প্রতিপক্ষের কর্মী–সমর্থকদের হাত–পা ভেঙে দেওয়া, নির্দিষ্ট প্রতীকে ভোট না দিলে সামাজিক সুরক্ষার আওতায় বিভিন্ন ভাতা বন্ধ করে দেওয়া, পক্ষে কাজ না করলে এলাকায় থাকতে না দেওয়া—এ ধরনের নানা হুমকির ঘটনা থামছে না। গত রোববার রাতেও পঞ্চগড়ে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের এক নেতা নৌকার বিরোধিতাকারীদের চিহ্নিত করে রাখতে বলেছেন।
নির্বাচনী প্রচার শুরুর পর থেকে গত এক সপ্তাহে এ ধরনের অন্তত ১৫টি ঘটনা গণমাধ্যমে এসেছে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট নির্বাচনী অনুসন্ধান কমিটি এসব অভিযোগ তদন্ত করছে। যদিও এখন পর্যন্ত হুমকি দিয়ে যাঁরা বক্তব্য দিয়েছেন তাদের কারও বিরুদ্ধে বড় কোনো ব্যবস্থা নিতে দেখা যায়নি।
আচরণবিধি মেনে চলা হচ্ছে কি না, তা দেখার জন্য ভোটের মাঠে কাজ করছে কমবেশি ৮০০ নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট। এ ছাড়া প্রতিটি আসনে জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটদের সমন্বয়ে আছে নির্বাচনী অনুসন্ধান কমিটি। আইন অনুযায়ী, নির্বাচনী অনুসন্ধান কমিটি কোনো অভিযোগ তদন্ত করে তিন দিনের মধ্যে নির্বাচন কমিশনের (ইসি) কাছে প্রতিবেদন দেবে। এর ভিত্তিতে কমিশন ব্যবস্থা নেবে। তবে আচরণবিধি লঙ্ঘনের ঘটনায় দু–একটি ছাড়া বেশির ভাগ ক্ষেত্রে সতর্ক করা হচ্ছে।
পঞ্চগড়ে যাঁরা নৌকা প্রতীকের বিরোধিতা করছেন, ৭ জানুয়ারির পর নৌকার আশপাশে দেখলে তাদের পা ভেঙে দেওয়ার হুমকি দিয়েছেন জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক স্বাস্থ্য ও জনসংখ্যাবিষয়ক সম্পাদক মো. নুরুজ্জামান।
নির্বাচনী আচরণবিধি অনুযায়ী, রাজনৈতিক দল, প্রার্থী বা প্রার্থীর পক্ষে কারও উসকানিমূলক বক্তব্য দেওয়া অপরাধ। এ ধরনের অপরাধে সর্বোচ্চ ছয় মাসের কারাদণ্ড অথবা সর্বোচ্চ ৫০ হাজার টাকা জরিমানা অথবা উভয় দণ্ড দেওয়ার বিধান আছে।
এ ছাড়া গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশে বলা আছে, কোনো বিশেষ ধর্ম, সম্প্রদায়, গোষ্ঠী, বর্ণ, উপদল বা উপজাতির অন্তর্ভুক্ত হওয়ার কারণে কোনো ভোটারকে ভোট দিতে বা না দিতে যদি কোনো প্রার্থী আহ্বান জানান বা প্ররোচিত করেন, তা হবে অপরাধ। এই অপরাধ দুর্নীতির অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হবে। এর সাজা দুই বছর থেকে সাত বছরের সশ্রম কারাদণ্ড এবং অর্থদণ্ড।
নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের অতিরিক্ত সচিব অশোক কুমার দেবনাথ গত রাতে বলেন, আচরণবিধি লঙ্ঘনের দায়ে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। নির্বাচনী অনুসন্ধান কমিটির প্রতিবেদনের ভিত্তিতে অনেক জায়গায় প্রার্থীদের বিরুদ্ধে মামলা করা হচ্ছে, আরও মামলা হবে। কিছু ক্ষেত্রে প্রার্থীদের ইসিতে তলব করা হবে। এরপর ইসি থেকে প্রার্থিতা বাতিলের মতো সিদ্ধান্তও আসতে পারে।
১৯ ডিসেম্বর নৌকার বাইরে গিয়ে কেউ কোনো কথা বললে ‘গলা নামিয়ে দেওয়ার’ হুমকি দিয়েছিলেন মাদারীপুর-২ (রাজৈর-সদর একাংশ) আসনের সংসদ সদস্য শাজাহান খানের ছেলে আসিবুর রহমান খান।
