গাজার সবচেয়ে বড় আল শিফা হাসপাতাল। এর মর্গ উপচে পড়ছে ফিলিস্তিনিদের লাশে। করিডোরেও স্থান নেই। সেই লাশের সারি এখন পার্কিং এলাকায়। আত্মীয়রা লাশ শনাক্ত করার আগেই দ্রুততার সঙ্গে আসছে আরও লাশ। খোলা স্থানে সারি সারি লাশ। ৬ষ্ঠ দিনের মতো গাজা উপত্যকার ২৩ লাখ মানুষের ওপর ইসরায়েলের তীব্র থেকে তীব্রতর বোমা হামলায় এই লাশের সংখ্যা দ্রুতই বেড়ে যাচ্ছে। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ, স্বেচ্ছাসেবকরা পরিস্থিতি সামাল দিয়ে উঠতে পারছেন না। এ খবর দিয়েছে অনলাইন আরব নিউজ।
হামাসের অস্বাভাবিক রকেট হামলার জবাবে প্রতিদিনই নিরীহ ফিলিস্তিনিদের ওপর হামলা চালাচ্ছে ইসরায়েল। ফিলিস্তিন থেকে কার্যত বিচ্ছিন্ন এক ভূখণ্ড গাজা উপত্যকায় কাজ করছেন যেসব চিকিৎসক, সংশ্লিষ্ট কর্মীরা বলছেন, এখন আর লাশ রাখার জায়গা নেই।
ধ্বংস করে দেয়া ভবন থেকে প্রতিক্ষণই বেরুচ্ছে মৃতদেহ। আল শিফা হাসপাতাল একবারে প্রায় ৩০টি মৃতদেহ হ্যান্ডেল করতে পারে। কিন্তু তার চেয়ে তিনগুন চারগুন লাশ আসছে। ফলে মর্গের করিডোরে রাখা হচ্ছে তা। পার্কিং এলাকায় পাশাপাশি শুইয়ে রাখা হয়েছে বহু মৃতদেহ। তা ঘিরে আত্মীয়স্বজনরা। তারা প্রিয়জনের মৃতদেহটি শনাক্ত করার চেষ্টা করছেন।
আল শিফা হাসপাতালের একজন নার্স আবু ইলিয়াস শোবাকি বলেন, মৃতদেহ বহনকারী ব্যাগ আসছে তো আসছেই। এখন এই হাসপাতাল যেন একটি গোরস্তানে পরিণত হয়েছে। আমি আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েছি। শরীর আর কাজ করছে না। এই পরিস্থিতি আরও কত ভয়াবহ হবে তা নিয়ে চিন্তাভাবনা বাদ দিয়েছি। এখন লাশের সারি পার্কিং এলাকায় বিস্তৃত হয়েছে।
গত শনিবার আকস্মিকভাবে সীমান্ত অতিক্রম করে এবং রকেট হামলা চালিয়ে কমপক্ষে ১২০০ ইসরায়েলিকে হত্যা করে হামাস। এর প্রতিশোধ নিতে টানা আকাশপথে বোমা হামলা চালিয়ে গাজাকে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করছে ইসরায়েলি সেনারা। প্রায় এক দশকের মধ্যে প্রথমবারের মতো স্থল অভিযান চালানোর প্রস্তুতি নিচ্ছিল তারা। এই অভিযান চালানো হলে মৃতের সংখ্যা কোথায় গিয়ে দাঁড়ায় তাই ভাবিয়ে তুলছে সবাইকে। এরই মধ্যে মৃতের যে সংখ্যা তা হামাস ও ইসরায়েলের মধ্যে গত চারটি রক্তাক্ত যুদ্ধকে ছাড়িয়ে গেছে।
