আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে ভোটারদের সমর্থন পেতে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল আর প্রার্থীদের দৌড়ঝাঁপ চলছে। কিন্তু এই ভোটে কতটা আগ্রহ দেখাচ্ছেন ভোটাররা? ভোটে নিজেদের অধিকারের কথাই বা তারা কতটুকু জানেন?
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, এক সময় ভোটের রাজনীতিতে ভোটারদের খুব কদর থাকলেও সেটি এখন আর নেই।
কেননা, গত ১৫ বছরে দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি বদলেছে অনেকটা। আর তাতে ভোটে আগ্রহ হারাচ্ছেন সাধারণ ভোটাররা।
বাংলাদেশের নির্বাচনী আইন বা গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) অনুযায়ী, নির্বাচনে জয় পেতে ন্যূনতম ভোটার উপস্থিতির হার নিয়ে কোনো আইনি বাধ্যবাধকতা নেই।
অর্থাৎ ভোট প্রদানের হার এক শতাংশ হলেও সে নির্বাচনের বৈধতা নিয়ে কোনো প্রশ্ন ওঠে না। সে কারণে বেশিরভাগ ভোটার ভোটকেন্দ্রে না গেলেও তাতে ভোটের রাজনীতিতে খুব একটা প্রভাব পড়ে না।
বিশ্লেষকরা বলছেন, বাংলাদেশের এই আইনি কাঠামোর কারণে ভোটের রাজনীতিতে বর্তমানে অনেকটাই উপেক্ষিত হচ্ছেন ভোটাররা।
নির্বাচনে ভোটাধিকার কী?
গণতান্ত্রিক নির্বাচন ব্যবস্থায় ভোটাধিকার প্রয়োগের মাধ্যমে সংখ্যাগরিষ্ঠের সমর্থন পেয়ে সরকার নির্বাচিত হয়ে থাকে। জাতীয় ও স্থানীয় নির্বাচনে জনগণের প্রতিনিধি নির্বাচনের জন্য রাষ্ট্রের প্রতিটি নাগরিকের সমান ভোটাধিকার থাকে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক রাশেদা রওনক খান বিবিসি বাংলাকে বলেন, ‘খাদ্য-বস্ত্রসহ অন্য অধিকারগুলোর মতো ভোট দেয়ার অধিকারও এক ধরণের নাগরিক অধিকার। সবার ওপরের দিকের নাগরিক অধিকারগুলোর মধ্যে ভোট দেয়ার অধিকার অন্যতম।’
‘প্রত্যেক নাগরিক চায় ১৮ বছর হলে দেশ কার দ্বারা পরিচালিত হবে, আমি কার দ্বারা পরিচালিত হবো, আমার শহরটা কার দ্বারা পরিচালিত হবে। ওরকম একটা জায়গা থেকে ভোটের অধিকারটা অনেক বড় একটা বিষয়’, বলছিলেন তিনি।
আইন কী বলছে?
বাংলাদেশের নির্বাচন কমিশনের ভোট পরিচালনা করার যে আইন রয়েছে, সেই আইনে ভোটারদের অধিকার নিয়ে সেখানে তেমন কিছু বলার নেই।
তবে নির্বাচনের ‘মূল চালিকা শক্তিই ভোটার’, বলছিলেন নির্বাচন বিশ্লেষক জেসমিন টুলি।
‘ভোটের পুরো আয়োজনটাই ভোটারদের জন্য। প্রার্থীরা যখন নির্বাচনে অংশ নেন, তখন ভোটারদের কাছেই ভোট চাইতে যান। এটাই নির্বাচনের মূল স্পিরিট’, বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন তিনি।
নির্বাচনের আইন অনুযায়ী, ভোটের দিন ভোটাররা কেন্দ্রে আসবেন, নির্বাচন কমিশনের দায়িত্বরত কর্মকর্তা পরিচয় নিশ্চিত করার পর একজন ভোটার তার পছন্দের প্রার্থী বাছাই করতে ভোট দিবেন।
নির্বাচন কমিশনার মো: আলমগীর বলেন, ‘ভোটাররা যেন তাদের প্রার্থী সম্পর্কে জানতে পারে সেজন্য প্রার্থীদের হলফনামা প্রকাশ করে নির্বাচন কমিশন। এতে প্রার্থী সম্পর্কে জানার একটা সুযোগ থাকে।
অধিকার প্রয়োগের কতটা সুযোগ পাচ্ছেন ভোটাররা?
এ পর্যন্ত অনুষ্ঠিত হওয়া বাংলাদেশের ১১টি নির্বাচনের ইতিহাস পর্যালোচনা করে দেখা যায়, সবচেয়ে বেশি ভোটার উপস্থিতি ছিল ২০০৮ সালের নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে।
সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হওয়া ওই নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি ছিলো শতকরা ৮৭ শতাংশ।
রাশেদা রওনক খান বলছেন, ‘২০০৮ সালের ওই নির্বাচনে দেশের সকল নাগরিক উৎসবের মেজাজে ভোট দেয়ার সুযোগ পেয়েছিল। তবে এর পরের ভোটগুলো নিয়ে তৈরি হয় নানা প্রশ্ন। যেখানে অনেকেই ভোট দেয়ার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়েছেন।’
নির্বাচনে জয় পেয়ে ২০০৯ সালে সরকার গঠন করে আওয়ামী লীগ। প্রায় আড়াই বছরের মাথায় ২০১১ সালের মে মাসে আদালতের রায়ের পর জাতীয় সংসদে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল হয়।
এরপর আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত দু’টি নির্বাচন নিয়ে ছিল নানা প্রশ্ন।
২০১৪ সালের দশম সংসদ ও ২০১৮ সালের একাদশ জাতীয় নির্বাচনের উদাহরণ টেনে নির্বাচন বিশ্লেষক জেসমিন টুলি বিবিসিকে বলেন, ওই দু’টি ভোটে কিছু ভোটার উপস্থিত থাকলেও সেখানে ভোটারের তেমন কোনো মূল্য ছিল না।
যে কারণে ভোট নিয়েও নানা প্রশ্ন তৈরি হয়েছিল, যোগ করেন জেসমিন টুলি।
‘না ভোট’ বাতিলে কার লাভ কার ক্ষতি?
