ফ্রান্সভিত্তিক সংগঠন রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারসের প্রকাশিত ‘বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম সূচকে’ এ বছর আরও এক ধাপ পিছিয়েছে বাংলাদেশ। মাত্র ৩৫.৩১ স্কোর নিয়ে এ বছর বাংলাদেশের অবস্থান ১৬৩। দক্ষিণ এশিয়ার বাকি সবগুলো দেশের অবস্থাই বাংলাদেশের থেকে ভাল।
বুধবার প্রকাশিত ওই সূচকে দেখা গেছে, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সবার ওপরে আছে ভুটান। দেশটির অবস্থান ৯০তম। দক্ষিণ এশিয়ায় দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা নেপালের অবস্থান ৯৫তম। মালদ্বীপের অবস্থান ১০০তম, শ্রীলঙ্কার অবস্থান ১৩৫তম, পাকিস্তানের অবস্থান ১৫০তম, আফাগানিস্তানের অবস্থান ১৫২তম ও ভারতের অবস্থান ১৬১তম। এর আগে ২০২২ সালে বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১৬২তম। সেসময় বাংলাদেশের স্কোর ছিল ৩৬.৬৩।
বিশ্বজুড়ে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিয়ে কাজ করে রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারস (আরএসএফ)। তারাই প্রতি বছর বিশ্বের দেশগুলোতে গণমাধ্যমের স্বাধীনতার নানা দিক খতিয়ে এই রিপোর্ট তৈরি করে। বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম সূচক তৈরিতে আরএসএফ মূলত ৫টি বিষয় বিবেচনায় নেয়।
সেগুলো হচ্ছে, রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট, আইনি অবকাঠামো, অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপট, সামাজিক-সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপট ও নিরাপত্তা।
এ বছর এই সূচকে ৯৫.১৮ স্কোর নিয়ে সবার ওপরে আছে নরওয়ে। দ্বিতীয় অবস্থানে আয়ারল্যান্ড, দেশটির স্কোর ৮৯.৯১। তৃতীয় অবস্থানে থাকা ডেনমার্কের স্কোর ৮৯.৪৮। অপরদিকে সূচকে সবার নিচে অবস্থান করছে তুর্কমেনিস্তান। দেশটির স্কোর ২৫.৮২।
নিচের সারির দিক থেকে দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা সিরিয়ার স্কোর ২৭.২২। এর ওপরে থাকা পূর্ব আফ্রিকার দেশ ইরিত্রিয়ার স্কোর ২৭.৮৬।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশে গণমাধ্যম কতটা স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারছে তার ভিত্তিতে আরএসএফ গত ২০০২ সাল থেকে এই সূচক প্রকাশ করে আসছে। ২০১৩ সাল থেকে বাংলাদেশকেও সূচকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
এবছর মুক্ত গণমাধ্যম দিবসের ৩০তম বার্ষিকী পালিত হচ্ছে। বরাবরের মতোই এবার ১৮০টি দেশ ও অঞ্চলে সাংবাদিকতার পরিবেশের মূল্যায়ন করে তালিকাটি সম্পন্ন করা হয়েছে।
আরএসএফের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ৩১টি দেশে গণমাধ্যম পরিস্থিতি ‘খুবই গুরুতর’, ৪২টি দেশে ‘কঠিন’, ৫৫টি দেশে ‘সমস্যাগ্রস্ত’ এবং ৫২টি দেশে ‘ভালো’ বা ‘সন্তোষজনক’।
প্রতিবেদনটির সারসংক্ষেপ হলো, দশের মধ্যে সাতটি দেশেই সাংবাদিকতার পরিবেশ ‘খারাপ’ এবং মাত্র তিনটিতে সন্তোষজনক।
আরএসএফ মহাসচিব ক্রিস্টোফ ডেলোয়ার বলেছেন, “এ বছর আরএসএফের মানচিত্রে আগের চেয়ে আরও বেশি রেডমার্ক দেখা যাচ্ছে, কারণ কর্তৃত্ববাদী শাসকেরা গণমাধ্যমের মুখ চেপে ধরতে ক্রমশ আরও বেশি সাহসী হয়ে উঠছেন। এই প্রবণতা ঠেকাতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে একজোট হয়ে কাজ করতে হবে।”
সূচকে ধাপে ধাপে অবনতি
কোন দেশ গণতান্ত্রিকভাবে কতটুকু শক্তিশালী, সেটি পরিমাপে যেসব নির্দেশক রয়েছে তার মধ্যে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ হলো সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার সূচক।
রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডার্সের করা এই সূচকে ২০২২ সালে ১৮০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ ছিল ১৬২তম স্থানে, যা ২০২১ সালে ছিল ১৫২তম। অর্থাৎ এক বছরের ব্যবধানে ১০ ধাপ পিছিয়ে গেছে বাংলাদেশের অবস্থান।
বাংলাদেশের অবস্থান ২০২০ সালের সূচকে ছিল ১৫১তম। এর আগে ২০১৯ সালে ১৫০তম, ২০১৮ ও ২০১৭ সালে ১৪৬তম, ২০১৬ সালে ১৪৪তম, ২০১৫ ও ২০১৪ সালে ১৪৬তম অবস্থানে ছিল বাংলাদেশ।
অর্থাৎ, শেষ ছয় বছরে বাংলাদেশের অবস্থান দু-চার ধাপ করে অবনতি হলেও ২০২২ এর হিসেবে তা এক ধাক্কায় ১০ ধাপ নেমে যেতে দেখা যাচ্ছে।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশে গণমাধ্যম কতটা স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারছে, তার ভিত্তিতে ২০০২ সাল থেকে আরএসএফ এই সূচক প্রকাশ করে আসছে। ২০১৩ সাল থেকে এই সূচকে বাংলাদেশ আছে।
