দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের বাইরে আরও ২৬টি রাজনৈতিক দল অংশ নিচ্ছে। এর কোনোটিই আওয়ামী লীগের সঙ্গে প্রকৃত প্রতিদ্বন্দ্বিতা গড়ে তোলার সামর্থ্য রাখে না। তবে এবারে নির্বাচনের নতুনত্ব হচ্ছে দলীয় স্বতন্ত্র প্রার্থী। অন্তত ১২৭টি আসনে এই স্বতন্ত্র প্রার্থীরা নিজ দলের নৌকার প্রার্থীদের মূল প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠতে পারেন। বাকি আসনগুলো নিয়ে নৌকার প্রার্থীদের খুব একটা চিন্তা নেই।
এই নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বর্তমান ২৮ জন সংসদ সদস্য দলীয় মনোনয়ন না পেয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে আছেন। জেলা ও উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান এবং পৌরসভার মেয়র পদ ছেড়ে স্বতন্ত্র হিসেবে লড়ছেন; এমন প্রার্থী ৩৫ জন। এঁদের বাইরে সাবেক সংসদ সদস্য এবং স্থানীয় রাজনীতিতে প্রভাবশালী আরও অনেকে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন। এঁরা সবাই ‘দলীয় স্বতন্ত্র’ হিসেবে ইতিমধ্যে পরিচিতি পেয়েছেন।
প্রার্থিতা প্রত্যাহারের সুযোগ না থাকলেও অনেকে হয়তো স্বতন্ত্র প্রার্থীদের সঙ্গে সমঝোতা করার চেষ্টা করবেন। সময় আরও গড়ালে প্রতিদ্বন্দ্বিতার চিত্র আরও স্পষ্ট হবে।
সংসদীয় আসনগুলোর পরিস্থিতি পর্যালোচনা এবং রাজনৈতিক নেতা–কর্মীদের সঙ্গে কথা বলে সারা দেশের প্রথম আলোর প্রতিনিধিরা ভোটের মাঠের এমন চিত্র পেয়েছেন। আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতাদের কারও কারও মূল্যায়নও কাছাকাছি।
তাদের ধারণা, অন্তত ৮০টি আসনে দলের স্বতন্ত্র প্রার্থীরা নৌকা প্রতীকের প্রার্থীদের সঙ্গে শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতা গড়ে তোলার সামর্থ্য রাখেন। তবে ভোটের এখনো প্রায় তিন সপ্তাহ বাকি। গতকাল থেকে প্রচার শুরু হয়েছে। প্রার্থিতা প্রত্যাহারের সুযোগ না থাকলেও অনেকে হয়তো স্বতন্ত্র প্রার্থীদের সঙ্গে সমঝোতা করার চেষ্টা করবেন। সময় আরও গড়ালে প্রতিদ্বন্দ্বিতার চিত্র আরও স্পষ্ট হবে।
আগামী ৭ জানুয়ারি দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ভোট গ্রহণ। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের প্রধান রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপি নির্বাচন বর্জন করেছে। আওয়ামী লীগের পর এই নির্বাচনে বড় দল জাতীয় পার্টি (জাপা)। তবে গত তিনটি সংসদ নির্বাচনের তথ্য বলছে, আওয়ামী লীগের সঙ্গে সমঝোতা ছাড়া জাতীয় পার্টির জয় পাওয়া কঠিন। গত তিনটি নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সঙ্গে সমঝোতা ছাড়া যেসব আসনে জাতীয় পার্টি লড়েছে, সেখানে তাদের প্রায় ৮৬ শতাংশ প্রার্থী জামানত হারিয়েছেন।
একই অবস্থা ১৪–দলীয় জোট শরিকদেরও। এবারের নির্বাচনে এই জোটের শরিকদের আওয়ামী লীগ যে ছয়টি আসন দিয়েছে, সেগুলোতে তাঁরা ভোট করবেন নৌকা প্রতীকে।
এমন অবস্থায় দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন কতটা প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হবে, তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। অবশ্য এবার যাতে কেউ বিনা ভোটে নির্বাচিত না হন, সে বিষয়ে সতর্ক আওয়ামী লীগ। যার কারণে আওয়ামী লীগ সিদ্ধান্ত নিয়েই দলীয় নেতাদের স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ার সুযোগ দিয়েছে বলে জানা গেছে। এখন আওয়ামী লীগের দলীয় প্রার্থী আছে ২৬৪টি আসনে। আর দলটির স্বতন্ত্র প্রার্থী আছেন অন্তত ২৬৯ জন।
