আমাদের নিজেদের নক্ষত্র নিয়ে কিছু কথা জানাটা জরুরি। আমাদের পৃথিবীর শক্তির উৎস সূর্য কিন্তু নিজেও এক বিশালাকার জ্বলন্ত গ্যাসপিণ্ড। মহাবিশ্বের ৯০ শতাংশ গ্রহকেই বামন নক্ষত্র বলা হয়ে থাকে। সূর্য তাদের একটি। বর্তমানে এটা বালক বয়সী।
আমাদের সূর্য সৌরজগতের প্রায় ১ দশমিক চার বিলিয়ন কিলোমিটার বা প্রায় ৮ লক্ষ ৭০ মাইল জুড়ে বিরাজমান। এটা এতটাই বড় যে আসলে যে কোনো মানদণ্ডেই এর বিশালত্ব চিন্তা করাটা বেশ কঠিন। আমাদের সৌরজগতের ৯৯ দশমিক ৯ শতাংশ ভরই সূর্যের একার। বাকিরা সবাই মিলে মাত্র দশমিক ১ শতাংশ ভরের অধিকারী। মোটামুটি তেরো লক্ষটা পৃথিবী যদি আমরা জড়ো করতে পারি তাহলে হয়ত সূর্যের সাইজের কাছাকাছি আসা যাবে।
আমাদের সবকিছু যেহেতু সূর্যকেই ঘিরে সেহেতু আমাদের হেভেনলি অবজেক্ট বা বিশালাকার বস্তুগুলোর যেমন নক্ষত্রের মাপজোক সূর্যকে স্ট্যাণ্ডার্ড বা মানদণ্ড ধরেই করা হয়ে থাকে। জ্যোতির্বিদরা বড় কোন নক্ষত্রের আকার আকৃতির পর্যালোচনার জন্য সূর্যের ভর আর সূর্যের ব্যাসার্ধকেই বিবেচনায় নেন। যেগুলোকে বলা হয় Solar Mass বা সৌর ভর ও Solar radius বা সৌর ব্যাসার্ধ। আবার সূর্য থেকে পৃথিবীর দূরত্বকে এক এস্ট্রোনমিকাল ইউনিট বা 1 A. U. বলা হয়। এক সৌর ব্যাসার্ধের ব্যাপ্তি প্রায় ৭ লক্ষ কিলোমিটার আর এক সৌরভরের পরিমাণ প্রায় 2 x 10^30 কিলোগ্রাম (4.3 x 10^30 পাউন্ড) মানে 2,000,000,000, 00,000,000,000,000,000,000 কেজি। বিজ্ঞানী চন্দ্রশেখর ভেঙ্কট রমণ দেখিয়েছেন সূর্যের চেয়ে বেশী ভরের নক্ষত্রদের আয়ুষ্কাল তুলনামূলক কম হয়। অন্তত সূর্যের তুলনায় কমই।
হিসাবের সুবিধার্তে বড় নক্ষত্রদের বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে ভাগ করা যেতে পারে; যেমন – জায়ান্ট, হাইপারজায়ান্ট, সুপারজায়ান্ট। আবার এই ক্যাটাগরিগুলোর মধ্যেও সাব-ক্যাটাগরি বিদ্যমান।
বড় নক্ষত্রের কথা বলতে গেলে দুটো ব্যাপার সামনে আসবেই। এক, সবচেয়ে ভারী নক্ষত্র। দুই, সবচেয়ে বড় আকৃতির নক্ষত্র। আজ পর্যন্ত আবিষ্কৃত সবচেয়ে ভারী নক্ষত্র R136a1। এটা সূর্যের চেয়ে ২৬৫ গুণ ভারী। তবে আমার আগ্রহ আকারে বড় নক্ষত্রদের ঘিরেই।
একটা বিশালাকার নক্ষত্রের দেখা পাওয়া যায় আমাদের গ্যালাক্সিতেই। এর নাম ইটা ক্যারিনেই Eta Carinae। ইটা ক্যারিনেই প্রায় ৭৫০০ আলোকবর্ষ দূরে অবস্থিত। এটার ভর সুর্যের ভরের ১২০ গুণ ও এর ব্যাসার্ধ সূর্যের ব্যাসার্ধের ২৫০ গুণ। এটা সূর্যের চেয়েও লক্ষ লক্ষ গুণ বেশি লুমিনাস বা উজ্জল। এটা প্রতি বছরই সৌর ঝড়ের পরিস্থিতি সৃষ্টি করে এবং পাঁচশোটা পৃথিবীর সমান ভর হারায়।
অতি নিকট ভবিষ্যতে নক্ষত্রটি বিষ্ফোরিত হবার সম্ভাবনা আছে এবং সম্ভবত আমরা অথবা আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম একটা সুপারনোভা বিষ্ফোরণ দেখার বিরল সুযোগ পাবে। আরেকবার সম্ভবত সুপারনোভা বিষ্ফোরণ হয়ত দেখা গিয়েছিল তিন হাজার বছর আগে। আমেরিকার আনাসাজি গোত্রের লোকজন একটি নক্ষত্র বিষ্ফোরণের অভূতপূর্ব দৃশ্য পাথরে খোদাই করেছিলেন। বিজ্ঞানী কার্ল সেগানের মহাকাব্যিক কসমস টিভি সিরিজের নবম এপিসোডে এই ব্যাপারে বিস্তারিত উল্লেখিত হয়েছে।
