এস আলম গ্রুপের মালিক মোহাম্মদ সাইফুল আলম সিঙ্গাপুরে কমপক্ষে এক বিলিয়ন মার্কিন ডলারের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন। যদিও বিদেশে বিনিয়োগ বা অর্থ স্থানান্তরে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছ থেকে এ সংক্রান্ত কোনো অনুমতি তিনি নেননি বলে গণমাধ্যম দ্য ডেইলি স্টারের অনুসন্ধানে জানা গেছে।
জানা গেছে, বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক দেশের বাইরে বিনিয়োগের জন্য এ পর্যন্ত ১৭টি প্রতিষ্ঠানকে অনুমতি দিলেও চট্টগ্রামভিত্তিক বিশাল এই ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের নাম সেই তালিকায় নেই। কাগজপত্রে আরও দেখা যায়, গত এক দশকে সিঙ্গাপুরে এস আলম অন্তত দুটি হোটেল, দুটি বাড়ি, একটি বাণিজ্যিক স্পেস এবং অন্যান্য যে সম্পদ কিনেছেন এবং সেখানেও বিভিন্ন উপায়ে কাগজপত্র থেকে তার নাম সরিয়ে ফেলা হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নথি অনুযায়ী, ২০২৩ সালের ১০ জানুয়ারি পর্যন্ত দেশ থেকে ৪০ দশমিক ১৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার বিদেশে বিনিয়োগের জন্য নেওয়া হয়েছে। তবে, এই পরিমাণ অর্থ ২০০৯ সালের পর সিঙ্গাপুরে এস আলমের কেবল দুটি হোটেল ও একটি বাণিজ্যিক স্পেস কেনা ৪১১ দশমিক ৮ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের দশ ভাগের এক ভাগ মাত্র।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নথিতে আরও দেখা যায়, এ পর্যন্ত বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান বৈধ উপায়ে সিঙ্গাপুরে ১ লাখ ৭ হাজার মার্কিন ডলার পাঠিয়েছে, যার মধ্যে একটি প্রতিষ্ঠানও এস আলমের মালিকানাধীন নয়।
বিদেশে এস আলমের বিনিয়োগ সম্পর্কে জানতে বাংলাদেশ ব্যাংকে লিখিতভাবে যোগাযোগ করলেও তারা কোনো সাড়া দেননি। বিদেশে বিনিয়োগ দাপ্তরিকভাবে কোনো গোপনীয় বিষয় নয়। তারপরও কেন্দ্রীয় ব্যাংক বিষয়টিকে সর্বোচ্চ গোপনীয় বিষয় হিসেবে দেখে বলে প্রতীয়মান হয়েছে।
তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তিন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানিয়েছেন, এস আলম তাদের কাছ থেকে কখনো বিদেশে অর্থ নেওয়ার কোনো ধরনের অনুমতি নেননি। তাদের মধ্যে একজন গণমাধ্যমকে বলেন, ‘আপনি নিশ্চিত থাকতে পারেন যে এস আলম বিদেশে অর্থ পাঠানোর জন্য কোনোদিন বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমতি নেয়নি।’ অন্য দুই জনও এই তথ্য আলাদাভাবে নিশ্চিত করেছেন।
