ইউরোপীয় ইউনিয়নে অবৈধ অনুপ্রবেশের পর উদ্বাস্তু হিসেবে স্বীকৃতি পেতে বাংলাদেশিরা মূলত ইতালি এবং ফ্রান্সকেই বেছে নিচ্ছেন। ইউরোপের বিভিন্ন দেশে রাজনৈতিক আশ্রয় চাওয়ার তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান সপ্তম।
ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) পরিসংখ্যান সংস্থা ইউরোস্ট্যাটের উপাত্তে এ তথ্য বেরিয়ে এসেছে। ইউরোপে অনেক অভিবাসন প্রত্যাশী ভূমধ্যসাগর দিয়ে অবৈধপথে পাড়ি জমান আবার কেউ যান বৈধপথে। গত দুই বছরে ৫০ হাজার ৭৯০ বাংলাদেশি ইউরোপে রাজনৈতিক আশ্রয় চেয়েছেন।
কেন এত বিপুল সংখ্যক মানুষ সুরক্ষা চাইছে?
ইউরোপে বাংলাদেশিদের রাজনৈতিক আশ্রয়ের আবেদন ক্রমেই বাড়ছে। বৈশ্বিক অস্থিরতায় বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকেই ইউরোপের দেশগুলোতে রাজনৈতিক আশ্রয় চাওয়ার আবেদন বেড়েছে। বাংলাদেশি আবেদনকারীদের ক্ষেত্রেও এ হার ঊর্ধ্বগামী। ইউরোপের ২৭ দেশের জোট ইউরোপীয় ইউনিয়ন সর্বশেষ গত ২৩ মার্চ এক প্রতিবেদনে প্রকাশ করেছে যে, গত জানুয়ারিতে ইইউ দেশগুলোতে আশ্রয় পাওয়ার জন্য ৯২ হাজার আবেদন পড়েছে, যার মধ্যে ৩ হাজার ৪৭১ জন বাংলাদেশিও রয়েছে। গত ডিসেম্বর মাসেও সমপরিমাণ আশ্রয় আবেদন পড়েছিল বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।
এর আগে গত ফেব্রুয়ারিতে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বৈশ্বিক এই সংস্থা জানিয়েছে, গত বছর ইইউভুক্ত দেশগুলোতে প্রায় ১০ লাখ রাজনৈতিক আশ্রয় আবেদন পড়েছিল, যা গত ২০১৬ সালের পর থেকে সর্বোচ্চ। ওই বছর বাংলাদেশ থেকেও সর্বোচ্চ পর্যায়ের আশ্রয় আবেদনের তথ্য উল্লেখ করেছে ইইউ, যেখানে বাংলাদেশ সপ্তম স্তরে রয়েছে। গত বছর বাংলাদেশ থেকে ৩৩ হাজার ৭২৯ জন রাজনৈতিক আশ্রয় আবেদন করে, যা ২০০৮ সালের পর সর্বোচ্চ।
নিজ দেশে বর্ণ, ধর্ম, জাতীয়তা, রাজনৈতিক কারণে কেউ নির্যাতনের শিকার হলে বা কারও জীবন হুমকির মুখে থাকলে তিনি আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী ইউরোপের দেশগুলোতে সুরক্ষা চেয়ে আবেদন করতে পারেন।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে কত সংখ্যক আবেদন জমা পড়ছে, তা নিয়ে ২০১৪ সাল থেকে প্রতিবছর হালনাগাদ প্রতিবেদন প্রকাশ করে আসছে ইইউ। ইউরোপীয় ইউনিয়নের পরিসংখ্যান ব্যুরো ইউরোস্ট্যাট জানাচ্ছে, ২০২২ সালে ইতালিতে এসাইলাম কেইস করা নন-ইইউ দেশের তালিকায় শীর্ষে আছে বাংলাদেশিরা (১৪ হাজার ৫৯০)।
