গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ও ট্রাস্টি ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী মারা গেছেন। ধানমন্ডির গণস্বাস্থ্য নগর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় গতকাল মঙ্গলবার রাতে তিনি মারা যান।
ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী প্রায় অকেজো ২টি কিডনি নিয়ে বেঁচে ছিলেন। কোভিডে লিভারের ক্ষতি হয়েছিল। বর্তমানে তার রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা নেমে এসেছিল প্রায় শূন্যে। কোনো ওষুধই কাজ করছিল না। সপ্তাহে ৩ দিন ডায়ালাইসিস করতে হতো। মাঝেমধ্যেই অনিয়ম করতেন। অন্য কোনো কর্মসূচি থাকলে, শরীর একটু ভালো থাকলে সেদিন ডায়ালাইসিস করতেন না।
তাকে আর কোনো সভায় বা মানববন্ধনের ব্যানারের পেছনে কিংবা মিছিলের সামনে হুইল চেয়ারে দেখা যাবে না। কিংবা দেখা যাবে না কোনো টেলিভিশন টক শো তে।
তিনি নিজের গড়ে তোলা হাসপাতালেই, নিজেদের গড়ে তোলা চিকিৎসক ও কর্মীদের সেবা নিয়ে গেছেন। তিনি মানুষের জন্য স্বাস্থ্য সেবা দেবেন বলে ঢাকা শহরে একটি হাসপাতাল গড়ে তুলেছিলেন; বেসরকারি হাসপাতালের তালিকায় নাম লেখাবার জন্যে নয়, ঢাকা শহরের গরিব মানুষদের দারিদ্রের বিভিন্ন ক্যটেগরি অনুযায়ী স্বল্প মূল্যে চিকিৎসা সেবা দেবার জন্যে। এ কারণে তিনি নিজের হাতে স্বাস্থ্য কর্মী গড়ে তুলেছেন সাধারণ গরিব ঘরের ছেলে মেয়েদের প্রশিক্ষণ দিয়ে। সব ধরনের কাজ তাদের শেখানো হয়েছে, ল্যাব থেকে শুরু করে আইসিইউ পর্যন্ত। এখানে যারা চিকিৎসা সেবা নিতে আসেন তাদের পক্ষে অন্যকোনো বেসরকারি হাসপাতালের চিকিৎসা খরচ মেটানো সম্ভব নয়।
আমরা জানি, বাংলাদেশে চিকিৎসার জন্যে সরকারি হাসপাতালেও ৬৮.৫% চিকিৎসা খরচ রোগীকেই বহন করতে হয়। ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী এই কথা মাথায় রেখে চিকিৎসা সেবাকে গরিব মানুষের কাছে সহজলভ্য করার প্রাণপণ চেষ্টা করেছিলেন। তাঁর হাসপাতাল যেমন আছে, তেমনি আছে ফার্মাসিউটিক্যালস। অর্থাৎ, ওষুধও কম দামে পাওয়ার ব্যবস্থা তিনি করেছেন।
ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী দীর্ঘদিন ধরে কিডনি জটিলতায় ভুগছিলেন। করোনার পর কিডনি সমস্যার পাশাপাশি তার লিভারের সমস্যাও দেখা দেয়। এ ছাড়া, তিনি অপুষ্টিসহ গুরুতর সেপটিসেমিয়ায় আক্রান্ত ছিলেন। ২০১৭ সালে যখন তিনি ঢাকায় নগর হাসপাতালে ১০০ বেডের গণস্বাস্থ্য ডায়ালাইসিস সেন্টার স্থাপন করলেন, তখনই জানা তাঁর কিডনি রোগ আছে।
তিনি উদ্ভোধনী ভাষণ দেওয়ার সময় কেন এই ডায়ালাইসিস সেন্টার করেছেন তার একটি গল্প বললেন। কিডনি রোগের জন্যে তাঁর ডায়ালাইসিস নেওয়ার প্রয়োজন হলো, তাই তিনি একটি বেসরকারি হাসপাতালে গিয়ে নিয়মিত সেবা নিতেন। তখন আশেপাশে যেসব রোগীদের দেখতেন তাদের অবস্থা জানতে চাইতেন। একবার তিনি লক্ষ্য করলেন, কম বয়সী একটি ছেলে আর নিয়মিত ডায়ালাইসিস নিতে আসে না। কারণ হিসেবে জানলেন সে এই ডায়ালাইসিসের ব্যয় বহন করতে পারছে না। গল্পটি বলতে গিয়ে ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী নিজে যেমন কাঁদলেন, তেমনি উপস্থিত সবাইকে কাঁদালেন। তখনই তিনি ঠিক করে ফেলেছিলেন যেমন করে হোক ডায়ালাইসিস সেন্টার করতে হবে। যেখানে কারো টাকার অভাবে যেন ডায়ালাইসিস সেবা বন্ধ করতে না হয়। তিনি এই ডায়ালাইসিস সেন্টার করার জন্যে অর্থের যোগান, মেশিন পত্র কেনা ইত্যাদির জন্যে প্রচুর পরিশ্রম করেছেন। এবং সফলও হয়েছেন। হাজার হাজার মানুষ সেবা নিচ্ছে।
