রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে চীন ফের তৎপরতা শুরু করেছে। এরই অংশ হিসাবে মঙ্গলবার চীনের কুনমিংয়ে বাংলাদেশ, চীন ও মিয়ানমারের মধ্যে ত্রিপক্ষীয় বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে।
বৈঠকে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে আলোচনা হয়েছে বলে জানা গেছে। এর আগে চীনের একজন বিশেষ দূত ঢাকা ঘুরে গেছেন। আবার পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেন বেইজিং সফরে গেছেন।
এসব সফরে বাংলাদেশের তরফে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন ইস্যু গুরুত্ব পাচ্ছে বলে সংশ্লিষ্টরা উল্লেখ করেছেন। এদিকে, পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. একে আব্দুল মোমেন মঙ্গলবার সাংবাদিকদের বলেছেন, চীনের সঙ্গে সাম্প্রতিক আলোচনায় তিনি রোহিঙ্গা ইস্যুতে গুরুত্ব দিয়েছেন। মন্ত্রী আশা করেন, রোহিঙ্গাদের অবশ্যই মিয়ানমার ফেরত নেবে।
সম্প্রতি চীনের বিশেষ দূতের সঙ্গে বৈঠক প্রসঙ্গে জানতে চাইলে মোমেন সাংবাদিকদের বলেন, ‘হ্যাঁ, (চীনের বিশেষ দূতের সঙ্গে) আমাদের সৌজন্য বৈঠক হয়েছে। অবশ্যই সেখানে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে আলোচনা হয়েছে। আমরা আশা করি, তারা মর্যাদার সঙ্গে তাদের দেশে ফিরে যাবে।’ পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনে সহায়তার জন্যে অনেকেই প্রস্তুত। আমি বলব, চীন খুব ভালো উদ্যোগ নিয়েছে। তারা এই লক্ষ্যে কাজ করছে।’
গোপনে বাংলাদেশ ও চীনের দুই কর্মকর্তার সফর বিনিময়
নির্যাতনের মুখে মিয়ানমার থেকে পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন বিষয়ে নতুন উদ্যোগ নিয়েছে চীন। মিয়ানমারের মিত্রদেশ বলে পরিচিত চীনের মাধ্যমে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া শুরু করতে প্রবলভাবে আগ্রহী বাংলাদেশও।
বুধবার বেনারকে পররাষ্ট্রমন্ত্রী একে আব্দুল মোমেন বলেন, ‘চীনের একজন দূত ঢাকা ঘুরে যাওয়ার পরে আমাদের একজন সচিব (পররাষ্ট্র সচিব) বেইজিং গেছেন। এই সফরগুলোর উদ্দেশ্য একটাই, সেটা হচ্ছে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন।”
তবে এই বিষয়ে শুরু থেকেই কঠোর গোপনীয়তা অবলম্বন করছে ঢাকা। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কোনো কর্মকর্তাই মুখ খুলছেন না চীনের উদ্যোগ প্রসঙ্গে।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন,“প্রত্যাবাসন ইস্যুটা আমাদের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। মিয়ানমারের সঙ্গে আমাদের সরাসরি কোনো ডায়ালগ হচ্ছে না, সেজন্য আমরা বিষয়টা নিয়ে খুবই সিরিয়াস, আমরা এর সমাধান চাই,”
পরিচয় গোপন রাখার শর্তে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দুই জন কর্মকর্তা বেনারকে নিশ্চিত করেছেন, চলতি মাসের শুরুর দিকে ঢাকা সফর করেছেন চীনের বিশেষ দূত দেং শিজুন। ওই কর্মকর্তারা বলেন, চীনা দূতের সফরের সময় জরুরি ভিত্তিতে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকের ব্যবস্থা করেছিল ঢাকায় চীনের দূতাবাস, দূতাবাসের অনুরোধেই বৈঠকের বিষয়টি গোপন রাখা হয়। তারা জানান, শিজুনের বৈঠকের পর ঢাকা থেকে অনেকটা গোপনেই বেইজিংয়ে পাঠানো হয় পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেনকে।