আরএসএফের প্রতিবেদনে সংবাদপত্রের স্বাধীনতার বিষয়টি পাঁচটি শ্রেণীতে ভাগ করা হয়েছে। সেগুলো হল—অতি সংকটজনক, অসুবিধাজনক, সমস্যামূলক, সন্তোষজনক ও ভালো। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ আছে অতি সংকটজনক পরিস্থিতিতে।
বাংলাদেশের সাংবাদিকতার পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করতে গিয়ে আরএসএফ তাদের প্রতিবেদনে জানায়, বাংলাদেশে ক্ষমতাসীন সরকারের নেতা ও কর্মী-সমর্থকরা প্রায়ই সাংবাদিকদের ওপর চড়াও হন।
তাদের সংবাদ প্রকাশ ঠেকাতে মামলা দায়েরসহ নানাভাবে হয়রানি করা হয়। কিন্তু গণতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় সংবাদমাধ্যম বা সাংবাদিকের ওপর এমন প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ চাপ প্রয়োগের কঠিন সমালোচনা করেছে সংস্থাটি।
এদিকে, নির্বাচনের সময় যতো এগিয়ে আসবে, এই পরিস্থিতি আরও অবনতি হবে বলে মনে করেন আর্টিকেল নাইনটিনের এশীয় আঞ্চলিক পরিচালক ফারুক ফয়সাল।
“নির্বাচন যদি সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ না হয়। তাহলে বিদেশি পর্যবেক্ষকরা সেটি তাদের প্রতিবেদনে উল্লেখ করবেন। তখন সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার সূচকে আরও অবনতি হবে।”
তবে বাংলাদেশের সংবিধানে সংবাদপত্রের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দেওয়া হয়েছে। সংবাদ প্রকাশের ক্ষেত্রে যেসব বিষয়ে বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে তার মধ্যে রাষ্ট্রের নিরাপত্তা, বিদেশি রাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক, জনশৃঙ্খলা, আদালত অবমাননা, মানহানি, অপরাধ সংঘটনে প্ররোচনা।
আইনের মাধ্যমে দমন
সাংবাদিকতায় ভিন্নমত দমনে সরকার আইনি কাঠামোয় বড় ধরণের পরিবর্তন এনেছে বলে জানান ডেইলি স্টারের সম্পাদক এবং সম্পাদক পরিষদের চেয়ারম্যান মাহফুজ আনাম।
তিনি জানান, বাংলাদেশে বর্তমানে গণমাধ্যমের বিরুদ্ধে নয়টি আইন প্রয়োগ হচ্ছে তার সবশেষ সংস্করণ ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন। আরও চারটি আইন খসড়া পর্যায়ে আছে। আরও নতুন নতুন আইন প্রণয়নে তোড়জোড় চলছে। সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে অহরহ এসব আইনের অপব্যবহার হচ্ছে বলে তিনি মনে করেন।
তিনি বলেন, “বাংলাদেশে দুর্নীতি, চুরি, পাচার, মানি লন্ডারিংয়ের বিরুদ্ধেও এতো আইন নেই, যতোটা সাংবাদিকতার বিরুদ্ধে রয়েছে।”
আনামের বিরুদ্ধে ৮৪টি মামলা রয়েছে বলে তিনি জানিয়েছেন। গণমাধ্যমকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য বাংলাদেশে যতো আইন হয়েছে এর বেশিরভাগ ১৮৬০ সালের ফৌজদারি দণ্ডবিধি আইন দ্বারা প্রভাবিত বলে তিনি মনে করেন।
আইনটির ১২৪ এর ‘ক’ ধারায় রাষ্ট্রদ্রোহের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে বলা হয়েছে, যে ব্যক্তি কথায়, লিখে, কোন চিহ্ন বা প্রতীক দিয়ে সরকারের প্রতি ঘৃণা বা বিদ্বেষ সৃষ্টি করে তাকে যাবজ্জীবন বা এর কম মেয়াদের কারাদন্ডে এবং অর্থদণ্ডে দণ্ডিত করা হবে। অর্থাৎ সরকারের বিরুদ্ধে কিছু বলা যাবে না।
এ ব্যাপারে আনাম বলেন, “এই আইনটি প্রণয়ন করা হয়েছে ১৬৩ বছর আগে, ব্রিটিশ উপনিবেশ আমলের। ব্রিটিশ কমনওয়েলথের প্রায় সব দেশ এই আইন অনেক আগেই বাতিল করেছে। ভারতের সুপ্রিম কোর্ট ও পাকিস্তানে লাহোর হাইকোর্ট এই আইনকে অসাংবিধানিক বলে বাতিল ঘোষণা করেছে। শুধুমাত্র বাংলাদেশে এই আইন বা এর দ্বারা প্রভাবিত আইন প্রবলভাবে ব্যবহার হচ্ছে। অর্থাৎ বাংলাদেশ আধুনিক রাষ্ট্র হিসেবে আবির্ভূত হলেও সেটার কোন প্রতিফলন মুক্ত গণমাধ্যম চর্চার ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে না।”
সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে এসব মামলা দায়েরের কারণ হিসেবে সরকারের পক্ষ থেকে প্রায়শই ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণের কথা বলা হয়।
কিন্তু আইনে ভাবমূর্তি, চেতনা ইত্যাদির স্পষ্ট কোন সংজ্ঞায়ন বা ব্যাখ্যা দেয়া হয়নি। এতে একই কথার অনেক অর্থ দাঁড় করানো যায় ফলে যে কেউ ইচ্ছামতো মামলা করে সাংবাদিকদের কোণঠাসা করতে পারে বলে মনে করেন মাহফুজ আনাম।
এসডব্লিউএসএস/১০৫৫
আপনার মতামত জানানঃ