বিজ্ঞানের জগতে সবচেয়ে বড় প্রশ্নগুলোর একটি- এই মহাবিশ্ব কী দিয়ে তৈরি? এর উত্তর খুঁজতে ইউরোপীয় একটি টেলিস্কোপ যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডা থেকে মহাকাশে উৎক্ষেপণ করা হয়েছে। এই মিশনের নাম ইউক্লিড যা দূরবর্তী কোটি কোটি গ্যালাক্সির ছবি তুলে এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের একটি নিখুঁত ত্রিমাত্রিক বা থ্রিডি ম্যাপ তৈরি করবে। বিজ্ঞানীরা এই ম্যাপের সাহায্যে কথিত ডার্ক ম্যাটার ও ডার্ক এনার্জি সম্পর্কে ধারণা পাওয়ার চেষ্টা করবেন। খবর বিবিসি’র।
ধারণা করা হয়, মহাবিশ্বে আমরা যা কিছু দেখি তার সবকিছুর আকার ও বিস্তৃতিকে এই দু’টি জিনিসই নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। তবে গবেষকরা স্বীকার করে নিয়েছেন যে এই ডার্ক ম্যাটার ও ডার্ক এনার্জি সম্পর্কে তারা এখনো পর্যন্ত তেমন কিছুই জানেন না। এর কোনোটি সরাসরি চিহ্নিতও করা যায় না।
এখন এই দু’টি বিষয় সম্পর্কে জানতে ইউক্লিডের তৈরি থ্রিডি ম্যাপ ব্যবহার করা হবে। এর সাহায্যে বিজ্ঞানীরা বুঝতে চেষ্টা করবেন ডার্ক এনার্জি ও ডার্ক ম্যাটার মহাবিশ্বের সময় ও স্থানের ওপর কী ধরনের প্রভাব ফেলেছে।
যুক্তরাজ্যে ল্যাঙ্কাস্টার বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও জ্যোতির্বিজ্ঞানী অধ্যাপক ইসোবেল হুক বলেন, জ্ঞানের এই অভাবের কারণে আমরা আমাদের উৎস সম্পর্কে আসলেই কোনো ব্যাখ্যা দিতে পারি না। তিনি বলছেন, এই ইউক্লিড মিশন থেকে যা কিছু জানা যাবে সেগুলো এই মহাবিশ্বকে বুঝতে আমাদের সাহায্য করবে।
‘এই মিশন অনেকটা কোথায় স্থলভূমি আছে তা জানার আগে জাহাজে করে যাত্রা করার মতো। এই গবেষণা থেকে জানার চেষ্টা করব- আমরা এই মহাবিশ্বের কোথায় অবস্থান করছি, কিভাবে আজকের পর্যায়ে এসেছি এবং বিগ ব্যাং মুহূর্তের পর থেকে কিভাবে অপরূপ সব গ্যালাক্সি তৈরি হলো, কিভাবে তৈরি হলো সৌরজগত এবং জন্ম হলো প্রাণের,’ বিবিসিকে বলেন তিনি।
ইউক্লিড টেলিস্কোপটি তৈরিতে খরচ হয়েছে ১৪০ কোটি ইউরো। স্পেস এক্সের ফ্যালকন-৯ রকেটে করে শনিবার কেপ ক্যানাভেরাল থেকে এটিকে মহাকাশে পাঠানো হয়েছে।
টেলিস্কোপটি অবস্থান করবে পৃথিবী থেকে ১৫ লাখ কিলোমিটার দূরে। গন্তব্যে গিয়ে পৌঁছাতে এর সময় লাগবে এক মাসের মতো। বিজ্ঞানীরা বলছেন এর সাহায্যে ফিরে যাওয়া যাবে মহাবিশ্বের এক হাজার বছর আগের ইতিহাসে।
পৃথিবীর পাশাপাশি এটিও সূর্যের চারদিকে একই গতিতে প্রদক্ষিণ করবে। প্রাথমিকভাবে এটি ইউরোপীয় মহাকাশ সংস্থা এসার প্রকল্প হলেও এই মিশনে যুক্তরাষ্ট্রের মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসারও উল্লেখযোগ্য অবদান রয়েছে, বিশেষ করে টেলিস্কোপের বিজ্ঞান ও প্রকৌশলগত বিষয়ে।