এরই মধ্যে অবরুদ্ধ গাজায় মানবিক বিপর্যয় দেখা গিয়েছে। এমনিতেই গাজার হাসপাতালগুলোকে অনেকদিন ধরে সরবরাহ খুবই নাজুক। তার ওপর জাতীয় পানি বিষয়ক কোম্পানি থেকে পানি সরবরাহ বন্ধ করে দিয়েছে ইসরায়েল। অবরোধ দিয়েছে বিদ্যুৎ, খাদ্য, জ্বালানিতে। ফলে পানি, খাদ্য, ওষুধ সংকটে তারা এমনিতেই মরতে বসেছেন। গাজা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র আশরাফ আল কিদরা বলেন, আমাদের অবস্থা শোচনীয়। জ্বালানি না থাকায় আহতদের উদ্ধারে যেতে পারছে না অ্যাম্বুলেন্স। আহতদেরকে আইসিইউতে নেয়া যাচ্ছে না। মৃতদের নেয়া যাচ্ছে না মর্গে। হাসপাতালের বাইরে সাদা ব্যাগে ভর্তি লাশ দেখেই বোঝা যায় গাজায় কি নৃশংসতা চালাচ্ছে ইসরায়েল।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় আরও জানিয়েছে, গাজায় এরই মধ্যে কমপক্ষে ১৪০০ মানুষ নিহত হয়েছেন। তাদের শতকরা কমপক্ষে ৬০ ভাগই নারী ও শিশু। গাজার মোট জনসংখ্যার শতকরা ১৫ ভাগ অর্থাৎ কমপক্ষে ৩ লাখ ৪০ হাজার মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছেন। বেসামরিক হতাহত এড়াতে হামাসের অবকাঠামো টার্গেট করে হামলা চালানোর দাবি করেছে ইসরায়েল। তাদের এ দাবিকে পুরোপুরি প্রত্যাখ্যান করেছে ফিলিস্তিন।
এসব মৃত্যু এবং আহতদের নিয়ে গাজার স্বাস্থ্য বিভাগে ভয়াবহ এক পরিস্থিতিতে পড়েছে। শিফা হাসপাতালে মহাপরিচালক মোহাম্মদ আবু সেলিম বলেন, যেকোনো পরিস্থিতিতে এই কাজ অব্যাহত রাখা অসম্ভব। রোগীরা এখন অবস্থান করছেন রাস্তায়। আহতরা রাস্তায়। তাদের জন্য একটি বেডের ব্যবস্থা করতে পারছি না আমরা।
গাজা সিটির ঠিক উত্তরে শাতি শরণার্থী শিবিরে ভয়ঙ্কর বোমা হামলা চালানোর পর হাসপাতাল চত্বরে অবর্ণনীয় দৃশ্যের অবতারণা হয়েছে। শিশুদের হাত পা, শরীর থেঁতলে গেছে, তাতে ব্যান্ডেজ লাগানো। পুরুষরা বিভিন্ন স্থানে অবস্থান নিয়েছেন। কোনো যুবতীর মুখভর্তি রক্ত। শিফা হাসপাতালের আইসিইউ রোগীতে পূর্ণ। ফলে মারাত্মক আহত অনেক মানুষ করিডোরে অবস্থান নিয়েছেন। তাদেরকে অতিক্রম করে স্টাফদের চলাচল এবং স্ট্রেচার বহন করা কঠিন।
পরিস্থিতিকে আরও জটিল, ভয়াবহ করে তুলেছে গাজার একমাত্র বিদ্যুৎকেন্দ্র জ্বালানির অভাবে বুধবার বন্ধ হয়ে যাওয়ায়। শিফা হাসপাতাল এবং অন্য হাসপাতালগুলো মরিয়া হয়ে চেষ্টা করছে তাদের ব্যাকআপ জেনারেটরে যেটুকু ডিজেল আছে তা সেভ করতে। এ জন্য হাসপাতালের লাইন বন্ধ করে রাখা হচ্ছে। আইসিইউ, অপারেশন থিয়েটার, অক্সিজেন স্টেশন সহ অত্যাবশ্যক বিভাগ ছাড়া সব বিভাগে লাইট বন্ধ করে রাখা হচ্ছে।
আবু সেলিমা বলেন, হাসপাতালে যে জ্বালানি আছে তা আর মাত্র তিন বা চার দিন চলতে পারে। তারপরই বন্ধ হয়ে যাবে। হাসপাতালটির নার্সিং বিভাগের প্রধান নাসের বুলবুল বলেন, যদি এমন হয় তাহলে ৫ মিনিটের মধ্যে ভয়াবহ এক বিপর্যয় ঘটবে। কারণ, সব অক্সিজেন সরঞ্জাম নবজাতকদের জীবিত রাখছে।
আপনার মতামত জানানঃ