হাতির শারীরিক বৈশিষ্ট্যের অন্যতম হলো বড় বড় দুই দাঁত। গাছ উৎপাটন থেকে শুরু করে ভারী কাণ্ড বহন, বাকল তোলা, লড়াই ও গর্ত খুঁড়তে সাহায্য করে এটি।
তবে পূর্ব আফ্রিকার দেশ মোজাম্বিকের গোরংগোছা জাতীয় উদ্যানে দাঁত ছাড়াই স্ত্রী হাতির হার বাড়ছে। বিজ্ঞানীরা বলছেন, এটা প্রকৃতির জবাব। দেশটির গৃহযুদ্ধের সময়টাতে দাঁতের জন্য নিষ্ঠুরভাবে বহু হাতি মারা হয়। সেটার প্রভাব পড়েছে বিবর্তনপ্রক্রিয়ায়।
সিএনএনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ১৯৯২ সালে যুদ্ধ থামলে ব্যাপারটি নজরে আসতে শুরু করে জাতীয় উদ্যানে কর্মরত হাতি বিশেষজ্ঞদের। পুরোনো ভিডিও ফুটেজ বিশ্লেষণ এবং নানা সূত্রের তথ্য বলছে, ১৯৭২ থেকে ২০০০ সালের মধ্যে দাঁতহীন স্ত্রী প্রজাতির হাতির পরিমাণ তিন গুণ বেড়েছে।
যুদ্ধ শেষের পর দেখা যাচ্ছে, যে দাঁতহীন হস্তিনী টিকে রয়েছে, তাদের গুণ পেয়েছে পরের প্রজন্ম। আর ফল হয়েছে অভাবনীয়। নয়া প্রজন্মের অর্ধেকের বেশি মহিলা শাবকের দাঁত দেখা যাচ্ছে না। মানুষের যেমন চোখের রঙ, তেমনই হাতির দাঁত নির্ভর করছে জিনের ওপর। আফ্রিকার হাতিদের মধ্যে দাঁত না থাকাটা বেশ দুর্লভ ঘটনা ছিল।
আরও চমকে দেওয়ার মতো একটা তথ্য পাওয়া গিয়েছে। আর তা হল তাদের শাবকের এক তৃতীয়াংশ মেয়ে।
যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব আইডাহোর বন্য প্রাণিবিজ্ঞানের সহযোগী অধ্যাপক রায়ান লং বলেছেন, এই সময়ে উদ্যানে হাতির সংখ্যা দুই হাজার থেকে আড়াই শয়ে নেমে এসেছিল।
সিএনএনকে লং বলেন, যুদ্ধের সময় সংঘাতের কেন্দ্রে ছিল গোরংগোছা। ফলে এলাকাটিতে অনেক সৈনিক ছিল, অনেক উদ্দেশ্যে হাতি শিকার শুরু হয়। যেমন দাঁত বিক্রির অর্থে আগ্নেয়াস্ত্র কিনত তারা। সে সময় হাতি শিকারের পরিমাণও ছিল খুব বেশি।
বিজ্ঞানীরা এই দাঁতহীন হওয়ার প্রক্রিয়ার জেনেটিক ভিত্তি বুঝতে শুরু করেছেন, বিশেষ করে কেন তার প্রভাব কেবল স্ত্রী হাতির মধ্যে দেখা যাচ্ছে। গবেষণাপত্রটি তাঁরা প্রকাশ করেছেন সায়েন্স জার্নালে।
বিশ্লেষণে দেখা যায়, ১৯৭২ সাল থেকে পরবর্তী ২৮ বছরে দন্তহীন স্ত্রী প্রজাতির হাতির টিকে থাকার সম্ভাবনা দন্তযুক্ত স্ত্রী হাতির চেয়ে পাঁচ গুণ ছিল। ফলে নতুন এই ধারা কেবল কাকতাল হতে পারে না।