হুমকির যত অভিযোগ
পঞ্চগড়ে যাঁরা নৌকা প্রতীকের বিরোধিতা করছেন, ৭ জানুয়ারির পর নৌকার আশপাশে দেখলে তাদের পা ভেঙে দেওয়ার হুমকি দিয়েছেন জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক স্বাস্থ্য ও জনসংখ্যাবিষয়ক সম্পাদক মো. নুরুজ্জামান। গত রোববার রাতে সদর উপজেলার অমরখানা ইউনিয়নের কাজীরহাট বাজারে পঞ্চগড়-১ আসনে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী নাঈমুজ্জামান ভূঁইয়ার নির্বাচনী কার্যালয় উদ্বোধনের সময় তিনি এ বক্তব্য দেন। ইতিমধ্যে ওই বক্তব্যের ভিডিও ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়েছে।
পঞ্চগড়ের রিটার্নিং কর্মকর্তা ও জেলা প্রশাসক জহুরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, নির্বাচন কমিশনের নির্বাচন অনুসন্ধান কমিটি বিষয়টি দেখছে। তদন্ত করে ওই কমিটি বিধি অনুযায়ী ব্যবস্থা নেবে।
গত শুক্রবার ব্রাহ্মণবাড়িয়া-১ (নাসিরনগর) আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থীর পক্ষে যোগ দেওয়ায় উপজেলার কুন্ডা ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যানকে জনসভায় হুমকি দেন নৌকার প্রার্থী বর্তমান সংসদ সদস্য বি এম ফরহাদ হোসেন। এ ঘটনায় বি এম ফরহাদ হোসেনকে তলব করেছে নির্বাচনী অনুসন্ধান কমিটি। গতকাল তিনি অনুসন্ধান কমিটির কাছে জবাব দিয়েছেন এবং ইসির নির্দেশনা মেনে চলার অঙ্গীকার করেছেন।
মেহেরপুর-১ (সদর-মুজিবনগর) আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী, সাবেক জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাবেক সংসদ সদস্য আবদুল মান্নান ফোন করে সদর উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা অলোক কুমার দাশকে হুমকি দিয়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। এ ঘটনায় গতকাল আবদুল মান্নানকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দিয়েছে ওই আসনের অনুসন্ধান কমিটি। ২৭ ডিসেম্বর সশরীর অথবা তার প্রতিনিধির মাধ্যমে নির্বাচনী অনুসন্ধান কমিটির কার্যালয়ে হাজির হয়ে জবাব দিতে বলা হয়েছে।
গত শুক্রবার রাজশাহী জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আবদুস সামাদ এক অনুষ্ঠানে বলেন, ‘নৌকার ভোট নিশ্চিত না হলে, ওই ভোটারের কেন্দ্রে আসার দরকার নেই।’ সম্প্রতি এ–সংক্রান্ত একটি ভিডিও ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়ে। গত রোববার রাজশাহী-৫ আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী ও জেলা যুবলীগের সাবেক সহসভাপতি ওবায়দুর রহমান রিটার্নিং কর্মকর্তার কাছে এটি নিয়ে লিখিত অভিযোগ করেন। গতকাল পর্যন্ত এ বিষয়ে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
