ভোট গ্রহণের পর ফলাফলের গেজেট প্রকাশ হলেও অনিয়ম পাওয়া গেলে নির্বাচন কমিশনকে সেই ভোট বাতিলের ক্ষমতা দিয়ে গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ-১৯৭২ সংশোধনের খসড়া প্রস্তাবে নীতিগত অনুমোদন দিয়েছে বাংলাদেশের মন্ত্রিসভা।
মঙ্গলবার বাংলাদেশের মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সচিব মোঃ মাহবুব হোসেন সাংবাদিকদের বলেছেন, এটার নীতিগত অনুমোদন দিয়েছে, কিন্তু এখনো চূড়ান্ত করা হয়নি। এটার আরও কিছু সংশোধন করতে হবে। আরও কিছু মতামতসহ, আরেকটু পরীক্ষানিরীক্ষা করে এটা আবার মন্ত্রিসভায় উপস্থাপিত হবে।
নীতিগত অনুমোদন মানে এ ধরনের একটি আইন তৈরিতে সরকার সম্মতি দিয়েছে। তবে মন্ত্রিসভার চূড়ান্ত অনুমোদনের পর এটি বিল আকারে সংসদে যাবে।
মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সচিব মোঃ মাহবুব হোসেন জানান, আইনের ১৪টি ধারায় সংশোধনীর প্রস্তাব করা হয়েছিল। নির্বাচন কমিশনার রাশেদা সুলতানা এই প্রসঙ্গে কয়েকদিন আগে সাংবাদিকদের বলেছেন, আরপিও পাস হলে সেটা হবে একটা যুগান্তকারী আইন।
‘আরপিসও পাস হলে কমিশন, যারা ফিল্ডে কাজ করবেন, প্রত্যেকের জন্য খুব ভালো একটা কাজ হবে। বাংলাদেশে থেকে সবকিছু (নির্বাচনী অপরাধ) নিমূর্ল করা সম্ভব নয়, তবে অনেকটাই হ্রাস পাবে বলে আশা করছিল। এতে প্রার্থী, সমর্থক সবার আচরণগত পরিবর্তন হবে।’
কিন্তু বাংলাদেশের নির্বাচন কমিশন নিয়ে আস্থার যে সংকট রয়েছে, তা কতটা ফেরাতে পারবে এই সংশোধনী?
আইনের সংশোধনী কি আস্থা ফেরাতে পারবে?
নির্বাচন কমিশনের সামনে রাজনৈতিক দল, জনগণ এবং আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকদের আস্থা অর্জন করতে পারাটা সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হবে বলে বিশ্লেষকরা বলছেন।
বাংলাদেশে গত বছর নতুন নির্বাচন কমিশন গঠন করতে যে সার্চ কমিটি গঠন করা হয়েছিল, তাতে বিরোধী বিএনপিসহ একাধিক দল অংশগ্রহণ করেনি। নতুন কমিশন গঠনের জন্য কোনো নামও তারা সার্চ কমিটির কাছে জমা দেননি।
সেই সময় বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, নির্বাচন কমিশন নিয়ে তাদের কোন মাথাব্যথা নেই। তাদের একমাত্র দাবি, তত্ত্বাবধায়ক বা নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন কমিশন গঠন করে যেন নির্বাচনের ব্যবস্থা করতে হবে।
বাংলাদেশের গত দুইটি সাধারণ নির্বাচন ঘিরেই ত্রুটি ও নিরপেক্ষতার প্রশ্ন রয়েছে। নুরুল হুদার নেতৃত্বাধীন কমিশনের তত্ত্বাবধানে সর্বশেষ জাতীয় সাধারণ নির্বাচনে ব্যাপক কারচুপির অভিযোগ উঠেছে।
গত বছরের জুনে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে যে সংলাপের আয়োজন করেছিল নতুন নির্বাচন কমিশন, তাতেও অংশ নেয়নি বিএনপি এবং তাদের মিত্র দলগুলো। সেই সময় বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেছিলেন, যে প্রক্রিয়ায় এই কমিশন গঠন করা হয়েছে, তাতে আমরা অংশ নেই নেননি, তাদের স্বীকৃতিও দেইনি এবং কমিশনের কোন কার্যক্রমেও অংশ নেইনি। এই কারণে আমরা সংলাপে অংশ নেইনি।
সাবেক নির্বাচন কমিশন বিগ্রেডিয়ার জেনারেল (অবসরপ্রাপ্ত) সাখাওয়াত হোসেন বিবিসি বাংলাকে বলছেন, আইনে থাকলে হয়তো কমিশনের জন্য ভালো, কিন্তু আস্থা ফেরানোর বিষয়টি নির্ভর করে আসলে কমিশনের কর্মকাণ্ডের ওপরে।
‘’আস্থার বিষয়টি আসবে যদি নির্বাচন কমিশন এই আইনগুলোকে যথাযথভাবে প্রয়োগ করতে পারে। সেটা যতক্ষণ না হবে, ততক্ষণ আস্থার বিষয়টি আসবে না।‘’
কেন এত অনাস্থা?
