গাছের দিকে তিনি গভীর বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকার সময় বলেছিলেন, ‘আমি শুধু দেখছি না, আমি ভাবছিও। প্যারেবল অব দি ট্রি। আমি আমার কবিবন্ধুর কাছ থেকে দৃষ্টি ধার করেছি। স্তব্ধ যবনিকার অন্তরালে যা আছে, তা জানতে চাই।’
সেই কবিবন্ধুর নাম রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। আর যবনিকার আড়ালের সত্য জানতে উন্মুখ মানুষটির নাম জগদীশচন্দ্র বসু। প্রায় বছর তিনেকের বড় জগদীশ। কী আশ্চর্য সমাপতন, ১৯১৩ সালে রবীন্দ্রনাথের নোবেল পুরস্কার পাওয়ার তিন/চার বছর আগেই নোবেল পেতে পারতেন তিনিও। একথা আজ আর কারোই অজানা নয়, ১৯০৯ সালে ইতালির বিজ্ঞানী গুলিয়েলমো মার্কনির পাওয়া নোবেল পুরস্কারটি আসলে প্রাপ্য ছিল এই বঙ্গসন্তানেরই।
যদি সত্যিই তাই হত? মাত্র চার বছরের ব্যবধানে দুই বাঙালির নোবেল জয়ের অসামান্য ইতিহাস তৈরি হলে জাতি হিসেবে বাঙালির গৌরব আরও কতটা বাড়ত, তা ইতিহাসবিদদের আলোচনার বিষয় হতেই পারে। কিন্তু সাধারণ বাঙালিও একথা ভাবতে বসলে একবার না একবার দীর্ঘশ্বাস ফেলবেই।
কিন্তু কেন ওয়্যারলেস টেলিগ্রাফের উদ্ভাবন করার আসল ব্যক্তিটির অধরা থেকে গেল নোবেল? পরিবর্তে কৃতিত্বটি পেয়ে গেলেন মার্কনি? কোন ‘ষড়যন্ত্রে’র কাহিনি লুকিয়ে রয়েছে বিজ্ঞানের ইতিহাসের যুগান্তকারী এই অধ্যায়ের আড়ালে? শুরু থেকে বলা যাক। ১৮৯৫ সালে জগদীশচন্দ্র সফল হয়েছিলেন মিলিমিটার ওয়েভলেংথ ফ্রিকোয়েন্সি প্রযুক্তির ব্যবহারে। রেডিও কমিউনিকেশন সংক্রান্ত গবেষণার সেই পদক্ষেপ আজও দিশা দেখায়। খুব শিগগিরি দেশে চালু হতে চলেছে ফাইভ-জি পরিষেবা। এই গবেষণার ভিত্তিও জগদীশচন্দ্রের সেদিনের সাফল্যই।
নিজের সৃষ্ট যন্ত্রটির তিনি নাম দিয়েছিলেন মার্কারি কোহেরার। সলিড স্টেট ডায়োড নামের প্রযুক্তির সাহায্যেই কাজ করত সেটি। ১৮৯৭ সালে সম্ভবত কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজের ভেতরে বসেই ওই যন্ত্রটি তৈরি করেছিলেন জগদীশচন্দ্র। ১৮৯৯ সালে প্রথম সেটি প্রদর্শিতও হয়েছিল বিশ্বের দরবারে।
পরবর্তী সময়ে এই নিয়ে যিনি বিশদে গবেষণা করেছিলেন, সেই স্যাটেলাইট অ্যান্ড কমিউনিকেশন ইঞ্জিনিয়ার ও শৌখিন বিজ্ঞান-ইতিহাসবিদ প্রবীর বন্দ্য়োপাধ্যায় প্রমাণ করে দিয়েছিলেন, ১৮৯৯ থেকে ১৯০২ সাল পর্যন্ত সময়কালে সলিড স্টেট ডায়োড প্রযুক্তির সমতুল্য কিছুই ছিল না। এবং ১৯০১-০২ সালে মার্কনির যন্ত্রটিও সেই প্রযুক্তি মেনেই চলেছিল।