এর আগে বিএনপিবিহীন ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচনেও দেখা গিয়েছিল আওয়ামী লীগের প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন দলটির বিদ্রোহী প্রার্থীরা। ২০২১-২০২২ সালে সাত ধাপে সারা দেশের ৪ হাজার ১১১টি ইউনিয়ন পরিষদে নির্বাচন হয়েছিল। আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা জয় পেয়েছিলেন ২ হাজার ১৭০টিতে। আর স্বতন্ত্র প্রার্থীরা জয় পান ১ হাজার ৫৭৩টিতে। এর মধ্যে ৯১১ জন ছিলেন আওয়ামী লীগের ‘বিদ্রোহী প্রার্থী’।
এবারের সংসদ নির্বাচনে খুলনা বিভাগের ৩৬টি আসনের মধ্যে ১৯টিতে, চট্টগ্রাম বিভাগের ৫৮ আসনের মধ্যে ২১টিতে, ঢাকা বিভাগের ৭০ আসনের মধ্যে ২৭টিতে, বরিশাল বিভাগের ২১ আসনের মধ্যে ৭টিতে, ময়মনসিংহ বিভাগের ২৪ আসনের মধ্যে ১৩টিতে, রংপুর বিভাগের ৩৩ আসনের মধ্যে ১২টিতে, রাজশাহী বিভাগের ৩৯ আসনের মধ্যে ২০টিতে এবং সিলেট বিভাগের ১৯ আসনের ৯টিতে নৌকার প্রার্থীদের সঙ্গে দলীয় স্বতন্ত্র প্রার্থীরা মূল প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠতে পারেন। এঁদের অনেকে জয়ী হওয়ার সম্ভাবনাও রয়েছে।
একই অবস্থা ১৪–দলীয় জোট শরিকদেরও। এবারের নির্বাচনে এই জোটের শরিকদের আওয়ামী লীগ যে ছয়টি আসন দিয়েছে, সেগুলোতে তাঁরা ভোট করবেন নৌকা প্রতীকে।
আওয়ামী লীগের সূত্র জানায়, জেলা হিসেবে ময়মনসিংহ, নরসিংদী, গাজীপুর, শরীয়তপুর, মাদারীপুর, ফরিদপুর, বরিশাল, পিরোজপুর, যশোর, কুষ্টিয়া, চট্টগ্রাম ও রাজশাহীতে স্বতন্ত্র প্রার্থীরা শক্তি দেখাচ্ছেন, যা নৌকার প্রার্থীদের ভাবাচ্ছে।
রাজশাহী জেলার ছয়টি আসনের পাঁচটিতে স্বতন্ত্র প্রার্থীরা শক্তিশালী। এর মধ্যে রাজশাহী-৪ (বাগমারা) আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী আবুল কালাম আজাদের বিরুদ্ধে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন বর্তমান সংসদ সদস্য এনামুল হক। তিনি বাগমারা উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি। গত তিনবার তিনি আওয়ামী লীগের মনোনয়নে সংসদ সদস্য হয়েছেন।
রাজশাহী জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি অনিল কুমার সরকার প্রথম আলোকে বলেন, প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, যাঁরা নৌকা প্রতীক পেয়েছেন, তাঁরা নৌকা নিয়ে নির্বাচন করবেন। অন্যরা স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করবেন। কাউকে বহিষ্কার করা হবে না। নির্বাচন হবে উৎবমুখর। রাজশাহীতে সেটাই হচ্ছে।
নওগাঁর ছয়টি আসনের মধ্যে পাঁচটিতেই দলীয় স্বতন্ত্রদের চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে পারেন নৌকার প্রার্থীরা। নওগাঁ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আবদুল মালেক নিজেও স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছিলেন। পরে তা প্রত্যাহার করে নেন। তিনি গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, যেসব আওয়ামী লীগ নেতা স্বতন্ত্র হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন, তাঁরা ভোটকে আরও প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ করে তুলেছেন। দল মনোনীত প্রার্থীরা কিছুটা বেকায়দায় পড়লেও প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচন গণতন্ত্রের জন্য শুভ লক্ষণ।
ফরিদপুরের চারটি আসনের মধ্যে তিনটিতে শক্ত স্বতন্ত্র প্রার্থী রয়েছেন। এর মধ্যে গত দুটি নির্বাচনে ফরিদপুর-৪ আসনে নির্বাচিত হয়েছেন স্বতন্ত্র প্রার্থী যুবলীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য মজিবুর রহমান চৌধুরী (নিক্সন)। দুবারই তিনি আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য কাজী জাফর উল্যাহকে হারিয়েছেন। এবারও জাফর উল্যাহকে চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছেন নিক্সন।
