সম্রাট অশোক ছিলেন মৌর্য্য সাম্রাজ্যের তৃতীয় শাসক, খ্রিষ্টপূর্ব ২৬৮ থেকে ২৩২ সাল পর্যন্ত ছিল তার শাসনকাল। ভারত উপমহাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় সাম্রাজ্য ছিল অশোকের। ধারণা করা হয়, এত বড় সাম্রাজ্যের অধিকারী আর কোনো সম্রাট ছিলেন না সে আমলে। তার জন্ম হয় খ্রিষ্টপূর্ব ৩০৪ সালে। ৩৬ বছর বয়সে খ্রিস্টপূর্ব ২৬৮ সালে ক্ষমতা গ্রহণ করে মৃত্যু পর্যন্ত সাম্রাজ্য পরিচালনা করেছিলেন সম্রাট অশোক।
তিনি ছিলেন ইতিহাসের এক আদর্শ শাসক। যদিও তার জীবনের প্রথম পর্যায়টি সম্পূর্ণ উল্টো কথা বলে। সে পর্যায়ে তার নৃশংসতা ছিল উদাহরণ দেওয়ার মতো। ইতিহাস স্বাক্ষী, তার জীবনের দ্বিতীয় পর্যায়ের কাজগুলোও মহত্ত্বের উদাহরণ দেওয়ার মতোই। মৌর্য সাম্রাজ্যের উদ্ভাসিত সূর্য ধীরে ধীরে স্তিমিত হতে থাকে সম্রাট অশোকের মৃত্যুর পরেই।
রাজত্বের প্রথম আট বছর, অশোকের নৃশংসতার দরুন তার প্রচলিত নাম ছিল চন্ডাশোক, যার অর্থ হলো ‘নৃশংস অশোক’। কলিঙ্গের যুদ্ধের পর, সহনশীল মনোভাব নিয়ে অশোক যখন রাজ্য পরিচালনা শুরু করেন, তার নাম তখন চন্দাশোক থেকে পাল্টে প্রচলিত হয় ধর্মাশোক,যার অর্থ হলো ‘ধার্মিক অশোক’।
মৌর্য্য সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য্য। ইতিহাসে তিনিই প্রথম ব্যক্তি, যিনি ভারত উপমহাদেশের সর্ববৃহৎ অংশকে একক রাজ্যের অধীনে নিয়ে আসেন। তামিল ও কলিঙ্গ ব্যতীত উপমহাদেশের প্রায় পুরোটাই দখলে নিয়ে নেন চন্দ্রগুপ্ত।
আর তার পৌত্র হলেন সম্রাট অশোক; ক্ষমতায় এসে অশোক সেই তামিল আর কলিঙ্গকেও সাম্রাজ্যের বাইরে থাকতে দেননি। ইতিহাস বিখ্যাত কলিঙ্গের যুদ্ধের কথা আমরা জানি, অশোক অসম্ভব নিষ্ঠুরতার সাথে এই যুদ্ধে জয়ী হন। ইতিহাসের মোড় ঘুরিয়ে দেওয়া একটি যুদ্ধ ছিল এটি।
ইতিহাসবিদদের মতে, সম্রাট অশোক সিংহাসনে আরোহণ করেই তার পিতামহ চন্দ্রগুপ্তের মতোই নৃশংস পথ অবলম্বন করতে শুরু করেন। তার রাজ্য চালনা নীতিগুলো ছিল প্রচণ্ড নিষ্ঠুরতায় পূর্ণ, তবে জনগণকে নিজের হাতের পুতুল বানিয়ে রাখতে সেগুলো কার্যকরী ছিল বেশ। সূক্ষ্ম রণকৌশল দ্বারা অশোক তার সৈন্যবাহিনীর সর্বোচ্চ ব্যবহার করে ভারত উপমহাদেশের প্রায় পুরোটাই তো দখল করে নিয়েছিলেন!
চৈনিক পরিব্রাজক হিউয়েন সাং ভারত উপমহাদেশে এসেছিলেন খ্রিস্টীয় সপ্তম শতকে। তিনি জানান, অশোকের রাজত্বের প্রায় নয়শ বছর পরও উপমহাদেশের মানুষ অশোকের জেলখানার নৃশংসতার কথা মনে রেখেছিল। রাজধানীর উত্তরে নির্মিত সেই জেলখানা পরিচিত ছিল ‘অশোকের নরক’ নামে।
সম্রাট অশোকের আদেশ ছিল এমন, “জেলখানার কয়েদীদের যেন কাল্পনিক ও অকল্পনীয় সব রকমের অত্যাচারের মধ্য দিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। কোনো বন্দী যাতে জীবিত বের হতে না পারে সেই নরক থেকে!”