বাংলাদেশের মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইন, ২০১২ অনুযায়ী কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ছাড়পত্র ছাড়া বিদেশে বিনিয়োগ নিষিদ্ধ। এই অপরাধের শাস্তি সর্বোচ্চ ১২ বছর কারাদণ্ড এবং যে পরিমাণ অর্থ পাচার করা হয়েছে তার দ্বিগুণ পরিমাণ অর্থদণ্ড। ১৯৮৫ সালে সাইফুল আলম এস আলম গ্রুপ প্রতিষ্ঠা করেন এবং তখন থেকে এটি বাংলাদেশের অন্যতম বৃহৎ বড় ব্যবসায়িক গোষ্ঠীতে পরিণত হয়েছে।
তার ব্যবসার পরিধি পণ্য বাণিজ্য থেকে মাছ ধরা, নির্মাণ সামগ্রী থেকে আবাসন ব্যবসা, টেক্সটাইল থেকে মিডিয়া, আন্তঃনগর বাস থেকে শিপিং এবং জ্বালানি ও বিদ্যুৎ থেকে ব্যাংকিং, বীমা পর্যন্ত বিস্তৃত।
অনুসন্ধান বিষয়ে বক্তব্য জানার জন্যে গত ৬ জুলাই ও ২৩ জুলাই দুই দফা লিখিতভাবে এস আলমের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। আমরা বিদেশে তার বিনিয়োগ ও তহবিলের উৎস সম্পর্কে জানতে বেশ কিছু লিখিত প্রশ্ন তাকে পাঠাই, তাতে এ বিষয়ে তার বক্তব্যের জন্য অনুরোধ করা হয়। দুই বারই তিনি তার আইনজীবী এ হোসেন অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটসের মাধ্যমে উত্তর দেন। এতে বলা হয়, প্রকাশিত হওয়ার আগে পুরো সংবাদ প্রতিবেদনটি তাকে না পাঠালে তিনি জবাব দেবেন না—যেটি সাংবাদিকতার চর্চা নয়।
বিশাল সাম্রাজ্য
এস আলম ও তার স্ত্রী ফারজানা পারভীন অফশোর বিজনেসের যে বিস্তৃত জাল বুনেছেন, তার কিছু অংশ ডেইলি স্টারের কাছে থাকা নথি থেকে জানা গেছে। আমাদের অনুসন্ধানে এস আলম ও তার স্ত্রীর সিঙ্গাপুর, ব্রিটিশ ভার্জিন আইল্যান্ডস এবং সাইপ্রাসে বিনিয়োগের সন্ধান পাওয়া গেছে।
ভূমধ্য সাগরীয় ছোট দেশ সাইপ্রাস ২০০৭ সালে তাদের ‘গোল্ডেন পাসপোর্ট’ কর্মসূচি চালু করে। বেশ কয়েকটি আন্তর্জাতিক ব্যবসায়িক পরামর্শদাতা সংস্থার মতে, এই প্রকল্পের আওতায়, দেশটির আবাসনখাতে প্রায় ২ মিলিয়ন ইউরো (২ দশমিক ৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার) বিনিয়োগ এবং সাইপ্রাস সরকারের গবেষণা ও ভূমি উন্নয়ন তহবিলে আরও ২ লাখ ইউরো অনুদানের বিনিময়ে ধনী বিদেশিদের সাইপ্রাসের নাগরিকত্বের সুযোগ দেওয়া হয়।
সিঙ্গাপুরের অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড করপোরেট রেগুলেটরি অথরিটি (এসিআরএ) থেকে পাওয়া প্রতিষ্ঠানের প্রোফাইলের তথ্য অনুযায়ী, এর দুই বছর পর ২০০৯ সালের ২৭ আগস্ট সাইফুল আলম ও ফারজানা পারভীন নিজেদের সাইপ্রাসের নাগরিক এবং সিঙ্গাপুরের বাসিন্দা দেখিয়ে সিঙ্গাপুরে ক্যানালি লজিস্টিকস প্রাইভেট লিমিটেড প্রতিষ্ঠা করেন।
সে সময় কোম্পানিটির ইস্যু করা ও পরিশোধিত শেয়ার মূলধনের পরিমাণ ছিল ২২ দশমিক ৩৪ মিলিয়ন মার্কিন ডলার (৩০ মিলিয়ন সিঙ্গাপুর ডলার)। এস আলম ও তার স্ত্রী একমাত্র শেয়ারহোল্ডার ছিলেন। আলম ৩০ মিলিয়ন শেয়ারের ৭০ শতাংশ এবং তার স্ত্রী বাকি ৩০ শতাংশ নিয়ন্ত্রণ করতেন।
