যে কোন ধর্মই ঈশ্বরের দ্বারা মানুষ সৃষ্টির কথা ফলাও করে প্রচার করে। বিবর্তনবাদ তত্ত্ব সেই ধারনায় পানি ঢেলে দেয়। এই যে কথাটা, ‘মানুষ এই পৃথিবীতে আর অন্যান্য প্রজাতির মতোই আর একটি প্রজাতি’, তা মানুষকে বোঝালো যে মানুষ অন্যান্য প্রাণীর মতই প্রাকৃতিক নিয়মে আবদ্ধ।
কিছু মানুষ ভাবল, এই বিবর্তনবাদ হয়তো মানবসমাজের মানবিকতা, নীতি-নৈতিকতা, বিচার-বিবেচনা এই সমস্ত কিছু অধঃপতনে নিয়ে যাবে নিয়ে যাবে। কারণ ধর্ম এতদিন আমাদের শিখিয়ে এসেছে যে, মহান ঈশ্বর এই ধর্মের মাধ্যমেই আমাদের মধ্যে নীতি-নৈতিকতা, বিচার বিবেচনা ভরে দিয়েছেন। ধর্ম ছাড়া তাই মানব সমাজ অচল।
কিন্তু বিবর্তন তত্ত্ব ধর্মের এই মূল ভিত্তিকে ভুল প্রমান করল। আর সেটা করে যেন ধর্মকেই এক রকম ভুল প্রমান করল।
নিজের প্রতিপত্তি প্রতিষ্ঠার জন্য মানুষ একসময় বলতো যে, ঈশ্বর তাকে বিশেষভাবে সৃষ্টি করেছেন। ঈশ্বর তার মধ্যে নীতি-নৈতিকতা দিয়েছেন, ভালো-মন্দের পার্থক্য বোঝার ক্ষমতা দিয়েছেন, বিচার-বুদ্ধি-বিবেচনা দিয়েছেন; যা এই পৃথিবীর আর অন্য কোন প্রাণীর মধ্যে তিনি দেননি।
কিন্তু ডারউইন তার বিবর্তনবাদ তত্ত্বের মধ্যে দিয়ে দেখালেন যে, মানুষ সেরকম বিশেষ কোনো প্রাণী নয়। এই পৃথিবীতে আর পাঁচটা প্রাণীর মতোই আরেকটি মানুষ প্রজাতি। আর মানুষ যদি বিশেষ একটি প্রজাতি ধরেই নিতে হয়, তাহলে সংজ্ঞা অনুযায়ী এই পৃথিবীতে যত পশু পাখি গাছপালা যত প্রকারের জীব আছে তাদের প্রত্যেকটি কিছু না কিছু স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যের অধিকারী। এবং সেই অনুযায়ী তারাও বিশেষ কিছু বলে গণ্য হয়ে ওঠার দাবী রাখে।
বিবর্তন তত্ত্ব মানুষকে সেই বাস্তবতা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে। যেখান থেকে স্পষ্ট বোঝা যায় যে, তারা সৃষ্টির সেরা জীব কখনোই নয়; তারা বিশেষভাবে তৈরি হয়নি। বিভিন্ন তথ্য প্রমান থেকে জানা যায়, মানুষের উদ্ভব এই এপ জাতীয় কিছু পশুদের মধ্যে থেকেই। যার ফলে ধর্মের সেই প্রাচীন ধারণা ভেঙে গুঁড়িয়ে নস্যাৎ হয়ে যাবার জোগাড় হয়।
সকল ধর্মের মধ্যে একটি সাধারণ বৈশিষ্ট্য হলো, যেকোনো ধর্মের ধর্মগ্রন্থ ঘাঁটলেই পাওয়া যাবে একটি চমৎকার বর্ণনা। আর সেই বর্ণনা হোল, মানুষ কিভাবে সৃষ্টি হল তার বিশদ বিবরন। সেখানে রীতিমত বড়াই করা হয় এই নিয়ে যে, মানুষকে ঈশ্বর কিভাবে বিশেষভাবে সৃষ্টি করলেন, কিভাবে সমস্ত কিছু বানানোর পরে রীতিমত সময় নিয়ে ঈশ্বর মানুষকে বিশেষভাবে গড়ে তুললেন; তার মধ্যে দিলেন বিদ্যা বুদ্ধি ইত্যাদি ইত্যাদি ইত্যাদি। সে এক বিশাল গল্প।
কিন্তু বিবর্তনবাদ সেই ধারণাকে ধুলোয় মিশিয়ে দিল। আর সেখানেই বাঁধল ধর্মের সাথে সংঘাত। ধর্ম নিজের গুরুত্ব বজায় রাখার জন্য সব সময় প্রচার করে এসেছে যে, মানুষের মধ্যে যে নীতি-নৈতিকতা ও মূল্যবোধ তা ঈশ্বর মানুষের মধ্যে প্রদান করেছেন ধর্মের মাধ্যমে। কারণ ঈশ্বর মানুষকে বিশেষভাবে সৃষ্টি করেছেন, মানুষ সৃষ্টির সেরা জীব। কিন্তু ডারউইন প্রথমেই এই ধারণার বিরুদ্ধে কথা বললেন।
“The Descent of Man” বইতে তিনি লিখলেন, …there is no fundamental difference between man and the higher mammals in their mental faculties.