অশোকের আপন ছোট ভাই ছিল শুধু একজন, বাকিরা সবাই সৎ ভাই। অশোক যখন সেনাপ্রধান হিসেবে একের পর এক বিজয় লাভ করছিলেন, তখন সুশিমা নামের তার এক সৎ ভাইয়ের মনে সংশয় তৈরি হয় যে, এভাবে চলতে থাকলে সিংহাসনে অশোকই বসবেন শেষপর্যন্ত। সেসময় সুশিমার সিংহাসনে আরোহণের সম্ভাবনা ছিল বেশি, কেননা বিন্দুসারার প্রিয় পুত্র ছিল সে। বিন্দুসারা সবসময় চাইতেন, তার বড় ছেলে সুশিমাই সিংহাসনে বসুক।
তক্ষশীলা নামক এক জায়গায় বিদ্রোহের সৃষ্টি হলে সুশিমা তার বাবা বিন্দুসারার কাছে প্রস্তাব রাখেন যে, এই বিদ্রোহ দমন করা কেবল অশোকের পক্ষেই সম্ভব। অশোক এই বিদ্রোহ সহজে দমন করতে পারবেন না, এমনটাই ভেবেছিলেন সুশিমা। এদিকে বিন্দুসারার সুশিমার কথামতো অশোককেই দায়িত্ব দিলেন বিদ্রোহ দমনের। সে লক্ষ্যে অশোক যুদ্ধযাত্রা করলেন।
সিংহাসনে বসার আগে থেকেই অশোকের নৃশংসতার এমনই ‘সুনাম’ ছিল যে, তার যুদ্ধযাত্রার খবরটা তক্ষশীলায় পৌঁছানো মাত্রই বিদ্রোহীরা স্বউদ্যোগে থেমে গেল। এত সহজে অশোক বিদ্রোহ দমন করে ফেলবেন, এটা কল্পনাতেও ছিল না সুশিমার। তখন তিনি বিন্দুসারাকে রাজি করান যাতে অশোককে কলিঙ্গ রাজ্যে নির্বাসনে পাঠানো হয়। সুশিমা জানতেন, কলিঙ্গ রাজ্য তখন প্রচণ্ড প্রতাপশালী, সেখানে অশোক কিছুই করতে পারবেন না।
কলিঙ্গ রাজ্যে নির্বাসনে থাকাকালীন সেখানকার রাজকুমারী কৌরভাকীর সাথে প্রণয়ে জড়িয়ে পড়েন অশোক। তবে দুজনের কেউই একে অপরের পরিচয় জানতেন না। পরবর্তী সময়ে অশোকের সাথে কৌরভাকীর বিয়েও হয়েছিল। নির্বাসনের মেয়াদ শেষ হয়ে আসে। এদিকে উজাইন নগরীতে বিদ্রোহ দেখা দিলে, বিন্দুসারা লোক মারফৎ অশোককে ডেকে নেন। এবারে উজাইন নগরীতে বিদ্রোহ দমনের উদ্দেশ্যে প্রেরণ করা হয় অশোককে। দুর্দান্ত এক সংঘর্ষে সেবারে অশোক আহত হন।
এরপর অনেকদিন সময় লেগেছিল অশোকের সুস্থ হতে। আর তার চিকিৎসা করেছিলেন বৌদ্ধ সন্ন্যাসীরা। সেসময়েই অশোক প্রথম বৌদ্ধধর্মের নীতিশাস্ত্রের ব্যাপারে জানার সুযোগ পান। দেবী নামের এক মেয়ে সেখানে তার সেবা করতেন, পরবর্তীতে অশোক বিয়ে করেন তাকে।
উজাইন যুদ্ধের প্রায় বছরখানেক পর বিন্দুসারা ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়েন। সেই যাত্রায় যে আর তার জীবন রক্ষা হবে না, এটা বুঝে গিয়েছিল সবাই। আর তখনই বিন্দুসারার ছেলেদের মধ্যে দ্বন্দ্ব শুরু হয়ে যায় সিংহাসনে কে বসবে তা নিয়ে। ইতিহাস বড়ই নির্মম, একের পর এক দ্বন্দ্বযুদ্ধের মধ্য দিয়ে অশোক হত্যা করেন তার ভাইদের। খ্রিষ্টপূর্ব ২৬৮ সালে অশোক সম্রাট হলেন। রাজত্বের প্রথম আট বছরে মানুষের কাছে নিজেকে নৃশংসতার আদর্শ হিসেবে গড়ে তুললেন তিনি। ক্ষ্যাপা হায়েনার মতো মৌর্য সাম্রাজ্য বাড়াতে থাকলেন অশোক।