গতকাল সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তা এ কে এম নূর হোসেন বলেন, এ বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ১৯ ডিসেম্বর নৌকার বাইরে গিয়ে কেউ কোনো কথা বললে ‘গলা নামিয়ে দেওয়ার’ হুমকি দিয়েছিলেন মাদারীপুর-২ (রাজৈর-সদর একাংশ) আসনের সংসদ সদস্য শাজাহান খানের ছেলে আসিবুর রহমান খান। কারণ দর্শানোর পরিপ্রেক্ষিতে গত রোববার তিনি নির্বাচনী অনুসন্ধান কমিটির কাছে লিখিত জবাব দিয়েছেন। তবে এখন পর্যন্ত তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিতে দেখা যায়নি।
লালমনিরহাট-২ (আদিতমারী-কালীগঞ্জ) আসনের আওয়ামী লীগের প্রার্থী ও সমাজকল্যাণমন্ত্রী নুরুজ্জামান আহমেদের বিরুদ্ধে এক বীর মুক্তিযোদ্ধার ঘাড় মটকানোর হুমকি দেওয়ার অভিযোগ আছে।
একই দিন নির্বাচনী পথসভায় যশোরের কেশবপুর উপজেলার গৌরীঘোনা ইউনিয়ন যুবলীগের আহ্বায়ক অলোক চক্রবর্ত্তীর দেওয়া একটি বক্তব্যের রেকর্ড ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়ে। সেখানে তিনি বলেন, ‘…যাঁরা বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ করেন, যাঁরা উন্নয়নে বিশ্বাস করেন…তারাই শুধু ভোটকেন্দ্রে যাবেন।’ গতকাল পর্যন্ত এ বিষয়ে কোনো ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে কি না, জানা যায়নি। অবশ্য ছড়িয়ে পড়া ভিডিওটি সম্পাদনা করা হয়েছে বলে দাবি করেছেন অলোক চক্রবর্ত্তী।
লালমনিরহাট-২ (আদিতমারী-কালীগঞ্জ) আসনের আওয়ামী লীগের প্রার্থী ও সমাজকল্যাণমন্ত্রী নুরুজ্জামান আহমেদের বিরুদ্ধে এক বীর মুক্তিযোদ্ধার ঘাড় মটকানোর হুমকি দেওয়ার অভিযোগ আছে। গত শনিবার রাতে স্বতন্ত্র প্রার্থী ও জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি মো. সিরাজুল হকের পক্ষে একটি নির্বাচনী সভায় বক্তব্য দেওয়ায় ওই বীর মুক্তিযোদ্ধাকে সতর্ক করে হুমকি দেন মন্ত্রী। তবে গতকাল পর্যন্ত এ ঘটনায়ও কোনো ব্যবস্থা নিতে দেখা যায়নি।
আওয়ামী লীগ নেতাকে জুতার মালা পরিয়ে ঘোরানোর হুমকি দেওয়ার ঘটনায় ১৭ ডিসেম্বর অনুসন্ধান কমিটির কারণ দর্শানোর জবাব দেন ফরিদপুর-২ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী বর্তমান সংসদ সদস্য শাহদাব আকবর। ১৯ ডিসেম্বর তিনি জবাব দেন। তবে তার বিরুদ্ধে এখনো কোনো ব্যবস্থা নিতে দেখা যায়নি।
পাবনায় কেন্দ্র দখল করে ‘ওপেন ভোট’ দেওয়া ও ‘হাড়হাড্ডি ভেঙে’ এলাকাছাড়া করার হুমকি দেন আওয়ামী লীগ নেতা নুর ইসলাম। তাকে ১৭ ডিসেম্বর কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া হয়।
জামালপুর-৫ (সদর) আসনে সরকারি ভাতাভোগীরা নৌকার প্রার্থীর সভায় অংশ না নিলে নির্বাচনের পর ভাতার কার্ড বাতিলের হুঁশিয়ারি দিয়েছিলেন আওয়ামী লীগ নেতা হাতেম আলী।
ভাতা বন্ধের হুমকি
ভোট দিতে কেন্দ্রে না এলে সরকারের সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় বিভিন্ন ভাতাভোগীকে কার্ড বাতিলের হুঁশিয়ারি দেন মাগুরার শালিখা উপজেলার শতখালী ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি ও ইউপি চেয়ারম্যান মো. আনোয়ার হোসেন ওরফে ঝন্টু।
