প্রাচীন আমোরাইটরা ছিল যাযাবর এক জাতিগোষ্ঠী, যারা খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় সহস্রাব্দের দিকে ‘এবার নারি’ (আধুনিক সিরিয়া) নামক উপকূলীয় অঞ্চল থেকে এসে মেসোপটেমিয়ায় থিতু হয়। ক্রমে ক্রমে তারা ক্ষমতা দখল করে খ্রি.পূ. ১৯৮৪ অব্দের দিকে ব্যাবিলনের রাজ সিংহাসন দখল করতে সক্ষম হয়। আমোরাইট রাজবংশের পঞ্চম রাজা, সিন-মুবাল্লিত প্রজাদের নিকট জনপ্রিয় এক শাসক হলেও রাজ্য বিস্তার কিংবা দক্ষিণে প্রতিদ্বন্দ্বী শহর লারসার সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় অক্ষম ছিলেন।
উল্লেখ্য, লারসা ছিল তৎকালীন পারস্য উপসাগরের সবচেয়ে লাভজনক বাণিজ্য কেন্দ্র। ব্যবসা বাণিজ্য চাঙ্গা থাকায় শহরটি প্রভূত উন্নতি ও সমৃদ্ধি লাভ করে। দক্ষিণ মেসোপটেমিয়ার বেশিরভাগ শহর ছিল লারসার নিয়ন্ত্রণে। সম্রাট সিন-মুবাল্লিত লারসা দখলের উদ্দেশ্য আক্রমণ করলে লারসা সম্রাট প্রথম রিম সিনের কাছে তাকে পরাজয় বরণ করতে হয়। ব্যর্থতার এই গ্লানি সইতে না পেরে সিংহাসন থেকে পদত্যাগ করেন সিন-মুবাল্লিত, এবং উত্তরাধিকারসূত্রে পিতার কাছ থেকে সিংহাসন প্রাপ্ত হন হাম্মুরাবি।
ক্ষমতা গ্রহণের পর তিনি রাজ্য মানচিত্রের খোলনলচেই পাল্টে দেন। হাম্মুরাবি সিংহাসনে আরোহণের সময় ব্যাবিলন রাজ্যে কেবল ব্যাবিলন, কিশ, সিপ্পার এবং বরসিপ্পা শহরগুলো অন্তর্ভুক্ত ছিল। কিন্তু পর পর কতগুলো সফল সামরিক অভিযান ও রাজনৈতিক কূটকৌশলের মাধ্যমে তিনি কিছু শহরের দখল নিয়ে ব্যাবিলনীয় সাম্রাজ্যরেখা আরও বিস্তৃত করেন।
হাম্মুরাবি তার প্রশাসনিক কাঠামো সুবিন্যস্ত করতে পূর্ণ মনোযোগী ছিলেন। পিতার দেখানো পথে হাঁটার পাশাপাশি তিনি শহরের দেয়াল আরও প্রসারিত ও উঁচু করেন। জনগণের চাহিদার প্রতি তিনি ছিলেন সদা সতর্ক ও যত্নবান। উন্নত সেচ এবং তার নিয়ন্ত্রণাধীন শহরগুলোর অবকাঠামো রক্ষণাবেক্ষণের পাশাপাশি দেবতাদের জন্য দৃষ্টিনন্দন মন্দির নির্মাণ করেছিলেন তিনি। এই ফাঁকেই তিনি তার সৈন্যদের নির্দিষ্ট একটি ক্রমানুসারে সাজিয়ে মেসোপটেমিয়ার দক্ষিণাঞ্চলে প্রচারাভিযানের পরিকল্পনা করছিলেন।
মেসোপটেমিয়ার ইতিহাসে সম্রাট হাম্মুরাবি হলেন এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। খ্রিস্টপূর্ব ১৮১০ অব্দে মেসোপটেমিয়ায় জন্ম নেওয়া হাম্মুরাবি ছিলেন ব্যাবিলনিয়ার প্রথম রাজবংশের ষষ্ঠ রাজা। তিনি আদর্শবাদী রাজা বলেও সুপরিচিত। তবে হাম্মুরাবি ইতিহাসের পাতায় সবচেয়ে বিখ্যাত হয়ে আছেন তার প্রণীত আইন হাম্মুরাবি কোডের জন্য। এছাড়াও প্রাচীন মেসোপটেমিয়ার ইতিহাসে তিনিই প্রথম শাসক, যিনি জয়লাভের পর বিদ্রোহ ছাড়াই সফলভাবে সমস্ত মেসোপটেমিয়া নিজ শাসনের ছায়াতলে আনতে সক্ষম হন। আজ আমরা হাম্মুরাবি কোড নিয়েই জানব।