সিঙ্গাপুরে বিনিয়োগের মাধ্যমে দেশটিতে রেসিডেন্স পারমিট বা বিদেশিদের থাকার অনুমতি দেওয়া হয়।
বিশ্বের বেশ কিছু বড় ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান সিঙ্গাপুর থেকেই পরিচালিত হয়, যার মধ্যে বাংলাদেশের কিছু ব্যবসায়িক গোষ্ঠীও রয়েছে। অনুসন্ধানী সাংবাদিকদের আন্তর্জাতিক কনসোর্টিয়ামের (আইসিআইজে) তৈরি অফশোর লিকস ডেটাবেস অনুযায়ী, প্রায় ৬ হাজার শেল কোম্পানি (নামসর্বস্ব প্রতিষ্ঠান) সিঙ্গাপুরের সঙ্গে যুক্ত।
এ ছাড়াও এস আলম ও তার স্ত্রী ব্রিটিশ ভার্জিন দ্বীপপুঞ্জের আরও একটি অফশোর শেল কোম্পানি পিকক প্রপার্টি লিমিটেডের সঙ্গেও যুক্ত। সিঙ্গাপুর থেকে ১৭ হাজার কিলোমিটারেরও বেশি দূরের ব্রিটিশ ভার্জিন আইল্যান্ডস এমন এক ট্যাক্স হ্যাভেন বা কর স্বর্গ যেখানে আয়কর, করপোরেট কর বা মূলধনী কর নেই।
আরেক কর স্বর্গ সাইপ্রাসে ২০১৬ সালে এস আলম অ্যাকলেয়ার ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেড নামে আরেকটি প্রতিষ্ঠান কেনেন। সাইপ্রাসের কোম্পানির রেজিস্ট্রার বিভাগ এবং অফিসিয়াল রিসিভারের নথি অনুসারে, পরবর্তীতে কোম্পানিটির নাম পরিবর্তন করে অ্যাকলেয়ার ইন্টারন্যাশনাল রাখা হয়।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘এটি অবৈধ আর্থিক লেনদেনের একটি পরিষ্কার উদাহরণ। বিশেষ করে যদি কোনো বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ পাওয়া না যায় যে গোল্ডেন পাসপোর্টের জন্য দেওয়া অর্থ, দেশের বাইরে বিনিয়োগ ও সম্পদ ক্রয় এবং কর স্বর্গগুলোতে অফশোর কোম্পানি—এসব কিছু বৈধ বৈদেশিক আয় থেকে এসেছে।’
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, দুটি বৈধ উপায়ে ব্যবসা বা বিনিয়োগের জন্য বিদেশে টাকা পাঠানো যায়। তার একটি হলো, রপ্তানিকারকদের রিটেনশন কোটার একটি নির্দিষ্ট অংশ ‘শুধু রপ্তানিকারক বা তাদের সহায়ক সংস্থা এবং সহযোগীদের আমদানি ও বৈদেশিক ঋণ পরিশোধের জন্য’। অন্যটি হলো বিদেশে বিনিয়োগের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে।
তিনি কোনো নাম উল্লেখ না করে বলেন, ‘কিন্তু তার মানে এই না যে, তারা সেখানে আলাদা প্রতিষ্ঠান স্থাপন করে ব্যবসা করবে। সহায়ক কিছু করতে পারে। বাংলাদেশ ব্যাংক হাতেগোনা কয়েকটি কোম্পানিকে বিদেশে বিনিয়োগের অনুমতি দিয়েছে।’
লাগামহীন দুর্নীতি
চালু হওয়ার পাঁচ বছর পর ২০১৪ সালের ২৬ আগস্ট এস আলমের ক্যানালি লজিস্টিকস সিঙ্গাপুরের ‘লিটল ইন্ডিয়া’য় ১৭৭ মিলিয়ন মার্কিন ডলারে ৩২৮ কক্ষের গ্র্যান্ড চ্যান্সেলর প্রাইভেট লিমিটেড হোটেলটি কেনার জন্য চুক্তি সই করে। হোটেল মালিকদের পক্ষ থেকে তাদের শেয়ারহোল্ডারদের এবং সিঙ্গাপুর সিকিউরিটি এক্সচেঞ্জের কাছে পাঠানো এক সার্কুলারে এ তথ্য জানানো হয়।