তার চেয়েও আশ্চর্যের কথা, সেই যন্ত্রও মার্কনি নিজে তৈরি করেননি। তা তৈরি করেছিলেন তার শৈশবের বন্ধু ইতালির নৌবাহিনীর কর্মী লুইগি সোলারি! অথচ পেটেন্ট দাবি করার সময় তার নামটিও প্রথমে চেপে যান মার্কনি। বন্ধুত্বের কী অপূর্ব প্রতিদান! পরে অবশ্য সংশোধন করা হয় আবেদনপত্রটি। সেখানে স্বীকার করা হয় সোলারির থেকে যন্ত্রটি পাওয়ার কথা। কিন্তু এও বলা ছিল, ওই যন্ত্রের কোনো স্বত্ব নিতে আগ্রহী নন সোলারি। দুই বন্ধুর মধ্যে এই নিয়ে কোনো বোঝাপড়া হয়েছিল কি-না তা জানা যায় না।
মনে করা হয়, সোলারি কোনোভাবে জগদীশচন্দ্র উদ্ভাবিত যন্ত্রটির কথা জানতে পারেন। তারপর নিজেই সেটি তৈরি করে উপহার দেন মার্কনিকে। তবে একটি পরিবর্তন তিনি করেছিলেন। জগদীশচন্দ্র ব্যবহৃত ইউ আকারের কাঁচের নলটির জায়গায় তিনি সোজা সরলরেখার আকারের কচি নল ব্যবহার করেন। এই সামান্য পরিবর্তনটুকুতে যন্ত্রের কার্যপদ্ধতির কোনোরকম বদলই হয়নি।
সুতরাং সেটি যে জগদীশচন্দ্রের মার্কারি কোহেরারেরই অনুকরণ, তা বলাই বাহুল্য। তা এই যন্ত্রটির সাহায্যেই লাগাতার পরীক্ষা চালিয়ে গেলেন মার্কনি। ১৯০১ সালের সেপ্টেম্বরে পেটেন্টের আবেদনও দাখিল করে বসলেন। পেয়েও গেলেন। আর ১৯০৯ সালে তার সুবাদেই এল নোবেল।
এখানেই স্বাভাবিক ভাবে আরেকটি প্রশ্ন উঠে আসে। কেন নিজের তৈরি যন্ত্রের পেটেন্ট করে রাখেননি জগদীশচন্দ্র? তার আগে বলে রাখা ভালো, কেবল মার্কনি বা জগদীশচন্দ্র নয়, ওই একই সময় অন্য বিজ্ঞানীরাও কাজ চালাচ্ছিলেন একই বিষয় নিয়ে। ইতালীয় বিজ্ঞানী পি ক্যাসেটেলি ১৯০০ সালে দাবি করেছিলেন তিনি নাকি মার্কারি কোহেরার তৈরি করেছেন।
জানা যাচ্ছে, তার আগে, ১৮৯৯ সালে একই দাবি ছিল টমাসিনা ও পাওলো কাস্তেলি নামের আরেক বিজ্ঞানীরও। তারা কেউই জগদীশচন্দ্রের নামও উল্লেখ করেননি। কারণটা সহজেই অনুমেয়। অন্যের কৃতিত্বে ভাগ বসানোর কাণ্ড বিজ্ঞানী মহলেও কম নেই।
যদিও পরে তাদের সরিয়ে মার্কনি নিজেকে পাদপ্রদীপের আলোয় নিয়ে আসেন সুকৌশলে। কিন্তু জগদীশচন্দ্র যদি পেটেন্ট নিয়ে রাখতেন আগেই, তাহলে তো এই পরিস্থিতিই তৈরি হত না। কিন্তু কেন নিলেন না তিনি পেটেন্ট? আসলে তিনি মানুষটিই ছিলেন এমন। বিশ্বাস করতেন, পেটেন্ট নেওয়ার অর্থই জ্ঞানকে সীমাবদ্ধ করে ফেলা। তা সকলের জন্য উন্মুক্ত করে রাখাই শ্রেয়। অনেক পরে ১৯১৭ সালে যখন তাকে প্রশ্ন করা হয়, রেডিওর আসল উদ্ভাবক কে, তিনি স্পষ্ট কথায় জানিয়ে দেন, আবিষ্কারক নয়, আবিষ্কারটাই গুরুত্বপূর্ণ। এমনই দর্শন ছিল সত্যসন্ধানী মানুষটির।