বৌদ্ধধর্মের কিছু গ্রন্থ হতে জানা যায় যে, অশোক সিংহাসনে বসার জন্য তার ৯৯ জন ভাইকে হত্যা করেছিলেন! ক্ষমতা গ্রহণের প্রথম আট বছর তিনি একের পর এক যুদ্ধযাত্রা করেন, কোনো যুদ্ধেই তাকে কেউ হারাতে পারেনি। অশোক তার রাজ্যকে বর্ধিত করে পুরো ভারতীয় উপমহাদেশ বিজয় করে নেন, এমনকি পশ্চিমে বর্তমান ইরান ও আফগানিস্তান আর পূর্বে বাংলাদেশ ও বার্মাও চলে আসে অশোকের দখলে।
অশোক সিংহাসনে আসীন হওয়ার প্রায় আট বছর পর খ্রিষ্টপূর্বাব্দ ২৬১তে আসে ইতিহাসের মোড় ঘুরিয়ে দেয়া সেই যুদ্ধ, কলিঙ্গের যুদ্ধ। এই হলো সেই কলিঙ্গ সাম্রাজ্য, যা চন্দ্রগুপ্তও জয় করতে পারেননি। কিন্তু তার পৌত্র অশোক, নৃশংসতার চরমে আরোহণ করে কলিঙ্গকে ঠিকই জয় করে নিয়েছিলেন।
ইতিহাসই সাক্ষ্য দেয়, বিশ্ব ইতিহাসের অন্যতম নৃশংস ও রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ ছিল সেই কলিঙ্গের যুদ্ধ। কলিঙ্গ সাম্রাজ্য নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য পুরো শক্তি প্রয়োগ করেও হেরে যায় অশোকের নৃশংসতার কাছে।
কলিঙ্গ জয় শেষে অশোক ঠিক করেন, রাজ্যটির ক্ষয়ক্ষতি দেখতে যাবেন। যে রাজ্যে তাকে নির্বাসিত করা হয়েছিল, সে রাজ্যকে যেন আর খুঁজে পেলেন না অশোক; পুরো কলিঙ্গ যেন ধূলোর সাথে মিশে গেছে। ঘর-বাড়ি সব পুড়ে ছারখার, পুরো ময়দান জুড়ে শুধু মৃতদেহ, লাশের কারণে পা ফেলা যাচ্ছে না। বলা হয় যে, অশোক প্রথমবারের মতো যুদ্ধ পরবর্তী সময়ের ক্ষয়ক্ষতি সরাসরি নিজ চোখে দেখেছিলেন সেবার।
কথিত আছে যে, অশোক এই রক্তে ভেজা ভূমি দেখে আপন মনে উচ্চারণ করে উঠেন, “এ আমি কী করলাম?” তিনি তার বাকি জীবনে কলিঙ্গ রাজ্যের সেদিনকার দৃশ্যগুলো ভুলতে পারেননি।
মৌর্য্য সাম্রাজ্যের ইতিহাস আজকে আমরা অন্যভাবে পড়তাম, যদি না কলিঙ্গের যুদ্ধ সংঘটিত হতো। এ যুদ্ধে বিজয়প্রাপ্তির পর, অশোক নিজের নৃশংসতায় নিজেই যেন ভড়কে যান। এত দিন পর তার নজর পড়ে নিজের নৃশংস শাসন ব্যবস্থার প্রতি। পূর্বের কৃতকর্মগুলোর জন্য অনুতপ্ত হন তিনি। প্রায়শ্চিত্ত করার উদ্দেশ্যে তার সাম্রাজ্যে নতুন বিচারব্যবস্থা প্রবর্তন করেন অশোক। রাতারাতি শাসনব্যবস্থা সম্পূর্ণ উল্টে ফেললেন তিনি।
অশোকের স্ত্রী দেবী ছিলেন বৌদ্ধধর্মে বিশ্বাসী, দেবীর কাছ থেকে অশোক বৌদ্ধধর্মের অনেক কিছুই জানতে পেরেছিলেন। অশোকের মন তখন বারবার বৌদ্ধধর্মের সহনশীলতার কথাগুলো আওড়াতে শুরু করে। কলিঙ্গ যুদ্ধের ভয়াবহতা অনুধাবনের পর অশোক সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, তিনি বৌদ্ধধর্মে বিশ্বাস আনবেন। আর তিনি যতদিন বাঁচবেন, তার রাজ্য পরিচালিত হবে বৌদ্ধনীতির উপর ভিত্তি করে।
কলিঙ্গ যুদ্ধের আগের আট বছরে অশোক যা যা অন্যায় করেছিলেন, সবকিছু যেন উল্টো দিক থেকে আবার শুরু করলেন তিনি। সকল বন্দীকে মুক্তি দেয়া হলো তার হুকুমে, তাদের সম্পত্তিও ফিরিয়ে দেয়া হলো যথাযথরূপে।
এসডব্লিউএসএস/১৮০০
আপনার মতামত জানানঃ