চুক্তিপত্র অনুযায়ী, ‘চুক্তিমূল্য কয়েকটি কিস্তিতে নগদে পরিশোধ করা হবে।’ সার্কুলারে আরও বলা হয়েছে, চুক্তির শর্ত পূরণ করে ক্যানালি ইতোমধ্যেই ‘প্রাথমিক আমানত ও ব্যালেন্স ডিপোজিটসহ ১৮ দশমিক ৬ মিলিয়ন সিঙ্গাপুর ডলার (প্রায় ১৪ মিলিয়ন মার্কিন ডলার) পরিশোধ করেছে।’
ডেইলি স্টারের পাওয়া সাম্প্রতিক নথিতে দেখা যায়, সিঙ্গাপুরের নিয়ন্ত্রক সংস্থা এসিআরএর কাছে হোটেল গ্র্যান্ড চ্যান্সেলরের দাখিল করা নথিতে বলা হয়েছে, ২০২১ সালের শেষে হোটেলটির মোট সম্পদের পরিমাণ ছিল ৩১৪ মিলিয়ন মার্কিন ডলার এবং বার্ষিক আয় ছিল প্রায় ৭ দশমিক ৪ মিলিয়ন মার্কিন ডলার।
অধিগ্রহণের এক বছর পরে হোটেলটির নাম পাল্টে গ্র্যান্ড ইম্পেরিয়াল হোটেল প্রাইভেট লিমিটেড করা হয় এবং এখন সিঙ্গাপুরের কেন্দ্রস্থলে হিল্টন গার্ডেন ইন সেরাঙ্গুনের ব্র্যান্ড নামে হোটেলটির কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে।
সিঙ্গাপুরের গণমাধ্যম দ্য বিজনেস টাইমস অনুসারে, ২০১৬ সালে সিঙ্গাপুরের ১৯তলা সেন্ট্রিয়াম স্কয়ারে ২৭ হাজার বর্গফুটের একটি বাণিজ্যিক স্পেস ১০০ দশমিক ৫৩ মিলিয়ন মার্কিন ডলারে কিনে নেয় ক্যানালি।
অধিগ্রহণের এক বছর পর ক্যানালি লজিস্টিকস তার নাম পরিবর্তন করে উইলকিনসন ইন্টারন্যাশনাল প্রাইভেট লিমিটেড করে, ২০২১ সালে যার সম্পদের মোট মূল্য ছিল প্রায় ১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার (১০ হাজার কোটি টাকা)। এই প্রতিবেদন লেখার সময় সিঙ্গাপুর কর্তৃপক্ষের কাছে ২০২২ সালের কোনো কাগজপত্র ছিল না।
প্রতিষ্ঠানটি যখন একের পর এক সম্পত্তি ক্রয় করেছে, এর তিন বছরের বার্ষিক আয়-ব্যয়ের বিবরণীর তথ্য থেকে জানা যায়, কোম্পানির আয়ের চেয়ে ব্যয় ছিল বেশি।
উইলকিনসনের আর্থিক বিবরণীতে দেখা গেছে, ২০১৯ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে তার বার্ষিক আয় কখনই ৭৮ মিলিয়ন মার্কিন ডলার অতিক্রম করেনি। ২০২০ সালে এটি ৩৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার এবং ২০১৯ সালে ৩৬ মিলিয়ন মার্কিন ডলার ছিল।
উইলকিনসনের আর্থিক বিবরণীতে আরও দেখা যায়, ২০১৯ ও ২০২১ সালের মধ্যে কোম্পানিটি কমপক্ষে ৫৬৭ মিলিয়ন মার্কিন ডলার বিনিয়োগ করেছে, যা তাদের অর্জিত পরিমাণের কয়েকগুণ বেশি।
একই সময়ে কোম্পানিটি ৪৫৮ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের অর্থায়ন পেয়েছে। যদিও অর্থায়ন মূলধন বা ঋণ আকারে আসতে পারে, তবে কাগজপত্র দেখে বিশ্লেষকরা বলছেন যে, আলম ও তার স্ত্রী যেহেতু অন্তত ২০২০ সালের শেষ নাগাদ একমাত্র শেয়ারহোল্ডার ছিলেন, তাই এই অর্থ ব্যাংক ঋণ বা নগদ ঋণ হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি।