আগে পরিচালিত গবেষণা থেকে ধারণা করা হয় যে মহাবিশ্বে যতো শক্তি আছে তার ৭০% ডার্ক এনার্জি। প্রায় ২৫% আছে ডার্ক ম্যাটার এবং বাকি ৫% হচ্ছে নক্ষত্র, তারকা, গ্যাস, ধুলোবালি, গ্রহ এবং আমাদের মতো দৃশ্যমান বস্তু।
বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের রহস্যময় এই ৯৫% জগত সম্পর্কে ধারণা পেতেই ইউক্লিড টেলিস্কোপ ছয় বছর ধরে দু’টি গবেষণা পরিচালনা করবে।
এর মধ্যে প্রধান কাজ হবে ডার্ক ম্যাটার কোথায় কিভাবে আছে তার একটি মানচিত্র তৈরি করা। বস্তুটি সরাসরি চিহ্নিত করা যায় না। কিন্তু জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা মাধ্যাকর্ষণ শক্তির দৃশ্যমান প্রভাবের কারণেই মহাবিশ্বে এরকম ম্যাটারের অস্তিত্ব সম্পর্কে নিশ্চিত হতে পারেন।
উদাহরণ হিসেবে বলা যেতে পারে, এই ম্যাটারের উপস্থিতি না থাকলে গ্যালাক্সিগুলো তাদের আকৃতি ধরে রাখতে পারতো না। এই শক্তি ‘স্ক্যাফল্ডিং’ হিসেবে কাজ করে। এটি অনেকটা অদৃশ্য আঠার মতো যা মহাবিশ্বকে একত্রিত করে রেখেছে। ধারণা করা হয় সেটা যা কিছুই হোক না কেন, এটাই ডার্ক ম্যাটার। এখান থেকে আলো বিচ্ছুরিত হয় না, আলো শুষেও নেয় না, এমনকি এখানে আলো প্রতিফলিতও হয় না।
এই বস্তু সরাসরি দেখা না গেলেও টেলিস্কোপের সাহায্যে জানা সম্ভব এটা কোথায় ও কিভাবে রয়েছে। বিজ্ঞানীরা বলছেন দূরবর্তী নক্ষত্রপুঞ্জ থেকে ছুটে আসা আলো বিশ্লেষণ করে এই ডার্ক ম্যাটার সম্পর্কে ধারণা করা পাওয়া যাবে।
হাবল স্পেস টেলিস্কোপও আকাশের খুব ছোট্ট একটি জায়গায়, মাত্র দুই বর্গ ডিগ্রি এলাকাজুড়ে, প্রথমবারের মতো এই কাজটা করে আলোচিত হয়েছিল। এখন ইউক্লিড টেলিস্কোপ এই কাজটা করবে আকাশের ১৫ হাজার স্কয়ার ডিগ্রি এলাকাজুড়ে।
কাজটি টেলিস্কোপের যে ভিআইএস ক্যামেরা দিয়ে করা হবে সেটা যুক্তরাজ্যের নেতৃত্বে তৈরি করা হয়েছে।
ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডনের মহাকাশ গবেষণা ল্যাবরেটরির অধ্যাপক মার্ক ক্রপার বলেন, ‘এই ক্যামেরা যে ছবি তুলবে সেটা হবে বিশাল।’
তিনি বলেন, ‘মাত্র একটি ছবি দেখতেই আপনার তিন শ’টির বেশি হাই-ডেফিনিশন টেলিভিশনের প্রয়োজন হবে।’
অন্যদিকে ডার্ক এনার্জি ডার্ক ম্যাটার থেকে একেবারেই আলাদা একটি বিষয়। ডার্ক এনার্জির কারণে গ্যালাক্সিগুলো আলাদা আলাদা অবস্থান করছে এবং এই শক্তি গ্যালাক্সিগুলোকে দূরে ঠেলে দিচ্ছে যার ফলে মহাবিশ্বের জন্মের পর থেকে এটি আরো সম্প্রসারিত হচ্ছে।
বিজ্ঞানীরা বলছেন, ডার্ক এনার্জি হচ্ছে একটি রহস্যময় “শক্তি” যা এই মহাবিশ্বের বিস্তারকে ত্বরান্বিত করছে বলে ধারণা করা হয়। এর অস্তিত্ব ও প্রভাব প্রমাণ করে তিনজন বিজ্ঞানী ১৯৯৮ সালে নোবেল পুরস্কার জয় করেছেন।