যুদ্ধ-বিগ্রহ ও নগর দখলে জীবনের অধিকাংশ সময় ব্যয় করলেও, তার আমলের শিলালিপি, চিঠিপত্র এবং রাজনথি ঘাঁটলে দেখা যায়, তিনি প্রজাদের উন্নয়ন ও কল্যাণসাধনে ছিলেন নিবেদিতপ্রাণ। তাকে ‘ভূমিনির্মাতা’ উপাধিতে ভূষিত করার প্রমাণও পাওয়া যায়, কারণ তিনি সমগ্র অঞ্চলে বহু ভবন এবং খাল নির্মাণের আদেশ দিয়েছিলেন। রাজ্যে শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্য সম্রাট হাম্মুরাবি আইন-কানুনের লিখিত অনুশাসনও তৈরি করেছিলেন, যা ইতিহাসে ‘হাম্মুরাবি কোড’ নামে পরিচিত।
এই হাম্মুরাবি কোডে প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ অন্যায়ের জন্য নির্দিষ্ট শাস্তি বরাদ্দ ছিল। ব্যাবিলন ও তার ক্ষুদ্র রাষ্ট্রসমূহের প্রত্যেক নাগরিককেই মেনে চলতে হতো প্রণীত সেই নীতিমালা। এ নীতিমালাকে স্থায়ী দলিল হিসেবে রূপ দিতে তা খোদাই করা হয়েছিল পাথরে।
এগুলোর মধ্যে কিছু আইন ছিল এরকম- যদি কোনো ব্যক্তি মন্দির বা সম্রাটের সম্পত্তি চুরি করে, তবে তাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হবে। চুরির মাল যার কাছে পাওয়া যাবে, তার জন্যও একই শাস্তি বরাদ্দ। কোনো ব্যক্তি কারও দাসী হরণ করলে, তাকে প্রাণদণ্ড দেয়া হবে। পলাতক দাসকে কেউ আশ্রয় দিলে, তার একমাত্র শাস্তি মৃত্যুদণ্ড। যদি কেউ কোনো ব্যক্তির কাছে ঋণজালে আবদ্ধ থাকে, তাহলে তার স্ত্রী, পুত্র, বা কন্যা ওই ব্যক্তির কাছে তিন বছর দাস-জীবন যাপন করতে বাধ্য থাকবে।
এরকম প্রায় ২৮২টি আইন লিপিবদ্ধ করে রাজার কাছে পেশ করেন সভাসদেরা। চূড়ান্ত যাচাই-বাছাই ও কাটছাঁটের পর আইনগুলোকে অনুমোদন দেয়া হলে ব্যাবিলনজুড়ে কার্যকর হয় ইতিহাসের অন্যতম প্রাচীন আইন ‘হাম্মুরাবি কোড’। তবে মজার ব্যাপার হলো, হাম্বুরাবির প্রণীত আইন পৃথিবীর সবচেয়ে প্রাচীন আইন নয়। উর-নাম্মু, এশনুন্নার আইন, এবং লিপিত ইশতারের আইন হাম্বুরাবির আইনের চেয়ে প্রাচীন আইন। নিঃসন্দেহে এই আইন প্রাচীন পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি প্রভাব বিস্তার করেছিল।
১৯০১ সালে এলামীয়দের প্রাচীন রাজধানী সুসা থেকে আবিষ্কার করা হয়েছিল এই অমূল্য রত্ন। মোট ১২টি পাথরের টুকরোয় লেখা এই আইন সংকলন পৃথিবীর অন্যতম প্রাচীন আইন হিসেবে সুপরিচিত। আক্কাদীয় ভাষায় লেখা এই আইনগুলো অক্ষরজ্ঞানসম্পন্ন যে কেউ পড়তে পারতেন।
১৭৫৫ খ্রিস্টপূর্বাব্দে বৃদ্ধ হাম্মুরাবি অসুস্থ হয়ে পড়েন। তাই তিনি রাজসিংহাসনের গুরুভার তার পুত্র সামসু-ইলুনাকে সঁপে দেন। দিন যত গড়াচ্ছিল, সম্রাটের অবস্থার তত অবনতি হচ্ছিল। ১৭৫০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে ইহলোক ত্যাগ করেন হাম্মুরাবি। মৃত্যুর পর পিতার অর্জিত রাজ্য সীমারেখা ধরে রাখতে পারেননি তার সন্তান সামসু-ইলুনা। বার বার শত্রুদের আক্রমণে ক্রমশ অঞ্চল হাতছাড়া হতে থাকে। হাম্মুরাবি তার জীবদ্দশায় যে বিশাল সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছিলেন, তার মৃত্যুর এক বছরের মাথায় অনেক নগর ও শহর তাদের স্বায়ত্তশাসন ঘোষণা করে। পরবর্তীতে হাম্মুরাবির উত্তরসূরিরা কেউই পুরো রাজ্যকে আর একত্রিত করতে পারেনি।
এসডব্লিউ/এসএস/১৮২০
আপনার মতামত জানানঃ