প্রসঙ্গত, Jane Goodall ষাটের দশক বুনো শিম্পাঞ্জি নিয়ে গবেষণা শুরু করেন। উদ্দেশ্য ছিল মানুষের পূর্ব পুরুষদের আচার-আচরণ কেমন ছিল সেই বিষয়ে খানিক আলকপাত করা। তার লেখা বই “The Chimpanzees of Gombe: PATTERNS OF BEHAVIOR“-তে তিনি তার পরীক্ষালব্ধ ফলাফল ও পর্যবেক্ষণ উল্লেখ করেন।
মানুষের সাথে এই বুনো শিম্পাঞ্জিদের আচার-আচরণ এবং ব্যবহারের মধ্যে আশ্চর্যজনক সাদৃশ্য লক্ষ্য করেন তিনি। তিনি এতই আশ্চর্য হয়েছিলেন এই সাদৃশ্য দেখে যে জেন তাদের নাম ধরে ডাকতে শুরু করেন। আর তিনি অবাক বিষয় লক্ষ্য করেন এই বুনো শিম্পাঞ্জিরা তাদের দৈনন্দিন কাজের সুবিধার জন্য বিভিন্ন সরঞ্জাম ব্যবহার করতে পারে।
পরবর্তী গবেষণাগুলি থেকে আরও নতুন তথ্য উঠে আসে। বোঝা যায় মানুষের মতো শিম্পাঞ্জিদের ভাবাবেগ আছে। মানুষের মতো তারাও তাদের ভাবাবেগ এবং মনের অনুভূতি, মুখের অভিব্যক্তির মাধ্যমে ফুটিয়ে তুলতে পারে। হয়তো এই অভিব্যক্তি মানুষের কাছে খুব একটা পরিচিত নয়, কিন্তু বেশ কিছুদিন এই শিম্পাঞ্জিদেরকে খুব কাছ থেকে পর্যবেক্ষণ করলে এই অভিব্যক্তি শনাক্ত করা কঠিন নয়। মানুষের মতোই শিম্পাঞ্জিরাও একে অপরের অভিব্যক্তি খুব সহজেই বুঝতে পারে এবং তারা এই বিষয়ে খুবই পারদর্শী।
মোরালিটি বলতে আমরা যদি নিরপেক্ষতা, ন্যায় পরায়ণতা, স্বার্থপর হীনতা এবং সহানুভূতি বুঝি,তাহলে এই বৈশিষ্ট্যগুলি শুধু মানুষের মধ্যে নয়, শিম্পাঞ্জিদের মধ্যেও দেখা যায়।
শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে মানুষ এটাই মনে করে এসেছে নীতি-নৈতিকতা, সহানুভূতি, বিবেচনা বুদ্ধি শুধুমাত্র মানুষেরই বৈশিষ্ট্য এবং তা এক এমন স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য যা মানুষকে পশুদের থেকে আলাদা করে। আর এই ধারণাই ‘হিউম্যানিটি’ বলতে আমরা যা বুঝি সেই ধারণার এক গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ হয়ে দাঁড়িয়েছিল।
মানব শিশুর ক্ষেত্রে দেখা যায়, তাদের মধ্যে খুব ছোট বয়স থেকেই নিরপেক্ষতা, সততা ও সুবিচারের বোধ থাকে। তারা খুব ছোট বয়স থেকেই সহমর্মী, পরহিতৈষী এবং পরোপকারী। অনেক সময় তারা অপরকে সাহায্য করে, কোন লাভের আশা ছাড়াই। এর জন্য তাদের কোনো ধর্মীয় শিক্ষা দিতে হয়না।
তবে এই স্বভাব নিরপেক্ষতা, সততা ও ন্যায্যতার বোধ অন্যান্য প্রাণী মধ্যেও দেখা যায়। কতগুলি বাঁদরকে নিয়ে করা একটি গবেষণায় দেখা যায়, একই কাজের জন্য যখন তারা সমান পুরস্কার পায়, তখন সবকটি বাঁদর খুশি থাকে। কিন্তু একজনকে কোন ভালো কিছু বা বেশি কিছু দিলে, তখন অন্যরা আর আগের মত সেই পুরস্কারটি গ্রহণ করতে চায় না।