জামালপুর-৫ (সদর) আসনে সরকারি ভাতাভোগীরা নৌকার প্রার্থীর সভায় অংশ না নিলে নির্বাচনের পর ভাতার কার্ড বাতিলের হুঁশিয়ারি দিয়েছিলেন আওয়ামী লীগ নেতা হাতেম আলী। অনুসন্ধান কমিটির কাছে তিনি বক্তব্য দিয়েছেন। অবশ্য এখন পর্যন্ত কোনো ব্যবস্থা নিতে দেখা যায়নি।
বিএনপির সমর্থকেরা ভোট দিতে না গেলে তাদের নাম বিভিন্ন প্রকল্পের সুবিধাভোগীর তালিকা থেকে কাটা যাবে, এমন হুমকি দিয়েছিলেন ঠাকুরগাঁও-১ আসনের আওয়ামী লীগের প্রার্থী রমেশ চন্দ্র সেন। ঠাকুরগাঁও জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা মঞ্জুরুল হাসান প্রথম আলোকে বলেন, রমেশ চন্দ্র সেন অনুসন্ধান কমিটির কাছে কারণ দর্শানোর নোটিশের ব্যাখ্যা দিয়েছেন। অনুসন্ধান কমিটি প্রার্থীর জবাব পর্যালোচনা করে নির্বাচন কমিশনে একটি প্রতিবেদন পাঠানোর কথা। প্রতিবেদনে কী সুপারিশ করা হয়েছে, তা তিনি জানেন না।
এখন পর্যন্ত উল্লেখযোগ্য ব্যবস্থা
ইসি সূত্র জানায়, আচরণবিধি লঙ্ঘন করায় কুমিল্লা-৭ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী আ ক ম বাহাউদ্দিনের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করেছে নির্বাচনী অনুসন্ধান কমিটি। ওই প্রার্থীর বিরুদ্ধে রিটার্নিং কর্মকর্তা ও পুলিশ সুপারও আলাদা তদন্ত প্রতিবেদন দিয়েছেন। আগামীকাল বুধবার বাহাউদ্দিনকে ইসিতে তলব করা হয়েছে।
একাধিকবার সতর্ক করার পরও আচরণবিধি লঙ্ঘন করায় বরগুনা–১ আসনের আওয়ামী লীগের প্রার্থী ধীরেন্দ্র দেবনাথ শম্ভুকেও আগামীকাল ইসিতে তলব করা হয়েছে। ঝিনাইদহ-১ (শৈলকুপা) আসনের আওয়ামী লীগের প্রার্থী আবদুল হাইয়ের বিরুদ্ধে আচরণবিধি লঙ্ঘনের অভিযোগে গত রোববার মামলা হয়েছে।
এর আগে আচরণবিধি লঙ্ঘনের দায়ে চট্টগ্রাম-১৬ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী মোস্তাফিজুর রহমানের বিরুদ্ধে মামলা করার নির্দেশ দেয় ইসি। তার বিরুদ্ধে আজ মঙ্গলবার চট্টগ্রাম আদালতে মামলা করার কথা রয়েছে বলে জানান বাঁশখালী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা জেসমিন আক্তার। এর বাইরে অনুসন্ধান কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতে মাগুরা–১ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী সাকিব আল হাসান, নারায়ণগঞ্জ-১ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজী, ঢাকা-১৯ আসনের প্রার্থী দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী এনামুর রহমান, মুন্সিগঞ্জ-৩ আসনের প্রার্থী মৃণাল কান্তি দাস ও গাজীপুর-৫ আসনের প্রার্থী মেহের আফরোজসহ কয়েকজনকে চিঠি দিয়ে সতর্ক করেছে ইসি। আওয়ামী লীগের আরেক প্রার্থী আমির হোসেন আমুকে ইসিতে তলব করা হয়েছিল। তবে তার ব্যাখ্যায় ইসি সন্তোষ প্রকাশ করে।
সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার প্রথম আলোকে বলেন, আচরণবিধি লঙ্ঘনের বিষয়ে ইসিকে কথা নয়, কাজে দেখাতে হবে। কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে। অন্যায় করে পার পেয়ে গেলে প্রার্থী ও সমর্থকেরা আরও বড় অন্যায় করতে উৎসাহী হবেন।
আপনার মতামত জানানঃ