হাঙর সবচেয়ে রহস্যময় এবং আশ্চর্যজনক প্রাণী হিসাবে বিবেচিত। বিভিন্ন গবেষণা দেখা গেছে ৫০০টিরও বেশি প্রজাতির হাঙর রয়েছে। এগুলোর আকার কয়েক ইঞ্চি থেকে ৫ মিটার পর্যন্ত বিস্তৃত হতে পারে। মহাসাগরের সবচেয়ে প্রাচীনতম এই প্রাণীটি নিয়ে মানুষের কৌতূহলের কমতি নেই। হাঙর মানুষখোকো হিসেবেও পরিচিত। এজন্যই মহাসাগরের যেসব স্থানে হাঙরের বসবাস সেখান থেকে মানুষ একটু দূরেই থাকেন!
গ্রিনল্যান্ডের হাঙর যেন আরো বেশি রহস্যময়। প্রথম এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধেরও সাক্ষী ছিল তারা। নাম গ্রিনল্যান্ডের হাঙর হলেও শুধু গ্রিনল্যান্ডেই থাকে না। ক্যারিবিয়ান সাগরেও দিব্যি খেলে বেড়ায় তারা। তবে বরফশীতল সাগর, মহাসাগরের গভীরেই তাদের চলাচল। সূর্যের মুখ দেখতে তারা সাঁতরে উপরে ওঠে না সাধারণত। সাধারণত মাইনাস ১ থেকে ১০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় থাকাই তাদের পছন্দ।
মানুষের কাছে বহু বছর পর্যন্ত অধরাই ছিল তারা। ১৯৯৫ সালে প্রথম বার এই হাঙরের ছবি তুলতে সক্ষম হন গবেষকরা। তারও ১৮ বছর পর প্রথম বার এই প্রাণীর ভিডিয়ো ধরা পড়ে। গ্রিনল্যান্ডের হাঙর যখন পূর্ণবয়স্ক হয়, তখন তাদের আকার হয় সাদা হাঙরের (গ্রেট হোয়াইট) মতো। তবু সাদা হাঙরের সঙ্গে অনেক পার্থক্য রয়েছে গ্রিনল্যান্ডের হাঙরের।
এই হাঙরের বৈজ্ঞানিক নাম সমনিওসাস মাইক্রোসেফালাস। কয়েকশ বছর বাঁচে এই হাঙর। আর অন্তত দেড়শ বছর না হলে সঙ্গম করতে পারে না। এসব হাঙরের পেশিতে থাকে প্রচুর পরিমাণে টক্সিন। তাই এই মাছ খেলে মারাত্মক নেশা হতে পারে। এই মাছ শিকার করে তাই রোদে শুকিয়ে নেয়া হয়। তার পরেই খাওয়া যায়।
গ্রিনল্যান্ডের এই হাঙর নিয়ে দীর্ঘ গবেষণা করেছেন ইন্ডিয়ানা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানী পিটার জি বুশনেল। তিনি জানিয়েছেন, এই পৃথিবীতে যত প্রাণী রয়েছে, তার মধ্যে সম্ভবত সবচেয়ে বেশি বছর বাঁচে গ্রিনল্যান্ডের হাঙর। কত বছর বাঁচে এরা? বুশনেলের দাবি, চারশ বছর বা তার বেশি সময়ও বাঁচতে পারে এই হাঙর।
কোনো গ্রিনল্যান্ডের হাঙর যদি স্বল্প সময়ও বাঁচে, তা হলেও তা ২৭২ বছরের কম নয়। বাওহেড তিমি গড়ে ২১১ বছর বাঁচে। তার থেকেও বেশি বাঁচে গ্রিনল্যান্ডের হাঙর। বুশনেল জানিয়েছেন, গ্রেট হোয়াইট হাঙর বাঁচে ৮০ থেকে ৯০ বছর। বয়সে গ্রিনল্যান্ডের হাঙর তাদের বৃদ্ধ পিতামহের মতো।
