মাদক মামলায় বিনা দোষে ১০ বছরের সাজাপ্রাপ্ত শাহাবুদ্দিন বিহারীর পরিবর্তে আসামি হিসেবে প্রায় ৫ বছর ধরে কারাগারে ছিলেন রাজধানীর পল্লবীর বেনারসী কারিগর মো. আরমান বিহারী। অবশেষে আরমান বিহারীর মুক্তির নির্দেশ মিলছে। ৩১ ডিসেম্বর ২০২০, বৃহস্পতিবার বিচারপতি মো.মজিবুর রহমান মিয়া ও বিচারপতি মহি উদ্দিন শামীমের সমন্বয়ে গঠিত ভার্চুয়াল হাইকোর্ট বেঞ্চ এ নির্দেশ দেন। একইসঙ্গে তাকে ২০ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দিতে পুলিশ মহাপরিদর্শকের প্রতি নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া আরমানকে আসামি করার ঘটনায় জড়িত পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দিয়েছেন আদালত।
আদালতে আজ রিটের পক্ষে শুনানি করেন ব্যারিস্টার হুমায়ন কবির পল্লব। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল ব্যারিস্টার নওরোজ মো: রাসেল চৌধুরী।
এর আগে গত বছরের ২৩ এপ্রিল ভুল আসামি হয়ে প্রায় ৪ বছর ধরে কারাগারে থাকা পল্লবীর বেনারসি পল্লীর কারিগর মো. আরমানকে কেন মুক্তির নির্দেশ দেয়া হবে না, তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেছিলেন হাইকোর্ট। রুলে মো. আরমানকে কারাগারে রাখায় কেন পর্যাপ্ত ক্ষতিপূরণ দেয়া হবে না, তাও জানতে চাওয়া হয়।
২০১৯ সালের ২১ এপ্রিল ভুল আসামি হয়ে প্রায় ৪ বছর ধরে কারাগারে থাকা মো. আরমানকে আদালতে হাজির করার নির্দেশনা ও মুক্তি চেয়ে হাইকোর্টে রিট দায়ের করা হয়। ল এন্ড লাইফ ফাউন্ডেশনের পক্ষে ব্যারিস্টার হুমায়ন কবির পল্লব রিট আবেদনটি দায়ের করেন। রিটে স্বরাষ্ট্র সচিব, আইজিপি, ঢাকার জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ও পল্লবীর ওসিসহ সংশ্লিষ্টদের বিবাদী করা হয়।
আরমানকে কারাগারে বন্দি রাখা নিয়ে ‘কারাগারে আরেক জাহালম’ শিরোনামে ২০১৯ সালের ১৮ এপ্রিল সংবাদ প্রকাশিত হয়। ওই প্রতিবেদন সংযুক্ত করে ল অ্যান্ড লাইফ ফাউন্ডেশন রিট আবেদনটি করেছিল।
সেসময় প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, ২০০৫ সালের ৩০ আগস্ট রাতে পল্লবীর ৬ নম্বর সেকশনের সি ব্লকের ৮ নম্বর লেনের ৭ নম্বর ভবনের নিচতলার একটি ফ্ল্যাট থেকে ৪০ বোতল ফেনসিডিলসহ শাহাবুদ্দিন এবং তার দুই সহযোগী সোহেল মোল্লা ও মামুন ওরফে সাগরকে গ্রেফতার করে ডিবি। এরপর তাদের বিরুদ্ধে পল্লবী থানায় মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে মামলা করা হয়। ওই মামলায় ওই বছরের ১৮ সেপ্টেম্বর তিনজনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেয় পুলিশ। দুই বছর কারাগারে থাকার পর জামিনে মুক্তি পান শাহাবুদ্দিন। কিন্তু তিনি আর আদালতে হাজির হননি। এ অবস্থায় তার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা হয়।
এরপর তিনি ২০১১ সালের ১৭ জানুয়ারি আদালতে আত্মসমর্পণ করে জামিন নেন। এই মামলায় বিচার শেষে ২০১২ সালের ১ অক্টোবর রায় দেন ঢাকার জননিরাপত্তা বিঘ্নকারী অপরাধ দমন ট্রাইব্যুনাল। রায়ে শাহাবুদ্দিনকে ১০ বছরের কারাদণ্ড দেয়া হয়। কিন্তু রায়ের দিন শাহাবুদ্দিন পলাতক থাকায় আদালত তার বিরুদ্ধে আবারও গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেন।