সিঙ্গাপুরের এই বিপুল ব্যবসায়িক সম্রাজ্য এমন এক ঠিকানার আড়ালে চলে, যার অস্তিত্ব কেবল কাগজে-কলমে আছে।
ডেইলি স্টার উইলকিনসনের নিবন্ধিত ঠিকানায় একজন সোর্স পাঠিয়েছিল, যিনি উইলকিনসনের অফিশিয়াল ঠিকানা কোলিয়ের কোয়ে রোডের ওশেন ফাইন্যান্সিয়াল সেন্টারে ব্যবসার নির্দেশিকা (বিজনেস ডিরেক্টরি) দেখেছিলেন। সেখানে উইলকিনসন ইন্টারন্যাশনালের নাম ছিল না। কিন্তু কোম্পানির হোটেল কেনার চুক্তিতে জড়িত আইনি প্রতিষ্ঠানটির নাম একই ঠিকানায় খুঁজে পান।
সিঙ্গাপুরের সরকারি উন্মুক্ত ডেটা পোর্টালের ২০২৩ সালের জুনের তথ্য অনুসারে, ওই ভবন থেকে ৫০০ শেল কোম্পানি (নামসর্বস্ব প্রতিষ্ঠান) তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করে। যদিও তাদের মধ্যে বেশ কয়েকটির এখন আর অস্তিত্ব নেই।
আলম ও তার স্ত্রী ২০২০ সালের ১৬ ডিসেম্বর উইলকিনসনের পরিচালকের পদ থেকে পদত্যাগ করেন এবং ব্রিটিশ ভার্জিন আইল্যান্ডসের পিকক প্রপার্টি হোল্ডিংস লিমিটেড নামে একটি অফশোর কোম্পানিতে তাদের মালিকানা হস্তান্তর করেন। ২০১৭ সালে প্যারাডাইস পেপারস ফাঁস হলে বিশ্বের সবচেয়ে প্রভাবশালী ব্যক্তি ও কোম্পানির অফশোর কার্যক্রম উন্মোচন হয়। এরমধ্য দিয়ে কর স্বর্গ হিসেবে শিরোনামে উঠে আসে ব্রিটিশ ভার্জিন আইল্যান্ডসের নাম।
তবে আশ্চর্যের বিষয় হলো, নিবন্ধিত ঠিকানায় পিকক প্রপার্টিকেও খুঁজে পাওয়া যায়নি। একই ঠিকানায় ব্রিটিশ ভার্জিন আইল্যান্ডসের আর্থিক পরিসেবা কমিশনে নিবন্ধিত একটি অফশোর এজেন্ট নিউহ্যাভেন করপোরেট সার্ভিসেসের নাম পাওয়া গেছে।
২০১৭ সালের প্যারাডাইস পেপারস ফাঁসের পর জানা যায়, চার তলা এই হলুদ বিল্ডিংটি ব্রিটিশ ভার্জিন আইল্যান্ডসের রাজধানী রোড টাউনে জেমস ওয়াল্টার ফ্রান্সিস হাইওয়ের গোল চত্বরের কাছে অফশোর কোম্পানিগুলোর জন্য পোস্টাল অফিস বক্স হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
গ্রাহককে যথাযথভাবে ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত না করা বা গুরুত্বের সঙ্গে না নেওয়া এবং যেখানে সামনা-সামনি গ্রাহকের সঙ্গে যোগাযোগ নেই সেক্ষেত্রে প্রাসঙ্গিক ব্যবস্থা বা অতিরিক্ত ব্যবস্থা নিতে ব্যর্থতার কারণে ২০১৫ সালে নিউহ্যাভেন করপোরেটকে ব্রিটিশ ভার্জিন আইল্যান্ডসের মানি লন্ডারিং আইনে ২৫ হাজার মার্কিন ডলার জরিমানা করা হয়েছিল।
সরিয়ে ফেলেছে নাম
সিঙ্গাপুরের কোম্পানি থেকে নিজের নাম সরিয়ে ফেলার পর এস আলম অং লে কিম নামে সিঙ্গাপুরের এক নাগরিককে উইলকিনসন কোম্পানির একমাত্র পরিচালক হিসেবে মনোনীত করেন। তবে ডেইলি স্টার দৃশ্যত তার কোনো অনলাইন উপস্থিতি পায়নি।
তার প্রতিষ্ঠান থেকে ২০১৯ সালে ১২৬ মিলিয়ন মার্কিন ডলারে কেনা হোটেল আইবিস সিঙ্গাপুর নোভেনার কাগজপত্রেও আলমের নাম পাওয়া যায়নি।
