সোমবার জার্মানিতে ট্রাম-বাস, ট্রেন ও বিমান চলছে না। শ্রমিক সংগঠনের ডাকে বিশাল ধর্মঘটে গোটা দেশ প্রায় স্তব্ধ হয়ে গেছে। মূল্যস্ফীতির মুখে বেতন ও মজুরি বাড়াতে এভাবে সরকারের উপর চাপ সৃষ্টি করা হচ্ছে।
অস্ট্রিয়ার প্রতিবেশী জার্মানির এই সর্বাত্মক পরিবহন ধর্মঘটের ফলে অস্ট্রিয়ান এয়ারলাইন্স রবিবার ও সোমবার তাদের কয়েক ডজন ফ্লাইট বাতিলের কথা জানিয়েছে।
অস্ট্রিয়ান সংবাদ সংস্থা এপিএ জানিয়েছে, জার্মানি এবং অস্ট্রিয়ার মধ্যে অনেক ফ্লাইট সপ্তাহান্তে শুরু হওয়া জার্মান ট্রাফিক ধর্মঘটের দ্বারা প্রভাবিত হবে৷ ভিয়েনা বিমানবন্দর থেকে তথ্য অনুযায়ী মিউনিখ এবং ভিয়েনার মধ্যে শুধুমাত্র রবিবার বারোটি ফ্লাইট রবিবার বাতিল করা হয়েছে।
বর্তমান তথ্য অনুসারে ভিয়েনা এবং মিউনিখের পাশাপাশি ফ্রাঙ্কফুর্ট, নুরেমবার্গ, স্টুটগার্ট, ডুসেলডর্ফ, হামবুর্গ এবং কোলোনের মধ্যে মোট ৯১টি পরিকল্পিত ফ্লাইটের মধ্যে ৫৪টি সোমবার বাতিল করা হবে। বিশেষ করে ২৭টি বহির্গামী এবং ২৭টি ফিরতি ফ্লাইট প্রভাবিত হয়েছে৷
ভিয়েনা, সালজবার্গ, ইনসব্রুক, লিনজ এবং ক্ল্যাগেনফুর্টে ধর্মঘটের কারণে জার্মানিতে আসা এবং যাওয়ার ফ্লাইট রয়েছে। সোমবার জার্মানিতে সর্বাত্মক পরিবহন অন্যান্য ধর্মঘট হবে। ইতিমধ্যেই ইউরো বাংলা জানিয়েছে,এই ধর্মঘটের ফলে অস্ট্রিয়ান ফেডারেল রেলওয়ে(ÖBB) তার কয়েক ডজন রেল বাতিল করেছে।
এপিএ আরও জানিয়েছে,ভিয়েনা বিমানবন্দর প্রতিদিন প্রায় ৬০০ টি ফ্লাইট পরিচালনা করে। ভিয়েনা বিমানবন্দরের মতে, বার্লিন, হ্যানোভার এবং লাইপজিগের ফ্লাইটগুলি এখনও প্রভাবিত হয়নি,কেননা রবিবার ও সোমবার এখানে কোন নিয়মিত ফ্লাইট নাই। তবে পরবর্তী প্রভাবগুলি উড়িয়ে দেওয়া যায় না। ভিয়েনা বিমানবন্দরের প্রতিদিনের এই ৬০০ টি ফ্লাইটের মধ্যে ১২টি রবিবার এবং ৫৪টি সোমবার বাতিল করা হয়েছে।
A nationwide warning strike organized by several trade unions has officially started in Germany.