বন্য প্রাণী শিকার বা পোচিং ছাড়াও প্রাকৃতিকভাবেই দন্তহীন হওয়ার প্রক্রিয়া চলতে পারে, সেটাও কেবল স্ত্রী প্রজাতির মধ্যে। তবে সে হার খুব কম। গোরংগোছায় উনিশ শতকের সত্তরের দশকে ১৮ দশমিক ৫ শতাংশ স্ত্রী হাতির দাঁত ছিল না। তিন দশক পর পরিমাণটা বেড়ে দাঁড়ায় ৫১ শতাংশে।
গবেষণাপত্রের লেখক রায়ান লং বলেন, নির্দিষ্ট প্রজাতির পরবর্তী প্রজন্মের মধ্যে উত্তরাধিকারী বৈশিষ্ট্যে পরিবর্তনই হলো বিবর্তন এবং গবেষণার ফলাফলে আমরা যা পেয়েছি, তাতে গোরংগোছার স্ত্রী হাতিগুলোর এই দন্তহীন হওয়ার প্রক্রিয়া সেই সংজ্ঞায় পুরোপুরি মিলে যায়।
তবে যত দ্রুত এসব কিছু ঘটছে, সেটা বিরল। এটা দ্রুত ঘটছে, কারণ, দাঁতহীন স্ত্রী হাতির যুদ্ধে টিকে থাকার সম্ভাবনা অনেক বেশি ছিল। পরবর্তী প্রজন্মের মধ্যে তাদের জিন ছড়িয়ে দেওয়ার হারও অত্যন্ত বেশি।
পুরুষ হাতির বেলায় তাহলে ব্যাপারটি আসলে কী? দাঁতসহ এবং ছাড়া ১৮টি স্ত্রী হাতির রক্তের নমুনার জিনোম বিশ্লেষণ করেন গবেষকেরা। তারা দেখলেন, এক্স-ক্রোমোসোমের বিশেষ অংশের জেনেটিক ভেরিয়েন্ট রয়েছে দাঁত ছাড়া স্ত্রী হাতির মধ্যে। এই ক্রোমোসোম দাঁত বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
রায়ান লং বলেছেন, স্ত্রী প্রজাতির এক্স-ক্রোমোসোম দুটি। দাঁতহীন স্ত্রী হাতির সে দুটি ক্রোমোসোমের একটি ‘স্বাভাবিক’, অপরটি থেকে ওই তথ্য মুছে গেছে।
দাঁতহীন স্ত্রী হাতির গর্ভে পুরুষ হাতি এলে মায়ের কাছ থেকে ‘ক্ষতিগ্রস্ত’ ক্রোমোসোম পাওয়ার আশঙ্কা অর্ধেক, ‘স্বাভাবিক’ ক্রোমোসোম পাওয়ার সম্ভাবনাও অর্ধেক। স্বাভাবিক ক্রোমোসোম পেলে দাঁতের জন্য প্রয়োজনীয় নির্দেশনাসহ হাতিটি জন্মাবে। আর বিশেষ ওই জেনেটিক ভেরিয়েন্ট পেলে গর্ভেই পুরুষ ভ্রূণ মরে যায়। কারণ, ভেরিয়েন্টটি পুরুষ হাতির জন্য প্রাণঘাতী।
গবেষণাপত্রে অবশ্য বলা হয়েছে, হাতির ২২ মাসের গর্ভকালে স্ত্রী হাতির দন্তহীন হওয়ার প্রক্রিয়া এবং পুরুষ হাতির মৃত্যুর প্রক্রিয়াটি পুরোপুরি বোঝা যায় না।
গোরংগোছায় হাতির পরিমাণ বেড়ে এখন ৮০০-এর আশপাশে। দাঁত না থাকায় স্ত্রী হাতিদের খুব যে ক্ষতি হচ্ছে, আপাতদৃষ্টে তা মনে হচ্ছে না। বরং এই বিবর্তনে তারা মানিয়ে নিয়েছে। দাঁতহীন হাতির খাদ্যতালিকায় এখন বেশি থাকছে ঘাস। তবে বিষয়টি নিয়ে আরও গবেষণা চালাতে চান ওই গবেষকেরা।
এসডব্লিউএসএস/১৬২০
আপনার মতামত জানানঃ