মহান মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য অবদান রাখেন ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী। মুক্তিযুদ্ধে যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য গড়ে তোলা ‘বাংলাদেশ ফিল্ড হাসপাতাল’ এর অন্যতম উদ্যোক্তা ছিলেন তিনি। ‘বাংলাদেশ ফিল্ড হাসপাতাল’ পরিবর্তিতে ১৯৭২ সালে ‘গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র’ নামে যাত্রা শুরু করে।
তার দীর্ঘদিনের প্রচেষ্টার পর ১৯৮২ সালে সরকার ওষুধ নীতি প্রণয়ন করে। দেশীয় ওষুধ শিল্পের বর্তমান যে বিকাশ, সেটি ওই বৈপ্লবিক ওষুধ নীতিরই সুফল।
ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী ১৯৭৭ সালে স্বাধীনতা পুরস্কার পান। ১৯৮৫ সালে ফিলিপাইনের র্যামন ম্যাগসাইসাই পুরস্কার এবং ১৯৯২ সালে তাকে সুইডেন থেকে রাইট লাইভলিহুড অ্যাওয়ার্ড দেওয়া হয়। তিনি ২০০৯ সালে কানাডার ওয়ার্ল্ড অর্গানাইজেশন অব ন্যাচারাল মেডিসিন থেকে ডক্টর অব হিউম্যানিটেরিয়ান উপাধি পান। ২০১০ সালে যুক্তরাষ্ট্রের বার্কলি থেকে তাকে দেওয়া হয় ইন্টারন্যাশনাল পাবলিক হেলথ হিরো অ্যাওয়ার্ড।
বীর মুক্তিযোদ্ধা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী চট্টগ্রাম জেলার রাউজানে ১৯৪১ সালের ২৭ ডিসেম্বর জন্মগ্রহণ করেন। পিতামাতার ১০ ছেলেমেয়ের মধ্যে তিনি সবার বড়। তিনি ঢাকার বকশীবাজারের নবকুমার স্কুল থেকে মেট্রিকুলেশন এবং ঢাকা কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাস করেন।
তার জীবন বর্ণাঢ্য, বৈচিত্র্যময়, কিছুটা বিচিত্রও বটে। ১৯৬৪ সালে ঢাকা মেডিকেল থেকে এমবিবিএস পাস করে এফআরসিএস পড়তে গিয়েছিলেন লন্ডনে। তখন তার জীবনযাপন ছিল রাজকীয়। প্রাইভেট জেট চালানোর লাইসেন্স ছিল; দামি স্যুট, টাই, শার্ট, জুতা পরতেন। ৪ বছরের এফআরসিএস কোর্স শেষের দিকে। প্রাইমারি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছেন, সপ্তাহখানেক পরেই ফাইনাল পরীক্ষা। এরই মধ্যে শুরু হয়ে গেল বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ।
একজন সাধারণ চিন্তার মানুষ তখন কী করবেন? পরীক্ষা দেবেন, না মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কাজ করতে নেমে যাবেন? উত্তর হওয়ার কথা, পরীক্ষা দেবেন। তবে আমরা যাকে নিয়ে কথা বলছি, তিনি সাধারণ চিন্তার মানুষ ছিলেন না। তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন, পরীক্ষা দেবেন না। লন্ডনে বাংলাদেশের পক্ষে জনমত গঠনে নেমে পড়লেন। এমনই মানুষ ছিলেন ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী।
মূলত ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী বাংলাদেশের নায়ক, আইকন। সারাটা জীবন কাটিয়ে গেলেন কাউকে তোয়াক্কা না করে। জীবনকে ব্যয় করে গেলেন দেশের গরিব মানুষের জন্য। সৎ, নির্লোভ, নির্ভিক ৮১ বছরের চির তরুণ যাপন করে গেলেন সার্থক ও পরিপূর্ণ এক জীবন। অনুকরণীয়, অনুসরণীয় মানুষটির জীবনের কাহিনি মিথকেও হার মানায়।
এসডব্লিউ/এসএস/১৫৩৫
আপনার মতামত জানানঃ