তার মানে বোঝা গেল শিম্পাঞ্জিরা নিজের ভালোটা বোঝে। কিন্তু শুধু কি তাই? তারা কি শুধুই স্বার্থপর? ২০১৩ সালে প্রকাশিত আরেকটি স্টাডিতে দেখা গেল তারা একে অপরের প্রতি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়। যদি কোন শিম্পাঞ্জি দেখে তাদের গোষ্ঠীর কোন সদস্যের খাবারের অভাব আছে, তাহলে তারা নিজেদের খাবার ভাগ করে নেয়। তাদের এই আচরণ ঠিক মানুষেরই মত।
২০০৬ সালে প্রকাশিত আরেকটি গবেষণায় দেখা গেল, ঠিক মানব শিশুর মতো শিম্পাঞ্জিরাও একে অপরকে সাহায্য করে এবং এটি তাদের একটি সহজাত প্রবৃত্তি। অন্য একটি গবেষণায় দেখা গেল শিম্পাঞ্জিরা তাদের গোষ্ঠীর কোন এক সদস্যকে একটি দরজা খুলে খাবারের কাছে পৌঁছাতে সাহায্য করে এবং সেই কাজ করতে গিয়ে তারা কোন রকম লাভ-ক্ষতির তোয়াক্কা করে না। কিছু গবেষণায় দেখা গেল শুধুমাত্র শিম্পাঞ্জি নয়, ইঁদুরের মধ্যেও গোষ্ঠীর অন্য সদস্যের প্রতি একই রকম সহানুভূতি এবং সহমর্মিতা প্রকাশ পায়।
আমরা সেইভাবে পর্যবেক্ষণ করি না বটে, কিন্তু বিভিন্ন গবেষণা থেকে এই ধারণা পাওয়া যায় যে শিম্পাঞ্জিদের মধ্যেও সভ্যতা-সংস্কৃতির অস্তিত্ব আছে এবং তার বহু উদাহরণ বিভিন্ন গবেষণার মাধ্যমে আমাদের সামনে এসেছে। বিভিন্ন অঞ্চলের শিম্পাঞ্জিদের মধ্যে রীতিনীতি, আচার আচরনের প্রভেদ লক্ষ্য করা যায়।
গোষ্ঠীভেদে শিম্পাঞ্জিদের মধ্যে বিভিন্ন ধরনের ব্যবহার দেখা যায়, তারা বিভিন্ন ধরনের হাতিয়ার ব্যবহার করে, তাদের প্রেম নিবেদনের কায়দায় আলাদা, তাদের রীতিনীতি আলাদা। অন্যান্য প্রাণীদের মধ্যে সভ্যতা-সংস্কৃতির উদাহরন দেখা গেলেও, শিম্পাঞ্জিদের মধ্যে গোষ্ঠী ভেদে সংস্কৃতির এই যে ভিন্নতা তা কেবল মানব সমাজেই লক্ষ্য করা যায়।
একটি গবেষণায় দেখা গেল শিম্পাঞ্জিদের মধ্যে আপেল শব্দটি বোঝানোর ক্ষেত্রেও ভিন্নতা আছে, ঠিক যেমন ভিন্নতা আছে বিভিন্ন প্রান্তের মানুষের ভাষায়।
তাহলে দেখা গেল শুধু মানুষই না, বিভিন্ন মনুষ্যেতর প্রাণীও একটি জটিল সামাজিক গঠনের মধ্যে বাস করে, যেখানে তারা একে অপরের সাহায্যে উপরে নির্ভর করে। মানুষ এতদিন মনে করত তাদের মধ্যে যে বিচার-বিবেচনা, নীতি-নৈতিকতা, বিচার, বুদ্ধি-বিবেচনার জ্ঞান আছে তা এক স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য, এবং সেই বৈশিষ্ট্যই মানুষকে পশু থেকে আলাদা করেছে। অথচ এই বৈশিষ্ট্যগুলো আদতে স্বতন্ত্র নয়।
এসডব্লিউএসএস/১৫১০
আপনার মতামত জানানঃ