কীভাবে এত বছর বাঁচে গ্রিনল্যান্ডের হাঙর? বুশনেল জানিয়েছেন, তার নেপথ্যে রয়েছে দু’টি কারণ। এই হাঙরের বিশাল আকার আর ঠান্ডা আবহাওয়া। বিজ্ঞানী বুশনেল জানিয়েছেন, রাসায়নিক বিক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করে তাপমাত্রা। তাপমাত্রা বাড়লে বেশি কিছু রাসায়নিক বিক্রিয়া তাড়াতাড়ি হয়। আর ঠান্ডার কারণে কিছু বিক্রিয়া খুব ধীরে হয়। এমনকি কখনও কখনও তা বন্ধ হয়ে যায়। গ্রিনল্যান্ডের হাঙরের শরীরে কলাগুলো ঠান্ডায় প্রায় জমে যায়। সে কারণে বেশ কিছু বিক্রিয়া অনেক দেরিতে হয়। এমনকি বিপাকক্রিয়াও ধীরে হয়।
বিপাকক্রিয়ার কারণে শরীরের খাবার শক্তিতে পরিণত হয়। এই বিপাকক্রিয়া ছোট প্রাণীর মধ্যে খুব দ্রুত হয়। আর বড় প্রাণীর মধ্যে ধীরে হয়। ধীরে বিপাকক্রিয়া হল বলে অন্যান্য শারীরিক ক্রিয়াও ধীরে হয়। একই কারণে বয়স বৃদ্ধিও (এজিং) হয় ধীরে। যে কারণে ইঁদুরের থেকে হাতি অনেক বেশি বছর বাঁচে।
ফ্লোরিডা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানী জর্জ এইচ বার্জেসও বুশনেলের সঙ্গে সহমত। তার মতে, যা মনে করা হচ্ছে, তার থেকেও হয়ত বেশি বছর বাঁচে গ্রিনল্যান্ডের হাঙর। বুশনেল গ্রিনল্যান্ডের প্রায় ২৮টি স্ত্রী হাঙরকে নিয়ে পরীক্ষা চালিয়েছেন। তাতে দেখা গেছে, ওই হাঙরগুলির বয়স ২৭২ থেকে ৫১২ বছর।
বয়স যত বাড়ে, তত হাঙরের বৃদ্ধি কমে যায়। তাই বিজ্ঞানীরা মনে করছেন, যে হাঙর যত দীর্ঘ, তার বয়স তত বেশি। একটি হাঙরের ১৫০ বছর বয়স না হলে সে সঙ্গমে সক্ষম হয় না। বিজ্ঞানীরা মনে করেন, গভীর সমুদ্রে বিচরণকারী বেশির ভাগ প্রাণীই বহু বছর বাঁচে। ঠান্ডার কারণেও তাদের আয়ু বাড়ে। বহু বছর বাঁচে বলে তাদের প্রজনন ক্ষমতা আসে অনেক বয়সে। যেমন গ্রিনল্যান্ডের হাঙরের ক্ষেত্রে হয়েছে।
শত শত বছর বেঁচে থাকলেও গ্রিনল্যান্ডের হাঙর কিন্তু বিপজ্জনক নয়। মানুষকে আক্রমণ করেছে বলে প্রমাণ পাননি গবেষকরা। স্থানীয়রা অনেক সময় দাবি করেন, মাছ ধরার ছোট নৌকা (কায়াক) দেখলে হামলা করে তারা। তবে গবেষকরাই এই দাবি মানেননি। তাঁরা জানিয়েছেন, মানুষ আক্রমণ না করলে এই হাঙর হামলা চালায় না।
গবেষণায় দেখা গেছে, গ্রিনল্যান্ডের হাঙর খুব ভাল ডুবুরি। ২২০০ মিটার (৭,২১৮ ফুট) পর্যন্ত গভীরে চলে যায় তারা। গবেষকদের অনেকেই গ্রিনল্যান্ডের হাঙরকে সমুদ্রের শকুন বলে থাকেন। তার কারণ এদের খাদ্যাভ্যাস। হেন কোনো জিনিস নেই, যা এই হাঙর খায় না। মূলত সিল আর মাছ খায় তারা। তবে তা না পেলে যা প্রাণী পায়, সবেরই মাংস খায় এরা। কোনো কিছুই ফেলে দেয় না। অনেক গবেষকই মনে করেন, সব কিছু খেতে পারে বলেই এরা শত শত বছর বেঁচে রয়েছে। কোনোদিন খাদ্যাভাবে ভোগে না।
এসডব্লিউ/এসএস/১২৩০
আপনার মতামত জানানঃ