সিঙ্গাপুর কর্তৃপক্ষের কাছে জমা দেওয়া হোটেলটির কাগজপত্রে দেখা যায়, এটি বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের মালিকানাধীন, যার সবগুলোই উপরে উল্লিখিত আইনি প্রতিষ্ঠান এবং এর চূড়ান্ত মালিক ব্রিটিশ ভার্জিন আইল্যান্ডসের একটি অফশোর কোম্পানি।
হোটেলটি ২০১৩ সাল থেকে ক্যানোপাস টু প্রাইভেট লিমিটেড নামে একটি প্রতিষ্ঠানের মালিকানাধীন, কিন্তু কোম্পানির বর্তমান ঠিকানা আর উইলকিনসের ঠিকানা হুবহু এক, এমনকি প্রতিটি ইউনিট নম্বরও।
ক্যানোপাসের একমাত্র শেয়ারহোল্ডার ব্রিটিশ ভার্জিন আইল্যান্ডসভিত্তিক হ্যাজেল ইন্টারন্যাশনাল প্রাইভেট লিমিটেড নামে একটি সংস্থা, যা উইলকিনসনের অফিসের ঠিকানায় নিবন্ধিত। সিঙ্গাপুরের অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড করপোরেট রেগুলেটরি অথরিটির কাছ থেকে পাওয়া নথি অনুযায়ী, ২০১৯ সালের জুনে এস আলমের কাছে বিক্রির মাত্র ৩ মাস আগে কোম্পানিটি প্রতিষ্ঠিত হয়।
ট্যাক্স হ্যাভেন সুবিধার পাশাপাশি ব্রিটিশ ভার্জিন আইল্যান্ডসে তথ্য গোপন রাখার অধিকার রয়েছে, এবং সেই দেশে পরিচালিত প্রতিষ্ঠানগুলো কোনো অফিসিয়াল কাগজপত্রে তাদের শেয়ারহোল্ডার বা পরিচালকদের নাম দিতে আইনতভাবে বাধ্য নয়।
পলিসি রিসার্চ ইন্সটিটিউটের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জের দেশগুলো সাধারণত শেল কোম্পানিগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয় না। কারণ দেশটি চায় এই অর্থ তাদের দেশেই থাকুক।’
পুতুল পরিচালক
২০১২ সালের ২৫ অক্টোবর এস আলম তার সিঙ্গাপুরের প্রতিষ্ঠানে ‘ক্যাসিনো কিংপিন’ শাহেদুল হককে পরিচালক হিসেবে নিয়োগ দেন। শাহেদুল তখন এস আলম গ্রুপের আংশিক মালিকানাধীন ঢাকার ইউনিয়ন ব্যাংকের পরিচালক ছিলেন। এস আলমের ছেলে আহসানুল আলম ২০২৩ সালের জুনের মাঝামাঝিতে ইসলামী ব্যাংকের চেয়ারম্যান হন। এর আগ পর্যন্ত তিনি ইউনিয়ন ব্যাংকের চেয়ারম্যান ছিলেন। ইসলামী ব্যাংকে এস আলম গ্রুপের উল্লেখযোগ্য অংশীদারত্ব রয়েছে।
২৮ বছর বয়সী আহসানুল আলম এস আলম গ্রুপের বর্তমান পরিচালকও। শাহেদুল ২০১৮ সাল পর্যন্ত ইউনিয়ন ব্যাংক ও উইলকিনসনের পরিচালক ছিলেন।
ইউনিয়ন ব্যাংকের আর্থিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, এই সময়ে এস আলম গ্রুপের মালিকানাধীন বাংলাদেশি কোম্পানি রিলায়েন্স ফাইন্যান্স ইউনিয়ন ব্যাংক থেকে ২ হাজার ৮৬৬ কোটি টাকার বেশি প্লেসমেন্ট পেয়েছে। বর্তমানে রিলায়েন্স ফাইন্যান্স নাম পরিবর্তন করে হয়েছে আভিভা ফাইন্যান্স।