বাংলাদেশের পরের ৪ দেশ পাকিস্তান (১১ হাজার ৩৭০), মিশর (৮ হাজার ৮৩৫), তিউনিসিয়া (৫ হাজার ৩৬৫) এবং জর্জিয়া (৩ হাজার ২৪০)। ইতালিতে অন্য সব দেশ মিলে ৩৩ হাজার ৮০৫।
প্রতিবেশী দেশ ফ্রান্সে ২০২২ সালে আশ্রয় প্রার্থী নন-ইইউ দেশের তালিকায় বাংলাদেশ শীর্ষস্থান দখল করতে না পারলেও ২য় স্থানে আছে। ফ্রান্সে গত বছর ২২ হাজার ৫৮৫ জন আফগান আশ্রয় প্রার্থনা করে, তালিকায় যার পরেই আছে ১০ হাজার ৫৫৫ জন বাংলাদেশি।
তৃতীয় অবস্থানে তুরস্ক (১০ হাজার ৫), জর্জিয়া (৮ হাজার ৯০৫) এবং কঙ্গো (৬ হাজার ৭৬০)। ফ্রান্সে অন্য সব দেশ মিলে ৭৮ হাজার ৬৯৫। ইতালি ও ফ্রান্সের বাইরে বাংলাদেশের নাগরিকরা রোমানিয়ায় ১ হাজার ৩৬০, স্লোভেনিয়ায় ৮২৫, মাল্টায় ৭৫ এবং স্লোভাকিয়ায় ৫৫ জন আশ্রয় প্রার্থনা করে।
ইউরোস্ট্যাট পরিসংখ্যানে ২০২১ এবং ২০২২ দুই বছরে সমগ্র ইউরোপীয় ইউনিয়নে আশ্রয় প্রার্থনা করা নন-ইইউ দেশের তালিকায় বাংলাদেশকে দেখা যাচ্ছে ৭ম স্থানে।
বাংলাদেশের আগে ১ থেকে ৬ নাম্বার দেশ যথাক্রমে সিরিয়া, আফগানিস্তান, ভেনিজুয়েলা, তুরস্ক, কলম্বিয়া ও পাকিস্তান। আফ্রিকার বিভিন্ন দেশের স্থান এই তালিকায় বাংলাদেশের পরে। নন-ইইউ সব দেশ মিলিয়ে শুধুমাত্র ২০২২ সালে ৯ লাখ ৬২ হাজার ১৬০ জনের আবেদন জমা হয়। এর মধ্যে আবেদন গৃহীত হয় ৩ লাখ ৮৪ হাজার ২৮৫ জনের।
কেইস এক্সেপ্ট যাদের হয়েছে তাদের ৪৪% পলিটিক্যাল এসাইলাম (রাজনৈতিক আশ্রয়), ৩১% সাবসিডিয়ারি প্রটেকশন (সহায়ক আশ্রয়) এবং ২৫% হিউম্যানিটারিয়ান প্রটেকশন (মানবিক আশ্রয়)।
গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে- আশ্রয়প্রাপ্ত উদ্বাস্তুদের দেশের তালিকার প্রথম দশে নেই বাংলাদেশের নাম। প্রথম ১০ দেশ যথাক্রমে সিরিয়া (১ লাখ ৯ হাজার ৮১৫), আফগানিস্তান (৮৭ হাজার ৫৩০), ভেনিজুয়েলা (২২ হাজার ৩৫০), ইরাক (১৩ হাজার ৩৫), সোমালিয়া (১১ হাজার ৭৪০), তুরস্ক (১০ হাজার ৭৫০), ইউক্রেন (৯ হাজার ৪৪৫), নাইজেরিয়া (৯ হাজার ৪১৫), মালি (৮ হাজার ৫৬০) এবং ইরিত্রিয়া (৮ হাজার ১৪৫)।
জার্মানিতে সবচাইতে বেশি আবেদন মঞ্জুর হয়েছে উদ্বাস্তু হিসেবে ২০২২ সালে। ইউরোস্ট্যাটের হিসেবের খাতায় এই সংখ্যাটি ১ লাখ ৫৯ হাজার ৩৬৫, যা ইইউ’র সব দেশে মোট আশ্রয়প্রাপ্ত উদ্বাস্তুর সংখ্যা ৪১%। জার্মানির পরের তিনটি দেশ হচ্ছে- ফ্রান্স (৪৯ হাজার ৯৯০), ইতালি (৩৯ হাজার ৬৬০) ও স্পেন (৩৫ হাজার ৭৬৫)।
প্রত্যাখ্যাত হচ্ছে কেন?