বাংলাদেশের নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে নির্বাচনী আইনে যতগুলো সংস্কার আনা হয়েছিল ‘না ভোট’ ছিল তার মধ্যে অন্যতম।
আরপিওর ৩১ ধারায় তখন একটি নতুন বিধান যুক্ত করা হয়। ওই নির্বাচনে ব্যালট পেপারে সর্বশেষ প্রার্থীর স্থানে লেখা থাকতো ‘ওপরের কাউকে নয়’।
বিধান চালু হওয়ার পর নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিন লাখ ৮২ হাজার ‘না ভোট’ পড়েছিল। কিন্তু পরে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর বাতিল হয় এই ‘না ভোটের’ বিধান।
নির্বাচন কমিশনের সাবেক অতিরিক্ত সচিব জেসমিন টুলি বলছেন, ভোটার যখন কেন্দ্রে ভোট দিতে গেলো, কিন্তু তার প্রার্থী পছন্দ হলো না। সেটা জানানোর কোনো পদ্ধতি এখন আর নেই।
ফলে ভোটারদের প্রার্থী পছন্দ না হলে তারা আর কেন্দ্রমুখী হচ্ছে না, মনে করছেন তিনি।
ভোটার ভোট না দিলে আইন কী বলে?
উন্নত বিশ্বের অনেক দেশেই ভোটার উপস্থিতি কম থাকে নির্বাচনে। কেন না তরুণ ভোটারদের অনেকে খুব একটা ভোট দেয়ার আগ্রহ খুঁজে পান না।
বিশ্লেষক রাশেদা রওনক খানের মতে, ‘এখন একটা গ্লোবাল ওয়ার্ডে বসবাস করছি আমরা। এখন তরুণ ভোটারদের ভোটে টানা একটু কঠিন। এটার একটা প্রভাব ভোটে থাকেই।’
এখানে অস্ট্রেলিয়ার নির্বাচনের উদাহরণ টানেন সাবেক আমলা জেসমিন টুলি।
বিবিসিকে তিনি বলছেন, ‘আইন অনুযায়ী অস্ট্রেলিয়ার নির্বাচনে নাগরিকদের কেউ ভোট দিতে না গেলে তাদের জরিমানা করা হয়। ভোট দিতে না চাইলে আগে থেকে তাদের নির্বাচন কমিশনকে জানাতে হয়।’
‘কিন্তু বাংলাদেশের আইনে এমন কিছু নেই। ফলে এখনকার নির্বাচনে ভোটাররা খুব একটা কেন্দ্রে যেতে চান না’, বলছিলেন জেসমিন টুলি।
নির্বাচন কমিশনার মো: আলমগীর বিবিসিকে বলেন, ‘নির্বাচনে ভোটাররা যাতে নির্বিঘ্নে কেন্দ্রে গিয়ে ভোট দিয়ে আসতে পারে, সে পরিবেশ নিশ্চিত করবে নির্বাচন কমিশন। তবে কেউ ভোট কেন্দ্রে না এলে তো ইসির কিছু করার নাই।”
বাংলাদেশে নির্বাচনে ভোটারদের আগ্রহ কমছে কেন?
বাংলাদেশের রাজনীতির দু’টি মূল ধারা আওয়ামী লীগ ও বিএনপি। তবে ২০১৮ সালের একাদশ জাতীয় নির্বাচনে অংশ নেয়নি বিএনপি। অংশ নিচ্ছে না আগামী ৭ জানুয়ারির নির্বাচনেও।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক রাশেদা রওনক খান বলছেন, ‘জনসমর্থনের বিচারে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির কাছাকাছি কোনো প্রতিপক্ষ এখনো গড়ে ওঠেনি। যখন একটি পক্ষ নির্বাচনের মাঠে না থাকে, তখন ভোটে দুই পক্ষের ভোটাররাই কোনো আগ্রহ পান না।’
বিষয়টিকে একটু ভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করে নির্বাচন বিশ্লেষক জেসমিন টুলি বলেন, ‘এক গ্রুপ ভয় দেখাচ্ছে কেন্দ্রে যাওয়ার জন্য, আরেক গ্রুপ না যাওয়ার জন্য। এটা ভোটারদের জন্য উভয় সঙ্কট!’
বিশ্লেষকরা মনে করেন, নির্বাচনী রাজনীতিতে দুই দলের সমঝোতা হওয়া উচিত অন্তত ভোটারের উৎসাহের কথা চিন্তা করে। না হলে ভোটারদের অধিকার প্রতিষ্ঠা হবে না বলেই মনে করছেন তারা। সূত্র : বিবিসি।
আপনার মতামত জানানঃ