আসলে মানুষ হিসেবে মার্কনির একেবারে বিপরীত মেরুর মানুষ ছিলেন জগদীশচন্দ্র বসু। পদার্থবিদ্যা থেকে জীবতত্ত্ববিদ্যা- তিনি কেবলই ‘স্তব্ধ যবনিকার অন্তরালে’র সত্যসন্ধানে বুঁদ হয়ে থেকেছেন। অন্যদিকে মার্কনি আদ্যন্ত ধূর্ত ও সুযোগসন্ধানী। মেপে মেপে পা ফেলেছেন। অন্য দাবিদারদের সরিয়ে নিজেকে এনে ফেলেছেন প্রচারের আলোর ঠিক সামনে। কিন্তু তবুও সত্য শেষ পর্যন্ত গোপন থাকেনি।
বিশ্বখ্যাত আই-ট্রিপল ই তাকে স্বীকৃতি দেয় ‘রেডিও বিজ্ঞানের পিতা’র। এই সংগঠনের জার্নালেলে প্রকাশ পেয়েছিল প্রবীর বন্দ্য়োপাধ্যায়ের গবেষণাপত্রটি। ১৯৯৮ সালের জানুয়ারি মাসে তিনি বহু তথ্য সহযোগে প্রমাণ করে দিলেন মার্কনির ব্যবহৃত যন্ত্রটির প্রযুক্তি জগদীশচন্দ্রেরই। ১৯২০ সালে এই আই-ট্রিপল ই কিন্তু মার্কনিকেই ‘রেডিওর জনক’ আখ্যা দিয়েছিল। প্রবীরবাবুর গবেষণার পরে সেই তারাই জগদীশচন্দ্রকেই রেডিও উদ্ভাবক বলে মেনে নিল।
যদি জগদীশচন্দ্রের জীবদ্দশাতেই এই স্বীকৃতি মিলত? খুব বিরাট আলোড়িত যে হতেন না তা বলাই যায়। তার ‘অব্যক্ত’ নামের বইয়ে তিনি লিখেছিলেন, ‘১৯০৭ সালে মার্কনি তারহীন সংবাদ প্রেরণ করিবার পেটেন্ট গ্রহণ করেন। তার অত্যদ্ভুত অধ্যবসায় ও বিজ্ঞানের ব্যবহারিক উন্নতিসাধনে কৃতিত্বের দ্বারা পৃথিবীতে এক নূতন যুগ প্রবর্তিত হইয়াছে। পৃথিবীর ব্যবধান একেবারে ঘুচিয়াছে।’
এই প্রসঙ্গের নির্লিপ্ত উত্থাপনই প্রমাণ করে দেয় তিনি প্রকৃত অর্থেই ছিলেন একজন সাধক। আধ্যাত্মিক পথ নয়, বিজ্ঞানের পথকে অবলম্বন করে ব্রহ্মাণ্ডের রহস্যকে বুঝে নিতে চেয়েছিলেন। ‘বসু বিজ্ঞান মন্দিরে’র প্রতিষ্ঠা করে তিনি জানিয়েছিলেন, ‘আজ যাহা প্রতিষ্ঠা করিলাম তাহা মন্দির, কেবল পরীক্ষাগার নহে।’
এই বক্তব্য থেকেই পরিষ্কার হয়ে যায় বক্তার সাধনঘন চরিত্রটি। এমন মানুষ যে নোবেল পুরস্কারের ইঁদুরদৌড় থেকে অনেক দূরে অবস্থান করবেন, সেটাই স্বাভাবিক। জগদীশচন্দ্র ছিলেন সত্যের উপাসক। সেই উপাসনার চেয়ে অন্য কিছুকেই তিনি গুরুত্ব দেননি তিনি। নোবেল তিনি পাননি। তবু বাঙালির কাছে, সারা পৃথিবীর বিজ্ঞানসচেতন মানুষের কাছে তার ঔজ্জ্বল্য চিরদীপ্যমান থাকবে।
আপনার মতামত জানানঃ