রোহিঙ্গা ইস্যুতে শুরু থেকেই ভারত বাংলাদেশের পক্ষে ভোট দেওয়া থেকে বিরত থাকে। ফলে নীরব ভোটটি গিয়ে পড়ে ভারতের আরেক বন্ধুপ্রতিম প্রতিবেশি দেশ মিয়ানমারে। এরপর কতো পানি ঘোলা হলো, আবার পরিষ্কার হলো, বাংলাদেশের সাথে ভারতের সম্পর্কোন্নয়নে কতো কতো দিন পার হলো, বাংলাদেশের পক্ষ থেকে কতো কতো সুযোগ সুবিধা দেওয়া হলো সম্পর্ক ধরে রাখতে, তবুও যেন ভারতের পাহাড়সমান অজানা বরফ গলেনি। এবারো রোহিঙ্গা ইস্যুতে ভারত আগের মতোই কৌশলগত অবস্থান নিয়েছে। ভোট দেয়নি মিয়ানমার সরকারের অত্যাচার নির্যাতনের বিরুদ্ধে। তবে এক্ষেত্রে বাংলাদেশের আরেক বন্ধু রাষ্ট্র চীন স্পষ্ট করেই বরাবরের মতো জানিয়ে দিয়েছে তারা মিয়ানমারের সরকারের পক্ষে আছে।
তবে আলোচিত ওই ইস্যুতে আফ্রিকা ও প্রশান্ত মহাসাগরের ৯টি দেশ তাদের অবস্থান পরিবর্তন করে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে ভোট দিয়েছে। ২০১৯ সালে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে মিয়ানমারের রোহিঙ্গা ও অন্যান্য সংখ্যালঘুবিষয়ক প্রস্তাবের পক্ষে বা বিপক্ষে কোনো অবস্থান না নিয়ে ভোটদানে বিরত থেকেছিল ওই ৯টি দেশ। জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের কর্ম অধিবেশনে ক্যামেরুন, ইকুয়েটরিয়াল গিনি, নামিবিয়া, কেনিয়া, লেসেথো, মোজাম্বিক, তানজানিয়া, পালাউ ও সলোমন দ্বীপপুঞ্জ—এ নয় দেশ মিয়ানমারের বিরুদ্ধে আনা একটি প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দিয়েছে।
আজ শনিবার(০২ জানুয়ারি) নিউইয়র্কের কূটনৈতিক সূত্র, মিয়ানমারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ফেসবুক পেজ এবং আনান কমিশনের এক সদস্যের টুইট থেকে এ তথ্য পাওয়া গেছে।
গত বৃহস্পতিবার রাতে ওই ভোটাভুটিতে প্রস্তাবের বিপক্ষে অর্থাৎ মিয়ানমারের পক্ষে ভোট দিয়েছে মিয়ানমার, চীন, রাশিয়া, বেলারুশ, কম্বোডিয়া, লাওস, ফিলিপাইন, ভিয়েতনাম ও জিম্বাবুয়ে। আর ভারতসহ দক্ষিণ এশিয়ার তিন দেশ শ্রীলঙ্কা, নেপাল, ভুটান ও জাপানসহ ২৫টি দেশ প্রস্তাবের ভোটাভুটি থেকে নিজেদের বিরত রেখেছে। প্রস্তাবটির পক্ষে ১৩০টি ভোট পড়েছে। আর বিপক্ষে পড়েছে ৯টি ভোট।
ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) ও ইসলামি সহযোগিতা সংস্থা (ওআইসি) গত বছরের নভেম্বের জাতিসংঘের তৃতীয় কমিটিতে প্রস্তাবটি আনে। ইইউ এবং ওআইসির আনা প্রস্তাবে আন্তর্জাতিক বিচার আদালতের (আইসিজে) অন্তর্বর্তীকালীন আদেশ, আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের (আইসিসি) তদন্ত শুরুর প্রসঙ্গ এবং রোহিঙ্গা ও সংখ্যালঘু অন্য জনগোষ্ঠীদের মিয়ানমারের জাতীয় নির্বাচনসহ অন্যান্য ক্ষেত্রে অব্যাহতভাবে বঞ্চিত করার মতো বিষয়গুলো উঠে এসেছে। রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব দেওয়া, প্রত্যাবাসনের সহায়ক পরিবেশ সৃষ্টিসহ আরও কিছু বিষয়ে মিয়ানমারকে পদক্ষেপ নেওয়ার কথাও ওই প্রস্তাবে বলা হয়েছে।
বরাবরের মতো ভারত এবারো ভোটদানে নীরবতা পালন করেছে।
এবিষয়ে আন্তর্জাতিক কূটনীতিবিদরা মনে করেন, ভারতের অবস্থাটা আসলে খুব জটিল। একদিকে বাংলাদেশ, অন্য দিকে মিয়ানমার—দুজনের সাথেই ভারতের সম্পর্ক খুব ভাল, দুজনকেই ভারতের দরকার। কিন্তু এই রোহিঙ্গা প্রশ্নটা এমন একটা ইস্যু, যাতে এই দুই সম্পর্কের মধ্যে ব্যালান্সিং করাটা ভারতের পক্ষে খুব কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে।
একদিকে মিয়ানমার কিছুতেই চাইবে না তাদের ওপর আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হোক, অন্যদিকে বাংলাদেশেরও আবার জেনুইন কনসার্ন আছে, উদ্বিগ্ন হওয়ার মতো সত্যিকারের কারণ আছে। ফলে ভারতের জন্য এটা এক ধরনের ক্যাচ টোয়েন্টিটু সিচুয়েশন বলা যায় বলে মনে করেন তারা। তারা মনে করেন, মিয়ানমারে ভারত নিজেদের অবস্থান শক্ত করতে চাইছে। ফলে মিয়ানমারকে তারা কোনোভাবেই বিরক্ত করতে চাইবে না।