The 24-hour strike focused mainly on public transport will halt the vast majority of buses, trains and planes in Germany. https://t.co/7WTnpeyFJo
— DW News (@dwnews) March 27, 2023
রোববার মাঝরাত থেকে সোমবার মাঝরাত পর্যন্ত জার্মানিতে জনজীবন প্রায় স্তব্ধ করে দিতে বিশাল ‘সতর্কতামূলক’ ধর্মঘটের ডাক দিয়েছে পরিষেবা ক্ষেত্রে বিশ্বের সবচেয়ে বড় শ্রমিক সংগঠন ভ্যার্ডি এবং রেল ও পরিবহন ক্ষেত্রের শ্রমিক সংগঠন ইভিজি।
ভ্যার্ডির সদস্য সংখ্যা প্রায় ২৫ লাখ এবং ইভিজির প্রায় দুই লাখ ৩০ হাজার। সরকার ও পৌর স্তরের শ্রমিক-কর্মীদের জন্য মোটা অংকের বেতনবৃদ্ধির দাবি করছে তারা। ভ্যার্ডি ১০ দশমিক পাঁচ শতাংশ বৃদ্ধি চাইছে, ইভিজি চাইছে ১২ শতাংশ। সোমবারই মালিক ও শ্রমিক পক্ষের মধ্যে দরকষাকষি আবার শুরু হওয়ার কথা।
ভ্যার্ডি-র মতে, প্রথমে করোনা মহামারী তারপর ইউক্রেন যুদ্ধের ধাক্কায় মূল্যস্ফীতির কারণে শ্রমিক-কর্মীদের দুরাবস্থা অন্তত কিছুটা হলেও লাঘব করতে এই দাবি ন্যায্য।
উল্লেখ্য, সাম্প্রতিক গোটা দেশে বিচ্ছিন্নভাবে বিভিন্ন অঞ্চল ও ক্ষেত্রে ধর্মঘটের মাধ্যমে কর্মদাতাদের উপর চাপ সৃষ্টি করে আসছে শ্রমিক সংগঠন। ভ্যার্ডি-র প্রধান ফ্রাংক ভ্যার্নেকে বলেন, এটা হাজার হাজার কর্মীর বেঁচে থাকার প্রশ্ন।
অন্যদিকে সরকার ও পৌর স্তরের প্রতিষ্ঠানগুলো শ্রমিক সংগঠনের এই দাবিকে অবাস্তব বলে বর্ণনা করছে। তাদের মতে, সরকারি কোষাগারে এমন অস্বাভাবিক বেতনবৃদ্ধির জন্য যথেষ্ট অর্থ নেই।
বিশেষ করে পরিবহন ক্ষেত্রে বেতন বেশি বাড়ালে ভাড়া ও বাড়তি কর চাপিয়ে সেই অর্থ সংগ্রহ করতে হবে। জার্মানির রেল সংস্থা ‘ডয়চে বান’ এই ধর্মঘটকে ‘সম্পূর্ণ মাত্রাহীন, ভিত্তিহীন ও অপ্রয়োজনীয় হিসেবে বর্ণনা করেছে।’
ইউক্রেন যুদ্ধের জের ধরে রাশিয়া থেকে সস্তায় গ্যাস সরবরাহ কার্যত বন্ধ হয়ে যাওয়ার ফলে জ্বালানির দাম হুহু করে বেড়ে গেছে। ফলে নিত্যপ্রয়োজনীয় বস্তুর মূল্য থেকে শুরু করে বাসা ভাড়া এক ধাক্কায় অনেকটা বেড়ে গেছে। জ্বালানি সংকট দেখা না দিলেও মূল্যস্ফীতির রাশ টান টানতে ব্যর্থ হয়েছে সরকার।
সাম্প্রতিক মাসগুলোতে ইউরো এলাকার তুলনায় জার্মানির মূল্যস্ফীতির হার বেশি থেকেছে। ফেব্রুয়ারি মাসে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম গত বছরের তুলনায় নয় দশমিক তিন শতাংশ বেশি ছিল। সোমবারের ধর্মঘটের ফলে নিত্যযাত্রীসহ সাধারণ মানুষ ব্যাপক সমস্যার মুখে পড়ছেন।
বিশেষ করে, বাসায় থেকে ‘হোম অফিস’ করার সুবিধা যাদের নেই, তাদের জন্য কর্মক্ষেত্রে যাওয়া কঠিন হয়ে পড়বে। জার্মানির হাইওয়ে পরিচালন সংস্থার কর্মীরাও ধর্মঘটে যোগ দেওয়ায় অনেক হাইওয়েতে অবরোধের আশঙ্কা রয়েছে।
ভ্যার্ডির প্রধান ভ্যার্নিকে মানুষের দুর্দশার কথা মেনে নিয়েও বর্তমান পরিস্থিতিতে শ্রমিক ও কর্মীদের ন্যায্য দাবি আদায় করতে এছাড়া কোনো উপায় নেই বলে মন্তব্য করেন। পণ্যের পরিবহনে বিঘ্ন এড়াতে জার্মানির পরিবহণমন্ত্রী ফল্কার ভিসিং রোববার ট্রাক চালানোর উপর নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের নির্দেশ দিয়েছিলেন।
