নির্বাচনকে ঘিরে সাম্প্রতিক ঘটনাপ্রবাহে স্পষ্ট হয়েছে যে ‘বিশ্বাসযোগ্যতার মোড়কে’ আয়োজিত দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন আরও প্রশ্নবিদ্ধ হতে চলেছে। আর সরকার ‘বাংলাদেশে বিশেষ এই নির্বাচন কার্যক্রম’ বাস্তবায়নে মরিয়া।
আগামী ৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠেয় নির্বাচনের ব্যালট পেপারে ‘সত্যিকার কোনো বিরোধী প্রার্থীর’ উপস্থিতি থাকছে না; বরং ওই নির্বাচনে আওয়ামী লীগের অসংগঠিত প্রার্থীদের মধ্য থেকে ভোটারদের একজনকে বেছে নিতে হবে। প্রতিযোগিতাহীন নির্বাচনের এমন পরিবেশে ভোটারদের উপস্থিতিতে তার প্রতিফলন ঘটবে।
বাংলাদেশের দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের বিষয়ে পশ্চিমা একটি মিশন সম্প্রতি তাদের সদর দপ্তরে পাঠানো এক পর্যবেক্ষণে এমনটা মূল্যায়ন করেছে। ঢাকায় পশ্চিমা এক কূটনৈতিক সূত্র ওই মূল্যায়ন প্রতিবেদন পাঠানোর বিষয়টি প্রথম আলোকে নিশ্চিত করেছে।
ঢাকা থেকে পাঠানো পশ্চিমা মিশনের ওই প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, ভোট গ্রহণের দুই সপ্তাহ আগে বাংলাদেশের মানুষ ক্রমেই নির্বাচনকে ‘বিশেষ নির্বাচন কার্যক্রম’ হিসেবে অভিহিত করেছেন। এ প্রসঙ্গে গত ১৭ ডিসেম্বর একটি স্যাটেলাইট টিভি চ্যানেলকে দেওয়া আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ও কৃষিমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাকের সাক্ষাৎকারের বিষয়টি ওই মূল্যায়নে উল্লেখ করা হয়েছে।
ওই সাক্ষাৎকারে আব্দুর রাজ্জাক বলেছিলেন, নির্বাচনে আনার জন্য বিএনপির নেতাদের কারাগার থেকে মুক্তির প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল, তবে বিএনপি সেই প্রস্তাব গ্রহণ করেনি। দেশে অস্থিতিশীলতা এড়াতে সরকারের কাছে আর কোনো বিকল্প ছিল না বলেও আব্দুর রাজ্জাক উল্লেখ করেছিলেন। পরে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের তাঁর সহকর্মী আব্দুর রাজ্জাকের ওই বক্তব্য প্রত্যাখ্যান করেন। তিনি ওই বক্তব্যকে আব্দুর রাজ্জাকের ব্যক্তিগত বক্তব্য বলে অভিহিত করেন।
বাংলাদেশের নির্বাচনসংক্রান্ত পর্যবেক্ষণে প্রার্থী মনোনয়নকে ঘিরে আওয়ামী লীগের দলীয় প্রার্থী ও শরিকদের অসন্তোষের বিষয়টি তুলে ধরেছে ওই মিশনের ঢাকা দপ্তর—৭০ জন সংসদ সদস্যের মনোনয়ন না পাওয়া, ১৪-দলীয় জোটের শরিকদের মাত্র ৬টি আসন দেওয়া, আওয়ামী লীগের সঙ্গে যুক্ত ‘ডামি বিরোধী প্রার্থীদের’ সমর্থনে আওয়ামী লীগের বেশ কয়েকজন দলীয় প্রার্থীর মনোনয়ন প্রত্যাহার ইত্যাদি।
আওয়ামী লীগের মনোনয়নবঞ্চিত সংক্ষুব্ধ প্রার্থীদের একটি বড় অংশ ওই ডামি বিরোধীদের বিরুদ্ধে লড়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। এতে তৃণমূল পর্যায়ে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের দলীয়ভাবে মনোনীত প্রার্থীর পরিবর্তে স্বতন্ত্র প্রার্থীদের সমর্থনের হার ক্রমবর্ধমান হারে বাড়ছে। গোয়েন্দা সংস্থার চাপে পড়ে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জি এম কাদের ২৫ আসন নিয়ে আওয়ামী লীগের সঙ্গে সমঝোতা করতে বাধ্য হয়েছেন। ওই আসনগুলোয় আওয়ামী লীগঘনিষ্ঠ ডামি প্রার্থীদের প্রতিযোগিতার মুখোমুখি হবেন জাতীয় পার্টির প্রার্থীরা।
জানা গেছে, প্রতিবেদনটিতে ১৮ ডিসেম্বর আনুষ্ঠানিকভাবে নির্বাচনী প্রচারণা শুরুর পর বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামী আহূত হরতালের প্রসঙ্গটি এসেছে। নির্বাচনকে ঘিরে বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের দমন এবং বিক্ষিপ্ত সংঘর্ষের বিষয়গুলোও প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে। বিশেষ করে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ দলের অন্তত ২০ হাজার নেতা-কর্মীকে গাদাগাদি করে জেলে আটক রাখা, কারাবন্দী অবস্থায় নির্যাতনে বিএনপির ছয়জন কর্মীর মৃত্যুর অভিযোগ ইত্যাদি প্রসঙ্গ।
নির্বাচন ঘিরে যেসব সহিংসতা হচ্ছে, তা নিয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এখন যেসব সহিংস ঘটনা ঘটে চলেছে, তা শুধু আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীই চালাচ্ছে না; দুই রাজনৈতিক শিবিরের সদস্যরাই নিজেদের শক্তিমত্তা দেখানোর জন্য বল প্রয়োগ করে চলেছেন। গত ১৯ ডিসেম্বর ঢাকামুখী একটি ট্রেনে আগুন দেওয়ায় চারজন প্রাণ হারিয়েছেন। বিয়োগান্ত ওই ঘটনার জন্য আওয়ামী লীগ ও বিএনপি একে অন্যকে দোষারোপ করলেও প্রকৃত অপরাধী এখনো আড়ালেই থেকে গেছে।
আপনার মতামত জানানঃ