ইউরোপীয় ইউনিয়নের বিভিন্ন দেশে বিশেষ করে ইতালি ও ফ্রান্সে ২০২১ ও ২০২২ সালে উদ্বাস্তু হিসেবে আশ্রয় আবেদন করা অধিকাংশ বাংলাদেশির কেইস ঝুলে আছে চরম অনিশ্চিত অবস্থায়। একটা বড় অংশের আবেদন ইতিমধ্যে প্রত্যাখ্যাত (রিজেক্ট) হয়েছে। এর নেপথ্যে যে বিষয়গুলো কাজ করছে তার মধ্যে প্রধান হচ্ছে ইউরোপীয় প্রশাসনের কাছে বাংলাদেশ যুদ্ধবিধ্বস্ত কিংবা দুর্ভিক্ষপীড়িত কোন রাষ্ট্র নয়।
কারণ হিসেবে আরও যোগ হয়েছে বাংলাদেশি পাসপোর্ট কেলেংকারি অর্থাৎ বয়স কম দেখিয়ে নিজেদেরকে অপ্রাপ্ত বয়স্ক দাবি করে আন্ডার এইজ কিন্ডার (বাম্বিনো) কেইস করার পর তার সাথে মিল রেখে বাংলাদেশ দূতাবাস থেকে চাহিদা মাফিক নতুন পাসপোর্ট পেতে বিড়ম্বনা। সব মিলিয়ে খুব একটা ভালো নেই ইউরোপীয় ইউনিয়নের বিভিন্ন দেশে উদ্বাস্তু হতে আগ্রহী তথা আশ্রয়প্রার্থী বাংলাদেশের নাগরিকরা।
বিশেষজ্ঞদের মতামত
অভিবাসন বিশেষজ্ঞ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সি আর আবরার বলেন, সারা বিশ্বে নানা ধরনের অস্থিরতা, বিভিন্ন দেশে মানবাধিকার লঙ্ঘন, জলবায়ু পরিবর্তনের ইমপ্যাক্ট, সাধারণ জীবনযাপনে চাপ সৃষ্টি, বিভিন্ন ধরনের ভীতির সৃষ্টি সবমিলিয়ে এমন ধরনের অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। ইইউভুক্ত দেশগুলো অপেক্ষাকৃত অন্য দেশগুলোর তুলনায় সম্পদশালী যে কারণে ওই দেশগুলোতে মানুষজন বেশি যেতে চায়।
আর বাংলাদেশের ক্ষেত্রে কেন সর্বোচ্চ পর্যায়ের লোকজন আশ্রয়ের আবেদন করেছে তা সরকার দেখবে। তবে স্বাভাবিকভাবে বাংলাদেশিদের ইউরোপে অভিবাসনের এই ইচ্ছা, ইউরোপে যাওয়ার এই তাগিদ- এটা নতুন কোনো বিষয় না। মানুষ জীবিকার কারণে বিভিন্ন সময়ে যেতে চায়। বিশেষ করে অন্য দেশগুলোতে যখন অ্যাভিনিউ বন্ধ হয়ে যায় তখন হয়তো চাপটা বাড়ে। এগুলো অনেকগুলো ফ্যাক্টরের ওপর নির্ভর করে। দালালচক্র যারা মানুষকে প্রভাবিত করে, সরকার তাদের ওপর কতখানি নজরদারি রাখতে পারছে এগুলো অনেকগুলো বিষয় আছে এর মধ্যে। একই সঙ্গে দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতাও আছে- এই কারণেও অনেকে যেতে চায়। আবার অনেকে এই রাজনৈতিক কারণকে ব্যবহার করে থাকে। বিভিন্ন ধরনের বাস্তবতার কারণেই লোকজন এমন আবেদন করে।