নির্বাচন বিশ্লেষকরা বলছেন, যারা নির্বাচন কমিশন নিয়ে অনাস্থার কথা বলছেন, তাদেরও কিছু যুক্তি এবং অভিযোগ রয়েছে। বিশেষ করে এই কমিশনের অধীনে বেশ কিছু নির্বাচনী অনিয়মে তাদের এখনো পূর্ণাঙ্গ পদক্ষেপ নিতে দেখা যায়নি।
সাখাওয়াত হোসেন বলেছেন, “কেন তারা পদক্ষেপ নিতে পারেনি, সেটাও প্রশ্ন। অ্যাকশন নেয়ার বিষয়টি আগেও আরপিওর মধ্যে ছিল। ফলে নতুন করে আইন জোরালো হলে, নতুন আইন হলেই ফ্রি-ফেয়ার ইলেকশনের গ্যারান্টি হয় না। আইন তো বাস্তবায়ন করতে হবে কমিশনকেই। সেই জায়গাতেই তো লোকে আস্থা রাখতে পারছে না, যে কমিশন এগুলো বাস্তবায়ন করতে পারবে কিনা?’’
নির্বাচন পর্যবেক্ষকরা বলছেন, অতীতে অনেক সময় দেখা গেছে, নির্বাচন কমিশন ব্যবস্থা নেয়ার পরেও আইনে না থাকায় আদালতে গেলে বিক্ষুব্ধ পক্ষ বাড়তি সুবিধা পেয়ে থাকে। কিন্তু এখন আইনে সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ থাকায় আদালতে চ্যালেঞ্জ হবে না।
নির্বাচনী পর্যবেক্ষকরা বলছেন, গাইবান্ধার উপ-নির্বাচনে অনিয়মের অভিযোগে কমিশন শক্ত পদক্ষেপের কথা জানালেও এখনো সেরকম জোরালো কোন শাস্তির ব্যবস্থা দেখা যায়নি। গত বছরের ১২ অক্টোবর উত্তরাঞ্চলীয় জেলা গাইবান্ধার একটি আসনের উপ-নির্বাচনে ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগে ভোটগ্রহণ বাতিল করে দিয়েছে নির্বাচন কমিশন।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া উপ-নিবাচনে একজন প্রার্থী নির্বাচনের আগে আগে নিখোঁজ হয়ে ছিলেন, সে বিষয়ে কমিশন কোন তদন্তের ব্যবস্থা নেয়নি। এসব বিষয়ে কোন পদক্ষেপ দৃশ্যগোচর হয়নি বলে আস্থার সংকট তৈরি হয়েছে।
আরেকজন নির্বাচন পর্যবেক্ষক ও বিশ্লেষক মুনিরা খান বলছেন, ‘’আস্থার সংকটের আগে সমাধান করতে হবে। সেটা হলেই অন্যান্য সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে।
“নির্বাচন কমিশনের কাছে যে আইন আছে, তা অনেক দেশের চেয়ে ভালো। এই আইনের অধীনে অতীতে অনেক সুষ্ঠু নির্বাচনের উদাহরণও আছে। সুতরাং আইন সমস্যা নয়, যে নির্বাচন কমিশন আছে, তাদের সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজনে সদিচ্ছা কতটুকু, আইন সঠিকভাবে প্রয়োগ করা হচ্ছে কিনা, সেটার ওপরেই সবকিছু নির্ভর করে।”