প্লেসমেন্ট হলো মূলধন সংগ্রহের জন্য বিনিয়োগকারীদের কাছে সিকিউরিটিজ বা বন্ড বিক্রি করা। গত বছরের শেষের দিকে এস আলম গ্রুপ কীভাবে ইসলামী ব্যাংকগুলো থেকে ঋণ নিচ্ছে, তা গণমাধ্যমে প্রকাশিত হওয়ার পর বাংলাদেশ ব্যাংক দেখতে পায়, ইউনিয়ন ব্যাংকের মোট ঋণের সিংহভাগই গেছে ৩০০টি স্থানীয় শেল কোম্পানি বা নামসর্বস্ব প্রতিষ্ঠানের কাছে। বাংলা দৈনিক প্রথম আলো সে সময়ে এই প্রতিবেদন প্রকাশ করে।
২০১৯ সালে অবৈধ ক্যাসিনোর বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) অভিযানে ক্যাসিনো ব্যবহার করে অর্থপাচারে জড়িতদের মধ্যে শাহেদুলকে শনাক্ত করা হয়। পরবর্তীতে তার নামের সঙ্গে ‘ক্যাসিনো’ উপাধিটি জড়িয়ে হয় ‘ক্যাসিনো শাহেদুল’।
গত বছরের নভেম্বরে ৩২ কোটি টাকা অবৈধ সম্পদ অর্জনের মামলায় তাকে ৫ বছরের কারাদণ্ড দেন ঢাকার একটি আদালত। দুদকের তদন্তকারীরা জানান, শাহেদুল দেশ ছেড়ে পালিয়ে গেছেন এবং কখনো আদালতে হাজির হননি।
যুক্তরাষ্ট্রের উন্মুক্ত ভোটার রেকর্ড থেকে পাওয়া তথ্যে দেখা যায়, শাহেদুল ও তার স্ত্রী সারিনা তামান্না হক মিশিগানের ক্যান্টনের নিবন্ধিত ভোটার এবং সেখানে তাদের সম্পত্তিও রয়েছে।
দুই বাড়ি
সিঙ্গাপুরের অভ্যন্তরীণ রাজস্ব কর্তৃপক্ষ থেকে পাওয়া রেকর্ডে দেখা যায়, এস আলম ও তার স্ত্রী ২০২১ সাল পর্যন্ত মধ্য সিঙ্গাপুরের নোভেনায় ১২ হাজার ২৬০ বর্গফুটের একটি বাড়ির মালিক ছিলেন।
২০১৮ সালে এই সম্পদের বার্ষিক রেন্টাল ভ্যালু ছিল ৫ লাখ ৭০ হাজার মার্কিন ডলার। তবে ২০২২ সালে সিঙ্গাপুরের জিকো ট্রাস্ট লিমিটেড এর বৈধ মালিক হয়।
জিকো ট্রাস্টের ওয়েবসাইটে দেওয়া তথ্য বলছে, ‘একটি ট্রাস্ট গঠনের সুবিধার মধ্যে রয়েছে গোপনীয়তা ও সম্পদ সুরক্ষা। ট্রাস্টগুলো অফশোর (সেটেলরের নিজ দেশের বাইরে) ও ব্যক্তিগতভাবে প্রতিষ্ঠিত হতে পারে, যার ফলে সেটলরের গোপনীয়তা নিশ্চিত করা যায়।’
ওয়েবসাইটে বলা আছে, ‘ব্যক্তিগত ট্রাস্টের অন্যতম সুবিধা হলো—সম্পদ সুরক্ষা। যেহেতু ট্রাস্টি সম্পদের আইনি মালিক, সেহেতু সেটলরকারী তার অধিকার ত্যাগ করে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এটি ঋণদাতা, দেউলিয়াত্ব ও বিনিময় নিয়ন্ত্রণ ইত্যাদির বিরুদ্ধে এক ধরনের সুরক্ষা নিশ্চিত করে।’
সিঙ্গাপুরে ২০২৩ সাল পর্যন্ত দ্বিতীয় বাড়ির মালিক ছিলেন এই দম্পতি। এর মালিকানাও পেদাং ট্রাস্ট সিঙ্গাপুর প্রাইভেট ট্রাস্টের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। সিঙ্গাপুর ২০০৮ সালে এস্টেট শুল্ক বাতিল করে। সুতরাং, সিঙ্গাপুর ট্রাস্ট থেকে মূলধনের আয় বণ্টন কর মুক্ত এবং সিঙ্গাপুরের ট্রাস্টের উত্তরসূরিদের কোনো এস্টেট শুল্ক ছাড়াই সুবিধাভোগী হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা যায়।
দুদকের তদন্ত