অভিবাসন বিশেষজ্ঞ আসিফ মুনীর বলেন, গত বছর ইইউভুক্ত দেশগুলোতে আশ্রয় আবেদনের ক্ষেত্রে রেকর্ড হওয়ার পেছনে দুই-তিনটি কারণ থাকতে পারে। একটা হচ্ছে কোভিড-১৯, পোস্ট কোভিড সময়ে যারা নরমালি লিগাল ওয়ে হোক বা অনিয়মিতভাবে হোক কোভিড সময়ে সব প্রক্রিয়াতেই অভিবাসন বন্ধ ছিল বা খুব কম হয়েছে।
আবার যাদের বাইরে যাওয়ার পরিকল্পনা থাকে তাদের হয়তো অর্থনৈতিক সংকট বেড়ে গেছে, আবার রেমিট্যান্স ফ্লো কমেনি, কিন্তু নতুন যারা যাবে তাদের যাওয়ার সুযোগটা গত ২ বছর বা তার বেশি কিছু সময় কম ছিল। যে কারণে বাইরে যাওয়ার ফ্লো বেড়েছে। আরেকটা হচ্ছে যারা অবৈধ অভিবাসনের নেটওয়ার্ককে চালু রাখে তারা আরও তৎপর হয়েছে, যা এরই মধ্যে একাধিক প্রতিবেদনে প্রকাশ পেয়েছে।
এ ছাড়া ইউক্রেন সংকটের কারণেও অনেকে এই সুযোগ নেওয়ার চেষ্টা করছে। আবার যারা যেতে চায় কোনো কারণে তাদের হাতে টাকার পরিমাণ বেশি হলে তারা অনেক সময়ে মরিয়া হয়ে যায়। তবে যতটুকু বুঝি এই ট্রেন্ড পড়ে যাবে, বাইরে যাওয়ার এই প্রবণতা বেশি দিন থাকবে না। ইউরোপের সব সরকার অভিবাসন-বান্ধব না।
সামগ্রিকভাবে ইইউ-ও পলিসিগতভাবে অভিবাসন বিষয়ে কঠোর হচ্ছে। ইউরোপের সরকারগুলো তাদের নিজেদের স্বার্থেই অভিবাসনের এই প্রক্রিয়া নিয়ন্ত্রণে আনবে।
অভিবাসীদের নিয়ে কাজ করে এ রকম একটি বেসরকারি সংস্থা বিএনএসকের নির্বাহী পরিচালক সুমাইয়া ইসলাম জানান, রাজনৈতিক অস্থিরতা তো একটা আছেই। যা একটা ব্যাকগ্রাউন্ড হিসেবে কাজ করছে। আরেকটা বিষয় হচ্ছে রাজনৈতিক আশ্রয়ের নাম করে অনেকেই দেশের বাইরে যাওয়ার সুযোগ খোঁজে। অনেক তরুণই অনেক মিথ্যা গল্প বানিয়ে বিভিন্ন দেশে রাজনৈতিক আশ্রয়ের আবেদন করে। জনসংখ্যাও বেড়েছে, এটা একটা কারণ। দেশে অনেকেরই কর্মসংস্থান নেই, যে কারণে অনেকেই বিদেশে যাওয়ার চিন্তা করে।
আরেকটা আমার নিজস্ব মতামত যে, রোহিঙ্গাদের অনেক দেশই আশ্রয় দিচ্ছে, সে ক্ষেত্রে অনেকেই রোহিঙ্গাদের মতো নাম ব্যবহার করে বা পরিচয় গোপন করে বিদেশ যাওয়ার সুযোগ নেওয়ার চেষ্টা করছে। আমরা আনঅফিসিয়ালি দেখেছি যে বিদেশে যাওয়ার জন্য অনেকেই এভাবে হুমড়ি খেয়ে পড়ছে। আর আমাদের দেশে কর্মসংস্থান সৃষ্টির সুযোগ কম থাকায় এমন ঘটনা বেশি ঘটছে।
আমরা ব্যবসা-বাণিজ্য বা উদ্যোক্তার কথা বলি, কিন্তু এসব করতে গেলে পদে পদে যে হেনস্থা হতে হয় তখন অটোমেটিক্যালি ছেলেমেয়েরা বিদেশ যাওয়ার কথা ভাবে। আসলে বাংলাদেশে যতটা না রাজনৈতিক কারণ তার থেকে বেশি হলো আর্থ-সামাজিক সংকট।
এসডব্লিউএসএস/১৪১০
আপনার মতামত জানানঃ