তার মতে, এই কমিশন কতটা নিরপেক্ষ এবং স্বাধীনভাবে তাদের সদিচ্ছা প্রয়োগ করতে পারবেন, সেটা এখনো পুরোপুরি দেখা যায়নি। বরং তাদের সিদ্ধান্তে এবং বক্তব্যেও অনেক সময় সামঞ্জস্যহীনতা দেখা যাচ্ছে।
তবে নির্বাচন কমিশনার রাশিদা সুলতানা বলেছেন, ‘আমাদের যতটুকু ক্ষমতা দেয়া আছে আইনে, সেটা তো আমরা অবশ্যই বাস্তবায়ন করছি। নতুন আইনটা অনেক জায়গার নির্বাচনে অনিয়মের অভিযোগ ওঠার পর আমরা কিন্তু সাথে সাথে ব্যবস্থা নিয়েছি। নির্বাচন বন্ধ করে দিয়েছি।’
‘আগে যেসব নির্বাচনী অপরাধগুলোকে অপরাধ হিসাবে দেখা হতো না, এখন সেগুলোকেও অপরাধ হিসাবে চিহ্নিত করে শাস্তির আওতায় আনা হয়েছে। নির্বাচন সুষ্ঠু করার জন্য আমরা সবকিছুই করছি। সুতরাং আমাদের ওপর আস্থা না রাখার তো কোন কারণ দেখছি না।’
আরপিও সংশোধনীতে প্রস্তাবে যা রয়েছে
কাজী হাবিবুল আউয়ালের নেতৃত্বাধীন নির্বাচন কমিশন গত বছরের অগাস্ট মাসে দায়িত্ব নেয়ার পর আরপিও সংশোধনের একগুচ্ছ প্রস্তাব পাঠিয়েছিল সরকারের কাছে। আইন মন্ত্রণালয়ের যাচাইবাছাই শেষে সেটি মন্ত্রিসভায় পাঠানো হয়।
১৯৭২ সালে এই আইনটি করার পর এ পর্যন্ত বিভিন্ন সময় ১২ বার সংশোধন আনা হয়েছে। সর্বশেষ ২০১৮ সালে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন ব্যবহারের সুযোগ যোগ করে আরপিও সংশোধন হয়েছিল।
বর্তমান নির্বাচন কমিশনের আরপিও সংশোধনীতে প্রস্তাবে আরও উল্লেখ আছে যে, নিবাচনী কাজে অবৈধভাবে বাধা ও পোলিং কর্মকর্তাদের ভয় দেখানো বা ভোটগ্রহণে বাধা দেয়া ব্যক্তিদের শাস্তির আওতায় আনা। ভোটকেন্দ্রে পেশিশক্তির প্রভাব দেখানো হলে ভোটগ্রহণ বন্ধ করে দেয়ার ক্ষমতা।
ব্যালট পেপারের পেছনে সিল ও স্বাক্ষর না থাকলে সেটা গণনায় না নেয়া। মনোনয়ন পত্রের সঙ্গে টিআইএন এবং আয়কর রসিদ যোগ করতে হবে। ভোটগণনার বিবররণী ও ব্যালট পেপারের হিসাব প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী বা তার এজেন্টকে দেয়া।
২০৩০ সালের মধ্যে দলের সব স্তুরের কমিটিতে নারী প্রতিনিধিত্ব ৩৩ শতাংশ করা। পর্যবেক্ষক ও সাংবাদিকদের প্রবেশে বাধা দেয়া হলে কারাদণ্ড। মনোনয়নপত্র দাখিলের আগেরদিন কৃষি, ক্ষুদ্রঋণ ও বিল খেলাপিরা টাকা পরিশোধ করে প্রাথী হওয়ার সুযোগ।
এসডব্লিউএসএস/২০৫০
আপনার মতামত জানানঃ