তবে ভারতের এ সতর্কতার আরো অনেক কারণ রয়েছে। মিয়ানমারের নতুন শাসকগোষ্ঠীর সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলার গুরুত্ব থেকেই দিল্লির এই নীরবতা বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। বলেন, বঙ্গোপসাগর থেকে চীনকে দূরে রাখা ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সঙ্গে সংযুক্তির ক্ষেত্রে মিয়ানমারের গুরুত্ব রয়েছে। তা ছাড়া প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির দেশের মানুষের কাছেও রোহিঙ্গা ইস্যুটি বাংলাদেশের হিন্দু নির্যাতনের মতো ঘটনার চেয়ে অনেক কম গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
চীন ভারতের সম্পর্ক নিয়ে গোটা বিশ্বই অবগত রয়েছে। বিভিন্ন সময়েই দুই দেশের মধ্যে সহিংস দ্বন্দ্বও পরিলক্ষিত হয়। ক’দিন আগেই ভারত-চীনের মধ্যে দুদিন আগেই রীতিমতো যুদ্ধ বাধার অবস্থা তৈরি হয়েছিল। এবং দুজনার সম্পর্কটাই এমন যে যেকোনো মুহূর্তে যুদ্ধ বেঁধে যেতে পারে। অথচ মিয়ানমারের রোহিঙ্গা ইস্যু এই দুই দেশকে কৌশলগতভাবে এক জায়গায় নিয়ে এসেছে। রাখাইন রাজ্য ও রোহিঙ্গা ইস্যুতে মিয়ানমার যে অবস্থান নিয়েছে, মানে একে ‘ইসলামি সন্ত্রাসবাদের’ বিপদ তুলে ধরার যে কৌশল নিয়েছে, চীন ও ভারত বিষয়টিকে সেভাবেই দেখছে বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা।
বিশ্লেষকরা বলেন, ইসলামি সন্ত্রাসবাদ ছড়িয়ে পড়তে পারে এমন যেকোনো পরিস্থিতি এতটাই ভয়ের যে চীন ও ভারতের মতো দেশকে তা এক ঘাটে নিয়ে এসেছে। এ নিয়ে বাংলাদেশেরও কম ভয় নেই। তা না হলে আরসার হামলার পর বাংলাদেশের তরফে মিয়ানমারের সঙ্গে যৌথ অভিযানের কথা বলা হতো বলে মনে হয় না। বাংলাদেশ সরকারের এই বক্তব্য নিয়ে অনেক সমালোচনা হচ্ছে, কিন্তু ‘ইসলামি জঙ্গিবাদের’ নাম-নিশানা যেখানে আছে, সেখানে অবস্থান না নিয়ে চুপ থাকা কঠিন। আরসাকে একটি জাতীয়তাবাদী সংগঠন হিসেবে বিবেচনা করার অনেক কারণ রয়েছে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, ইসলামি সন্ত্রাসবাদের ‘গন্ধ’ থেকে একে মুক্ত রাখা কঠিন। মিয়ানমারের রোহিঙ্গা নীতির কারণে সত্তরের দশকের শেষের দিকে ‘ইসলামিক রিপাবলিক অব নর্থ আরাকান’ নামে স্বাধীন একটি দেশ গঠনে সশস্ত্র আন্দোলনের বিষয়টি তো আর ইতিহাস থেকে মুছে যায়নি! সব মিলিয়ে বাংলাদেশের জন্য পরিস্থিতি শুধু মহাসংকটের নয়, উভয় সংকটেরও।
রোহিঙ্গাদের নিয়ে বাংলাদেশের কূটনৈতিক তৎপরতা যথেষ্ট নয় বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা। তারা মনে করেন, বাংলাদেশের পক্ষ থেকে যে কূটনৈতিক তৎপরতা নেই, তা নয়৷ কিন্তু যতটা হওয়া প্রয়োজন ততটা হচ্ছে না৷ বাংলাদেশে পক্ষ থেকে রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে আরো জোরালো প্রতিবাদ এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনে শক্ত অবস্থান নেয়া উচিত৷ আর সেই শক্ত অবস্থান নেয়ার সুযোগও তৈরি হয়েছে৷ কারণ আন্তর্জাতিক অঙ্গনে রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতনের বিষয়টি ব্যাপক প্রতিবাদ ও নিন্দার মুখে পড়ছে৷ তারা মনে করেন, বাংলাদেশ শুরু থেকেই দ্বিপাক্ষিকভাবে সমস্যাটি সমাধানের চেষ্টা করেছে৷ বিবেচনা করেছে মিয়ানমারের সঙ্গে সম্পর্ক, ব্যবসা-বাণিজ্য৷ ফলে আর্ন্তজাতিকভাবে এর সমাধানের দিকে যায়নি বাংলাদেশ৷ এখন আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বিষয়টি নিয়ে বাংলাদেশ কূটনৈতিক তৎপরতা চালাচ্ছে৷ তবে তা ততটা শক্তিশালী নয়৷
এসডাব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৯৩৫
আপনার মতামত জানানঃ