বিগত ২০২২ সাল থেকেই জার্মানিতে একের পর এক পরিবহন ধর্মঘট হয়ে আসছে। বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন চড়া হারে মূল্যবৃদ্ধির কারণে এই সমস্ত ধর্মঘট অনুষ্ঠিত হচ্ছে। জার্মানির সরকারি ক্ষেত্রের প্রায় ২৫ লাখের বেশী শ্রমিক ভেড়ডি ট্রেড ইউনিয়নের সাথে যুক্ত আছে । পাশাপাশি ইভিজি ইউনিয়নের সদস্য শ্রমিক সংখ্যা প্রায় ২ লাখ ৩০ হাজার।
এই দুই ট্রেড ইউনিয়নের সদস্যরা জার্মানির সড়ক ও বেসামরিক বিমান ক্ষেত্রের সাথে সম্পৃক্ত। এদিকে ট্রেড ইউনিয়ন ভেরডির চেয়ারম্যান ফ্রান্ক ওয়েরেন্কে বলেন,আমরা এমন শ্রমিক সংগঠনের সাথে যুক্ত যাদের সদস্যরাই মূলত জার্মানির চালিকা শক্তির উৎস।
জার্মানির মুদ্রাস্ফীতির কারণ
ইউক্রেন যুদ্ধ জার্মানির মতো দেশের জন্যেও ব্যয়বহুল হয়ে দাঁড়িয়েছে। অতিরিক্ত অর্থ জোগাড় করার পাশাপাশি সরকারকে ভাবতে হচ্ছে অর্থ সমাজ কল্যাণে নাকি আন্তর্জাতিক নিরাপত্তার জন্য বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
অর্থই সবকিছু না, তবে অর্থ ব্যাতীত কোনো রাজনৈতিক পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা যায় না। ইউক্রেন যুদ্ধ এবং অভ্যন্তরীণ খরচ মেটাতে জার্মান কোয়ালিশন সরকার যে পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েছে সেটা বেশ হতাশার।
অর্থমন্ত্রী ক্রিশ্চিয়ান লিন্ডনার গত কয়েক মাস ধরে তার সহকর্মীদের সাথে বাজেট নিয়ে আলোচনা করছেন। আলোচনার অন্যতম ইস্যু হচ্ছে ঋণ বিরতি, যা কেবল তখনই করা যেতে পারে যখন সরকার প্রচুর সঞ্চয় করে।
রাশিয়া ইউক্রেন আক্রমণ করার পর জলবায়ু সুরক্ষার জন্য বরাদ্দকৃত ৬০ বিলিয়ন ইউরো বিশেষ ঋণের উপরে অতিরিক্ত ঋণ নিতে হয়েছিল। এরপর জার্মান সশস্ত্র বাহিনীর উন্নতির জন্য ১০০ বিলিয়ন ইউরো ঋণ নিতে হয়। এছাড়াও উচ্চ জ্বালানি খরচ মেটাতে দেশের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও জনগণের জন্য ২০০ বিলিয়ন ইউরো আর্থিক সহায়তাও দেয়া হয়েছিলো।
এই সব ঋণ কোভিড-১৯ মহামারীর কারণে নেয়া রেকর্ড পরিমান ঋণ এবং তারও আগে নেয়া ঋণের বাইরে নেয়া হয়। সব মিলে সরকারের উপরে এখন ২.৫ ট্রিলিয়ন ইউরো ঋণের পাহাড়। মুদ্রাস্ফীতি এবং সুদের হার বৃদ্ধির কারণে ঋণের সুদের অর্থ মন্ত্রণালয়কে খুঁজতে হচ্ছে। এদিকে, ২০২৪ সালের কর রাজস্বের পূর্বাভাস বলছে অর্জিত রাজস্ব সরকার বর্তমান চাহিদা পূরণের জন্য যথেষ্ট হবে না।
এরই মধ্যে ১০ লক্ষ শরণার্থী জার্মানিতে প্রবেশ করেছে এবং আরও আসছে। এতো বড় সংখ্যক মানুষের বাসস্থান ও দেখভাল করতে বিলিয়ন বিলিয়ন ইউরো খরচ হয়ে যাচ্ছে। এ জন্য প্রাদেশিক ও স্থানীয় সরকারগুলো পর্যাপ্ত অর্থ বরাদ্দ না পেয়ে সমালোচনা করছে।
এমন পরিস্থিতিতে সামরিক খাতের ব্যয় ব্যাপকহারে বেড়েছে। সামরিক বাহিনীর জন্য প্রতিরক্ষামন্ত্রী আরও ১০ বিলিয়ন ইউরো বরাদ্দ চেয়েছেন।
এসবের সমালোচনা করে তার দলের একজন সংসদ সদস্য বলেছেন, আন্তর্জাতিক নীতি বাস্তবায়নের বেলায় মানবিক সহায়তা ও উন্নয়ন অবহেলা করা উচিত নয়। তাই প্রশ্ন উঠেছে, আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা বেশি গুরুত্বপূর্ণ, নাকি সামাজিক কল্যাণ?
এসডব্লিউএসএস/১৬৫০
আপনার মতামত জানানঃ