“পররাষ্ট্র সচিব এবং চীনা দূতের একই এজেন্ডা” উল্লেখ করে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বেনারকে বলেন, বাংলাদেশ আশা করে রোহিঙ্গারা “মর্যাদার সঙ্গে তাদের দেশে ফিরে যাবে। এ বিষয়ে চীন যে উদ্যোগ নিয়েছে তা প্রশংসাযোগ্য।”
রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের সুবিধার্থে অনেকেই কাজ করছেন জানিয়ে তিনি বলেন, এ বিষয়ে চীন খুব ভালো একটি উদ্যোগ নিয়েছে এবং তারা সেই অনুযায়ী কাজ করছে।
তবে প্রত্যাবাসন কবে শুরু হতে পারে এমন প্রশ্নের উত্তরে মন্ত্রী বলেন, “এটা শেষ না হওয়া পর্যন্ত বলা কঠিন। রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন শুরুর জন্য অতীতে দু’বার চেষ্টা করা হলেও সে প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে।”
চীনা দূতের ঢাকা সফরের সময় কেন কঠোর গোপনীয়তা পালন করতে হয়েছে এবং ওই বৈঠকের অফিসিয়াল এজেন্ডা কী ছিল তা জানতে চেয়ে ঢাকায় চীনের দূতাবাসে ই-মেইল পাঠিয়েও কোনো জবাব পায়নি বেনার।
এদিকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, ঢাকা সফরের আগে চীনের দূত মিয়ানমারে ঘুরে এসেছেন। সেখানে বিভিন্ন পক্ষের সঙ্গে বেশ কয়েকটি বৈঠক করেন তিনি। চীনের দূতের ঢাকা সফর ও বাংলাদেশের পররাষ্ট্র সচিবের বেইজিং সফরের ঘটনা এমন সময় ঘটলো যার কয়েক সপ্তাহ আগে মিয়ানমারের একটি প্রতিনিধি দল পরীক্ষামূলক প্রত্যাবাসনের অংশ হিসেবে বাংলাদেশে এসে প্রায় ৫০০ রোহিঙ্গা শরণার্থীর সাক্ষাৎকার নিয়েছে।
গত মাসে রাখাইনে রোহিঙ্গাদের জন্য বিভিন্ন অবকাঠামো নির্মাণের অগ্রগতি দেখতে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতসহ ১১টি দেশের কূটনীতিকদের রাখাইনে নিয়ে গিয়েছিল মিয়ানমার। শতাধিক রোহিঙ্গা শরণার্থীকে দেশে ফেরানোর এই চেষ্টা গত দুই বছর ধরে চলছে, যেখানে বাংলাদেশের কক্সবাজার ও ভাসানচরে ১১ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা বসবাস করছে।
বাংলাদেশের শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মোহাম্মদ মিজানুর রহমান বেনারকে জানিয়েছেন, মিয়ানমারের ওই প্রতিনিধি দল বাংলাদেশ থেকে যাওয়ার পর থেকে আর কোনো অগ্রগতি নেই।
এখন কেন চীন তৎপর?
এপ্রিল মাসের শুরুতে অনেকটা নীরবে ঢাকা সফর করে যান চীনের বিশেষ দূত দেং সি জুন। সেই সময় তিনি বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গেও বৈঠক করেন। চীনর বিশেষ দূত কেন ঢাকা এসেছিলেন সে বিষয়টি নিয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ের দিক থেকে আনুষ্ঠানিক কোন ব্রিফিং হয়নি। বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের খবরে জানা যায়, তার সফরের অন্যতম আলোচনার বিষয় ছিল রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন।
