। এবার বেশ আগে থেকেই আমেরিকা, ব্রিটেন এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন বিভিন্ন সময় অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের তাগিদ দিয়ে আসছিল।
সেই সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র এবং পশ্চিমা দেশগুলো ভিসা নিষেধাজ্ঞাসহ নানা ইস্যুতে এক ধরনের চাপ সৃষ্টি করে সরকারের ওপর, যা বিএনপির নেতাকর্মীদের মনে আশা সঞ্চার করে।
কিন্তু ২০২৩ সালের ২৮শে অক্টোবরের পর সে পরিস্থিতি বদলে যায়। ওইদিন বিএনপির হাজার হাজার নেতা-কর্মী দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে এসে ঢাকায় জড়ো হয়েছিল। কিন্তু সংঘাত শুরুর পর পুলিশ এক পর্যায়ে তাদের রাস্তা থেকে হটিয়ে দেয়। এরপর দলটির মহাসচিবসহ কেন্দ্রীয় নেতাদের অনেকেই একে একে গ্রেফতার হন, কেউ কেউ আত্মগোপনে চলে যান।
বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব হারুন অর রশিদ দাবি করেছেন, সারাদেশে ২০ থেকে ২৫ হাজার বিএনপি নেতাকর্মী এখন জেলে রয়েছেন, এবং হাজারো নেতাকর্মী গ্রেফতার আতংকে বাড়ি ছাড়া রয়েছেন।
“মিথ্যা মামলা দিয়ে বিএনপিকে মাঠ থেকে সরিয়ে দেয়ার নানা চেষ্টা করা হয়েছে।” তবে গত দুই সপ্তাহে বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতাদের অনেককে মামলা থেকে জামিন পেতে দেখা গেছে।
নির্বাচনের আগে ও পরে মোট ৭৪ দিন বন্ধ থাকার পর গত ১১ই জানুয়ারি বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের তালা খুলে প্রবেশ করেন দলটির নেতাকর্মীরা। এমন পরিস্থিতিতে দলটির নির্বাচন বর্জন থেকে ঠিক কী অর্জন হয়েছে, তা নিয়ে দলটির ভেতরে এবং বাইরে নানা প্রশ্ন আছে।
মহিউদ্দিন আহমদ বলেন, “এদেশের মানুষ ‘ফ্রি এন্ড ফেয়ার ইলেকশন’ চায় সে আকাঙ্ক্ষা প্রতিফলিত হয়েছে বিদেশিদের কথায়। কিন্তু তারা কোনো দলকে এনে ক্ষমতায় বসিয়ে দেবে না।”
নির্বাচন ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক ড. তোফায়েল আহমেদও বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে আশাবাদী নন। তিনি বলেন, “একটা সময় কূটনীতিতে কাউকে কাউকে জোর করে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দেয়ার বিষয় ছিলও। এখন তো আর সেই যুগ নাই। যেখানে আন্দোলন করে নির্বাচন বন্ধ করা যায়নি, সেখানে আন্দোলনের মাধ্যমে সরকারের পতন কীভাবে সম্ভব?”
আপনার মতামত জানানঃ