ওই মামলায় ২০১৬ সালের ২৭ জানুয়ারি পুলিশ মো. আরমানকে গ্রেফতার করে। মূল আসামি শাহাবুদ্দিনের পিতার নাম ইয়াসিন ওরফে মহিউদ্দিন। আরমানের পিতার নামও ইয়াসিন। উভয় ইয়াসিনই মৃত। সেই থেকে কারাগারে আরমান।
আরমানের পরিবার তখন অভিযোগ করেন, পুলিশের ভুলে অথবা গোপন কারসাজিতে শুধু পিতার নামে (মৃত ইয়াসিন) মিল থাকায় মৃত ইয়াসিন ওরফে মহিউদ্দিনের ছেলে শাহাবুদ্দিনের পরিবর্তে দীর্ঘ পাঁচ বছর ধরে ‘নির্দোষ’ আরমান (৩৬) সাজা ভোগ করছেন। অন্যদিকে প্রকৃত আসামি শাহাবুদ্দিন আরমানের বন্দিত্ব নিয়ে বাড়াবাড়ি না করার জন্য তার পরিবারকে লাগাতার চাপ দিয়ে যাচ্ছেন।
আরমানের স্ত্রীর বরাতে পত্রিকার প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, শাহাবুদ্দিন তার ছোট স্ত্রী চান্দাকে নিয়ে কাশিমপুর-২ নম্বর কারাগারে আরমানের সঙ্গে দেখা করেন এবং হুমকি দিয়ে বলেন, ‘মামলা নিয়ে যেন বাড়াবাড়ি না করে। বাড়াবাড়ি করলে ডিবি, থানা-পুলিশ, উকিল সব কিন্তু ফাঁসবে। তারা ফাঁসলে তোমাকে ছাড়বে না। আমার মামলায় তুমি জেল খাটছো, তাই আমিই তোমাকে বের করবো। তোমার মাকে বলো, তোমার উকিলের কাছ থেকে যেনো লিখিত নিয়ে আসে যে আমি এই মামলা আর পরিচালনা করবো না। তোমাকে ছাড়াতে যা যা করার লাগে সব করবো। আর বাড়াবাড়ি করলে পুলিশ সবার মাজায় রশি দিয়ে সব ধরে আনবে। তখন কিন্তু আমারে কিছু কইতে পারবা না।’
আইন বিষয়ে সংশ্লিষ্টরা বলেন, পুলিশের সংশ্লিষ্টতায় মূল আসামি বাইরে এবং নির্দোষ আরমান কারাদণ্ড ভোগ করেছেন। অভিযোগপত্রে নামের শেষে ওরফে লাগিয়ে সম্পর্ক তৈরি করা হয়েছে। মূলত অর্থের জন্যই পরিকল্পনা করেই একাজ করা হয়েছে। বেআইনিভাবে তাকে কারাগারে রাখা হয়েছে।
এর আগে সোনালী ব্যাংকের ঋণ জালিয়াতির ঘটনায় ২৬ মামলার ভুল আসামি পাটকল শ্রমিক জাহালম প্রায় তিন বছর কারাভোগের পর উচ্চ আদালতের আদেশে মুক্তি পান। এই ঘটনায় তখনকার সময় আদালত ক্ষমা প্রার্থনা পূর্বক ক্ষতিপূরণের নির্দেশও দিয়েছিলেন। পুলিশের গাফিলতি অথবা আর্থিক বিনিময়ে চক্রান্ত করেই এসব করেছিলেন বলে তখন অভিযোগ উঠেছিল।
এদিকে আজ আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) ২০২০ সালে ৩০০ বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে বলে জানিয়েছে। যারা আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ এবং মাদকবিরোধী অভিযানে, এ ছাড়া বছরজুড়ে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হেফাজতে নিহত হয়েছে । এতো গেলো দোষীদের কথা। আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর বন্দুকের ডগায় অসংখ্য নির্দোষ ব্যক্তি প্রাণ হারিয়েছেন যারা কখনোই তালিকায় আসবে না। সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, ঢাকা এবং এর বাইরে যত কারাগার আছে খোঁজ করে দেখলে এমন অসংখ্য আরমান জাহালমের সন্ধান পাওয়া যাবে যারা পুলিশের ভুলে, গাফিলতিতে অথবা অর্থের বিনিময়ে বিনাদোষে শাস্তি ভোগ করছেন।
এসডাব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৯১৫
আপনার মতামত জানানঃ