মহাবিশ্বে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ছায়াপথগুলোর ত্রি-মাত্রিক ছবি বিশ্লেষণের মাধ্যমে ইউক্লিড টেলিস্কোপ ডার্ক এনার্জির বিষয়ে জানার চেষ্টা করবে- বলছেন বিজ্ঞানীরা।
বিজ্ঞানীরা বলছেন, মহাজগতের বিভিন্ন বস্তুর মধ্যবর্তী স্থানে যে মহাশূন্যতা বিরাজ করছে তার ধরন বিশ্লেষণ করে পরিমাপ করার চেষ্টা করা হবে কতো সময়ের মধ্যে এগুলোর বিস্তার ঘটেছে।
তারা বলছেন, এসব বস্তুকে দূরত্বের মাপকাঠি বা ‘ইয়ার্ডস্টিক’ হিসেবে ব্যবহার করা হবে। এ বিষয়েও এর আগে খুব অল্প পরিসরে কিছু গবেষণা হয়েছে।
তবে ইউক্লিড যে জরিপ চালাবে তাতে প্রায় দুই শ’ কোটি ছায়াপথের অবস্থান নিখুঁতভাবে জানার চেষ্টা করা হবে। এসব নক্ষত্রপুঞ্জের অবস্থান এই পৃথিবী থেকে প্রায় এক হাজার কোটি আলোক-বর্ষ দূরে।
‘তখনই আমরা কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন উত্থাপন করতে পারব,’ বলেন সারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক বব নিচোল।
‘মহাবিশ্বের সবখানেই কি একই গতিতে সম্প্রসারণ ঘটছে? আজকের দিনে আমরা যা কিছুই পরিমাপ করি তার একটি গড় করা হয়ে থাকে। কিন্তু এখানে সম্প্রসারণের যে গতি, সেখানেও যদি সম্প্রসারণে গতি এক না হয় তাহলে কী হবে? বিজ্ঞানের এই বিষয়টাই এখন আবিষ্কৃত হবে।’
বিজ্ঞানীরা বলছেন ইউক্লিড টেলিস্কোপ নিশ্চিত করে বলতে পারবে না যে ‘এটাই ডার্ক ম্যাটার এবং এটাই ডার্ক এনার্জি।’ তবে এই দু’টি বিষয়ে বর্তমানে যেসব ধারণা ও চিন্তা রয়েছে সেগুলোর পরিসর আরো ছোট করে আনতে পারবে এই টেলিস্কোপ। এটি বিভিন্ন তাত্ত্বিক ও গবেষকের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হবে।
উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, বর্তমানে যেসব পার্টিকেল ডার্ক ম্যাটারের প্রতিনিধিত্ব করে সেগুলোকে চিহ্নিত করার বিষয়ে এই টেলিস্কোপ নতুন চিন্তার জন্ম দিতে পারে। তবে এখনো পর্যন্ত এ বিষয়ে যত অনুসন্ধান চালানো হয়েছে সেগুলোতে কোনো ফল পাওয়া যায়নি।
ডার্ক এনার্জির ব্যাপারেও ইউক্লিড টেলিস্কোপ বিজ্ঞানীদের নতুন সূত্রের সন্ধান দিতে পারে। বলা হচ্ছে, এই গবেষণা থেকে অজানা এই শক্তি সম্পর্কে আরো কিছু ব্যাখ্যা পাওয়া যাবে।
ইউরোপীয় মহাকাশ সংস্থা এসোর একজন বিজ্ঞানী অধ্যাপক মার্ক ম্যাকরকেন বলেন, ‘একটা সম্ভাবনা হলো- ডার্ক এনার্জি হচ্ছে আসলে পঞ্চম এক শক্তি, মহাবিশ্বের নতুন এক শক্তি যা শুধুমাত্র ব্যাপক মাত্রায় কাজ করে, ফলে পৃথিবীতে জীবনের ওপর এর কোনো প্রভাব নেই।’
‘তবে অবশ্যই এটি আমাদের মহাবিশ্বের ভবিষ্যতের ওপর বড় ধরনের প্রভাব ফেলতে পারে- যেমন এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ড কতো দূর পর্যন্ত বিস্তৃত হবে? এটা কি চিরকাল ধরে সম্প্রসারিত হতেই থাকবে? বড় থেকে আরো বড় হবে? নাকি এটা আবার একসময় ধসে গিয়ে আগের অবস্থায় ফিরে যাবে।’
আপনার মতামত জানানঃ