বিদেশে অর্থপাচার দীর্ঘদিন ধরে একটি বৈশ্বিক সমস্যা হিসেবে দেখা দিয়েছে। অনেক বড় প্রতিষ্ঠান ও হাই-প্রোফাইল ব্যক্তিরা দেশে উচ্চ কর ফাঁকি দিতে অফশোর ব্যবসা পরিচালনা করছেন। ওয়াশিংটনভিত্তিক থিঙ্কট্যাংক গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটির হিসাব অনুযায়ী, ২০০৯ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ থেকে প্রতি বছর ৮ দশমিক ২৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার পাচার হয়েছে, যা মেট্রোরেল লাইন-৬ (উত্তরা থেকে মতিঝিল) এর ব্যয়ের প্রায় ৩ গুণ।
বাংলাদেশ থেকে অর্থপাচারের ক্রমবর্ধমান অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে সরকার ২০২২-২৩ অর্থবছরে সাধারণ ক্ষমার প্রস্তাব দেয়, যাতে বাংলাদেশি নাগরিকরা ৭ শতাংশ কর দিয়ে বিদেশ থেকে তাদের অঘোষিত অর্থ ফিরিয়ে আনতে পারে। সরকার এ বছর সেই সুযোগ প্রত্যাহার করে নিয়েছে।
২০২০-২১ সালে যখন এস আলমের সিঙ্গাপুরের সাম্রাজ্য সম্প্রসারিত ও হাতবদল হচ্ছিল, কীভাবে তারা ইসলামী ব্যাংক ও বাংলাদেশের অন্যান্য শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংক থেকে হাজারো কোটি টাকা ঋণ নিচ্ছে—তা নিয়ে তখন ইংরেজি দৈনিক নিউ এজসহ কয়েকটি গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশ হয়েছিল।
২০২২ সালে গণমাধ্যমে প্রতিষ্ঠানটির একের পর এক প্রশ্নবিদ্ধ ঋণ নেওয়া বিষয়ে সংবাদ প্রকাশের পর হাইকোর্ট বাংলাদেশ ব্যাংকের বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট, দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ও পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগকে ঋণ কেলেঙ্কারি তদন্তের নির্দেশ দেন।
২০২২ সালের ৪ ডিসেম্বর স্বতঃপ্রণোদিত এক রুলে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড ও অন্যান্য ব্যাংক থেকে ভুয়া নামে ঋণ নিয়ে বিপুল পরিমাণ অর্থ আত্মসাৎ এবং পাচারকারী প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে যথাযথ আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণে বিবাদীদের ব্যর্থতা ও নিষ্ক্রিয়তার ব্যাখ্যা জানতে চান হাইকোর্ট এবং কয়েকটি সংবাদপত্রের প্রতিবেদনে উল্লিখিত ও প্রকাশিত অনৈতিক প্রক্রিয়া এবং ব্যাপক অনিয়ম করে বানোয়াট ও অস্তিত্বহীন কোম্পানি বা প্রতিষ্ঠানকে কেন অবৈধ ঘোষণা করা হবে না, তাও জানতে চাওয়া হয়।
একইসঙ্গে অন্যায়কারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বিবাদীদের নির্দেশ দেন আদালত। চলতি বছরের ৪ এপ্রিল হাইকোর্টের আদেশ দুদকে পৌঁছায়।
দুদকের আইনজীবী মো. খুরশিদ আলম খান বলেন, ‘আমরা অর্থপাচার নিয়ে সতর্ক আছি। বর্তমানে আমরা ইসলামী ব্যাংকের ঋণ দেওয়ার বিষয়টি তদন্ত করছি।’
এসডব্লিউএসএস/২১২০
আপনার মতামত জানানঃ