সে ধারাবাহিকতায় কুনমিংয়ে এই ত্রিপক্ষীয় বৈঠকটি অনুষ্ঠিত হচ্ছে। সেখানে অংশ নিয়েছেন বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা। চীনে বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত মুন্সী ফয়েজ আহমেদ বলছেন, এটা যে একেবারে হঠাৎ করে শুরু হয়েছে, সেটা বলা যাবে না। সব চেষ্টা বন্ধ করে চীন যে একেবারে সব চেষ্টা বন্ধ করে বসেছিল, তা নয়। মিয়ানমারের গৃহযুদ্ধ, করোনা- ইত্যাদি কারণে পিছিয়ে গিয়েছিল।
এর আগেও যে দুই-দফা রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে আলোচনা হয়েছে, সেখানেও ভূমিকা রেখেছিল চীন। বিশ্লেষকরা বলছেন, চীনের এই ভূমিকার পেছনে একটাই কারণ, জিও-পলিটিক্স বা ভূ-রাজনৈতিক।
মিয়ানমারের সঙ্গে বরাবরই চীনের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। অতীতে জাতিসংঘে মিয়ানমারের সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে যেসব প্রস্তাব আনা হয়েছিল, তাতে বরাবর ভেটো দিয়েছে চীন। কারণ চীন সবসময় চেয়েছে, মিয়ানমারে যেন চীনের বন্ধুভাবাপন্ন একটি সরকার ক্ষমতায় থাকে।
সাউথ এশিয়ান ইন্সটিটিউট অফ পলিসি অ্যান্ড গভর্নেন্স এর সিনিয়র রিসার্চ ফেলো ব্রিগেডিয়ার (অব) এম সাখাওয়াত হোসেন বলছেন, ‘মিয়ানমারের চীনের একটা ভূমিকা আছে, জাতিসংঘে সবসময় তারা মিয়ানমারের পাশে থেকেছে। তার ফলে চীনও বৈশ্বিকভাবে একটা প্রশ্নের মধ্যে পড়েছে। চীন এভাবে এগিয়ে আসার এটাই প্রধান কারণ।’
প্রতিবেশী দেশগুলোর মধ্যে মিয়ানমারে চীনের ব্যাপক অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক স্বার্থও রয়েছে। মিয়ানমারের আরাকান এলাকায়ও চীনের স্বার্থ রয়েছে। আরাকান অঞ্চলে দীর্ঘদিন যাবত অস্থিতিশীলতা চলছে।
এম সাখাওয়াত হোসেন বলছেন, ‘সেখানে যেভাবে সংঘাতময় পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, চীন চায় সেখানে যেন একটা স্থিতিশীল পরিবেশ থাকে।’
আন্তর্জাতিক বার্তা সংস্থা রয়টার্স জানিয়েছে, মিয়ানমারে সামরিক জান্তা ক্ষমতা নেবার পরবর্তী এক বছরে দেশটি ৩৮০ কোটি ডলারের বিদেশি বিনিয়োগ অনুমোদন করেছে। এর মধ্যে ২৫০ কোটি ডলার ব্যয় করে একটি তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস প্লান্ট করবে চীন।
চীনের বেল্ট এন্ড রোড ইনিশিয়েটিভের আওতায় রাখাইন রাজ্যের তেল ও গ্যাস ক্ষেত্র থেকে চীনের ইউনান প্রদেশে একটি জ্বালানি করিডোর স্থাপনের পরিকল্পনা আছে। মিয়ানমারের পক্ষে সবসময় চীনের অবস্থানের কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে এর আগে বিবিসি বাংলাকে একটি সাক্ষাৎকারে মালয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের চায়না স্টাডিজ ইন্সটিটিউটের গবেষক ড. সৈয়দ মাহমুদ আলী বলেছিলেন, চীনের ৮০ থেকে ৮৫ শতাংশ বাণিজ্য মালাক্কা প্রণালী দিয়ে হয়। কোন যুদ্ধাবস্থা তৈরি হলে যুক্তরাষ্ট্র বা তার আঞ্চলিক মিত্ররা ওই প্রণালী বন্ধ করে দিলে চীনের বাণিজ্য বন্ধ হয়ে যাবে।
এজন্য চীন মিয়ানমারের ভেতর দিয়ে স্থলপথে পাইপলাইনের মাধ্যমে তেল এবং গ্যাস সরবরাহের যে দুটি পাইপলাইন তৈরি করেছে, তা আরাকান হয়ে বঙ্গোপসাগরে পড়েছে। এই জন্য চীন কখনো চাইছে না যাতে, আরাকানের ওপর মিয়ানমার নিয়ন্ত্রণ হারায় বা সেখানে অস্থিরতা অব্যাহত থাকে। ফলে রোহিঙ্গা সংকট জোরালো হওয়ার পর থেকেই ভূমিকা রাখার চেষ্টা করেছে চীন।
এসডব্লিউ/এসএস/১৪৫০
আপনার মতামত জানানঃ