বরিশালের তিনটি আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থীরা শক্তিশালী। এর মধ্যে উচ্চ আদালতে গিয়ে নিজের প্রার্থিতা ফিরে পেয়েছেন বরিশাল-৫ আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী সেরনিয়াবাত সাদিক আবদুল্লাহ। তিনি বরিশালের সাবেক মেয়র ও নগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক। এই আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী জাহিদ ফারুক। এ আসনের আরেক স্বতন্ত্র প্রার্থী সালাহ উদ্দিনও (রিপন) শক্তিশালী স্বতন্ত্র প্রার্থী।
মাদারীপুর–৩ আসনে নৌকার প্রার্থী বর্তমান সংসদ সদস্য আবদুস সোবহান মিয়া (গোলাপ)। তাঁর শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী মনে করা হচ্ছে স্বতন্ত্র প্রার্থী তাহমিনা বেগমকে। তাহমিনা সংরক্ষিত নারী আসনের সংসদ সদস্য ও কালকিনি উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি।
চট্টগ্রাম-১২ আসনে দলের মনোনয়ন না পেয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন বর্তমান সংসদ সদস্য ও হুইপ সামশুল হক চৌধুরী। এখানে দলীয় প্রার্থী মোতাহেরুল ইসলাম চৌধুরী। এ ছাড়া চট্টগ্রাম-১ (মিরসরাই), চট্টগ্রাম-২ (ফটিকছড়ি), চট্টগ্রাম-৮ (বাকলিয়া-চান্দগাঁও), চট্টগ্রাম-১০ (হালিশহর, পাহাড়তলী, খুলশী, ডবলমুরিং), চট্টগ্রাম-১১ (বন্দর, ইপিজেড, পতেঙ্গা), চট্টগ্রাম-১২ (পটিয়া), চট্টগ্রাম-১৫ (সাতকানিয়া-লোহাগাড়া) আসনেও প্রভাবশালী স্বতন্ত্র প্রার্থী আছেন।
চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আ জ ম নাছির উদ্দীন প্রথম আলোকে বলেন, স্বতন্ত্র প্রার্থী হতে দল থেকে কোনো বাধা নেই। তাই অনেকে প্রার্থী হয়েছেন। এতে শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে। তিনি বলেন, কিছু কিছু জায়গায় একটু দ্বন্দ্ব–সংঘাতের আশঙ্কা থাকবে। এগুলো রোধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য তাঁরা নির্বাচন কমিশনকে অনুরোধ করেছেন।
ময়মনসিংহ জেলার ১১টি আসনের ৬টিতে, জামালপুরের ৫টি আসনের ২টিতে, শেরপুরের ৩টির ১টিতে এবং নেত্রকোনার ৫টি আসনের ৪টিতে নৌকার প্রার্থীরা স্বতন্ত্র প্রার্থীদের চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে পারেন। অবশ্য নেত্রকোনা জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মো. শামসুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, তাঁরা মনে করেন নেত্রকোনার পাঁচটি আসনেই নৌকার প্রার্থীরা জয়ী হবেন। স্বতন্ত্র প্রার্থীদের নিয়ে তাঁদের কোনো মাথাব্যথা নেই।
পিরোজপুর-১ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী মৎস্য ও প্রাণিসম্পদমন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম। এই আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাবেক সংসদ সদস্য এ কে এম এ আবদুল আউয়াল। এই দুই প্রার্থীর কর্মী-সমর্থকদের মধ্যে সংঘাতে ইতিমধ্যে একজন মারা গেছেন।
একইভাবে ঢাকা-১৯ আসনে নৌকার প্রার্থী দুর্যোগ ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী এনামুর রহমানের বিপরীতে স্বতন্ত্র প্রার্থী হচ্ছেন সাবেক সংসদ সদস্য তালুকদার মো. তৌহিদ জং (মুরাদ জং)। গাজীপুর-১ আসনে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হকের আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন কালিয়াকৈর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক রেজাউল করিম।
এ রকম অন্তত ১৫ জন মন্ত্রী–প্রতিমন্ত্রীর আসনে শক্তিশালী দলীয় স্বতন্ত্র প্রার্থী রয়েছেন বলে জানা গেছে। আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফ বলেন, ভোট উৎসবমুখর করার জন্য দল সিদ্ধান্ত নিয়েই দলীয় নেতাদের স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ার সুযোগ দিয়েছে। জনপ্রিয় ব্যক্তিকে জনগণ বেছে নেবে তাতে কে হারল, কে জিতল, তা নিয়ে আওয়ামী লীগ চিন্তিত নয়।
আপনার মতামত জানানঃ