আরেকটা বড় নক্ষত্র আছে ওরায়ন (Orion) বা কালপুরুষ নক্ষত্রপুঞ্জে। এর নাম Betelgeuse (বীটেলজীউস)। এটি সূর্যের তুলনায় প্রায় ৯০০ থেকে ১২০০ গুণ বড়।
আরো কিছু নক্ষত্রের নাম উল্লেখ করা যেতে পারে যেমনSirus A, Pollux (orange giant), Arcturus (Red giant), Aldebaran(red giant), Rigel (blue hypergiant), Pistol star( blue hypergiant), Antares A ( Red supergiant) ইত্যাদি। এদের অধিকাংশই আকারে সূর্যের চেয়ে পাঁচশো থেকে এক হাজার গুণ বড় নক্ষত্র। তবে এরা কিছুই না।
সম্ভবত আজ পর্যন্ত আবিষ্কৃত সবচেয়ে বড় নক্ষত্র হল ইউওয়াই স্কুটি (UY Scuti)। আমি সম্ভবত কথাটি বলার কারণটায় পরে আসছি। এটা আছে Scutum নক্ষত্রপুঞ্জে। এটি একটি Red supergiant নক্ষত্র। এটি সূর্যের চেয়ে প্রায় ৩০ গুণ ভারী, কিন্তু এর ব্যাসার্ধ সূর্যের প্রায় ১৭০০ গুণ বা ১৭০০ সোলার রেডিয়াসের সমান। আমরা সাধারণত কোনো একটা নক্ষত্রকে বিবেচনার জন্য তার “edge” বা অ্যাটমোস্ফেরিক অংশ বাদে যা থাকে সেটাকে বলি ফটোস্ফিয়ার। সে হিসাবে যদি সূর্যের যায়গায় এই নক্ষত্র থাকতো তাহলে এটার ব্যাপ্তি বৃহস্পতির বলয়ের সীমানা অতিক্রম করতো।
আগেই বলেছি এই নক্ষত্রের আকার নিয়ে কিছুটা বিতর্ক আছে, কারণ এই নক্ষত্রটার উজ্জলতার রকমফের দেখা গেছে। কারণ সম্ভবত এর আকারে কিছুটা হেরফের ঘটে সময়ের পরিক্রমায়। এজন্য বলা হয়ে থাকে এর আকার নির্ধারণের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ ১৯২ সোলার রেডিয়াসের হেরফের ঘটার সম্ভাবনা রয়েছে। তবে যদি এর আকার যদি হিসাব করা আকারের চেয়ে ১৯২ সৌর ব্যাসার্ধ কম হয় তাহলে কিন্তু সবচেয়ে বড় নক্ষত্রের দৌড়ে তার বেশ কিছু প্রতিদ্বন্দী জুটে যাবে।
এই প্রতিদ্বন্দিতায় নিঃসন্দেহে যে নক্ষত্রের নামটা সবার আগে আসবে তা হলো (VY Canis Mejoris) ভিওয়াই ক্যানিস মেজোরিস। এটা একটা রেড হাইপারজায়ান্ট নক্ষত্র। স্কুটি নক্ষত্রের আবিষ্কারের আগে অবিসংবাদিতভাবে এটাই ছিল সবচেয়ে বড় নক্ষত্র। এটা অবস্থিত ক্যানিস মেজোরিজ নক্ষত্রপুঞ্জে।
এটি পৃথিবীর চেয়ে ৫০০০ আলোকবর্ষ দূরে অবস্থিত। এটা সূর্যের চেয়ে প্রায় ১৫৪০ গুণ বড়। এটার ব্যাস ২,৮০০,০০০,০০০ কিলোমিটার। কল্পনা করাটাও কষ্টসাধ্য। ঘণ্টায় ৯০০ কিলোমিটার বেগে কোনো বিমান যদি একে প্রদক্ষিণ করা শুরু করে তাহলে একে একবার চক্কর দিতে ১১০০ বছর সময় লেগে যাবে। এটাকে যদি আমরা সূর্যের যায়গায় বসাই, তাহলে এর ব্যাপ্তি শনির কক্ষপথ ছাড়িয়ে যাবে।
আমরা হয়তো কখনো জানতে পারবো না সবচেয়ে বড় নক্ষত্র কোনটা কিন্তু থিওরি অনুযায়ী আন্দাজ লাগানো সম্ভব যে এটা কেমন হতে পারে। নক্ষত্র যত বড় তার তাপমাত্রা আর উজ্বলতা ততই বেশি। নীল অতিদানব (Blue Supergiant) দের সৌরভর ১৬ এর চেয়েও বেশি, অর্থাৎ সূর্যের ১৬ গুণ। আর ওদের উজ্জ্বলতা সূর্যের ৩০,০০০ গুণেরও বেশি। সূত্র: বিজ্ঞানচিন্তা।
এসডব্লিউএসএস/১৮৫০
আপনার মতামত জানানঃ