বহুল আলোচিত এবং আতঙ্ক সৃষ্টিকারী ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন (ডিএসএ) সংশোধনের তাগিদ পূনর্ব্যক্ত করলো জাতিসংঘ। বিশ্বসংস্থাটির মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনার ভলকার টুর্ক আইনটির সংশোধনের জন্য মঙ্গলবার বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আহ্বান জানান।
সেই সঙ্গে বাংলাদেশে রাজনৈতিক সহিংসতা বাড়তে থাকা, রাজনৈতিক কর্মীদের নির্বিচার গ্রেপ্তার, নির্বাচনকে সামনে রেখে মানবাধিকার এবং গণমাধ্যমকর্মীদের অব্যাহত হয়রানির কথা উল্লেখ করে জাতিসংঘ দূত গভীর হতাশা প্রকাশ করেন।
ডিএসএ বিষয়ে ভলকার টুর্ক বলেন, তার দপ্তরের সঙ্গে দীর্ঘ আলোচনার পর তিনি এটিকে সংশোধন করার জন্য বাংলাদেশ কতৃপক্ষের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছেন। তিনি বলেন, যারা তাদের স্বাধীন মতপ্রকাশ এবং বিশ্বাসের অধিকার প্রয়োগ করছে, তাদের বিরুদ্ধে এই আইন প্রয়োগর মাধ্যমে ফৌজদারি সাজা দেয়া অব্যাহত রয়েছে।
জেনেভায় জাতিসংঘ মানবাধিকার পরিষদের ৫২তম অধিবেশনে বক্তৃতাকালে বাংলাদেশ পরিস্থিতি প্রসঙ্গে ভলকার টুর্ক এসব কথা বলেন।
টুর্কের পূর্বসূরি মিশেল বাশেলেট গত বছরের আগস্টে বাংলাদেশ সফর করে এমন আহ্বান জানিয়েছিলেন। মিশেল বলেছিলেন, তার দপ্তর সরকারের কাছে আইনটি সংশোধনে সুনির্দিষ্ট সুপারিশমালা পেশ করেছে। তিনি তখন ওই সুপারিশ অনুযায়ী আইনটি সংশোধনের আহ্বান জানান।
গত ২৭ ফেব্রুয়ারি শুরু হওয়া মানবাধিকার পরিষদের ওই অধিবেশনে হাইকমিশনার টুর্ক এ পর্যন্ত ৪০টি দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে কথা বলেছেন। জেনেভার ওই আলোচনায় তিনি সেই সব দেশের কোন কোন বিষয়ে তাঁর উদ্বেগ রয়েছে, তা তুলে ধরেন।
উল্লেখ্য, ওএইচসিআরের সুপারিশমালাকে খসড়া অভিহিত করে গত ২৩ ফেব্রুয়ারি আইনমন্ত্রী আনিসুল হক গণমাধ্যমকে বলেন, এটি চূড়ান্ত হয়নি।
তবে এটা দ্বিধাহীনভাবে সত্য যে বর্তমান দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি বিভীষিকাময়। আর এমনটাই জানিয়েছে আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)। ২০২২ সালের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে সংস্থাটির নির্বাহী পরিচালক নূর খান এ মন্তব্য করেন। নূর খান বলেন, দেশের বর্তমান মানবাধিকার পরিস্থিতি বিভীষিকাময়। গণতন্ত্র সংকুচিত হলে মানবাধিকার লঙ্ঘিত হয়। নির্বাচন কমিশন নিয়ে মানুষের আস্থা এখনও সঠিকভাবে আসেনি যে তারা সুষ্ঠু নির্বাচন করতে পারবে। দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি অনেকটাই মাকাল ফলের মতো।
তিনি বলেন, গোপন যে ব্যবস্থা রয়েছে যাকে কারাগারে বা ডিটেনশন সেন্টার বলি কিংবা ইন্টারোগেশনের জন্য যে সমস্ত জায়গা রয়েছে সেগুলো বন্ধ করা উচিত। আমাদের আইন ও সংবিধান এগুলো সমর্থন করে না। যারা এগুলো পরিচালনা করেন তাদের চিহ্নিত করা উচিত। গুমের ঘটনা সঠিকভাবে সংবাদ মাধ্যমে আসছে না।
আসকের নির্বাহী পরিচালক বলেন, আমরা মনে করি, বিচারবহির্ভুত সকল তৎপরতা বন্ধ করতে হবে। গুম, খুন ও অপহরণের ঘটনা বন্ধে বিচার বিভাগীয় কমিশন গঠন করতে হবে। কমিশন চিহ্নিত করবেন এ ধরনের তৎপরতার সঙ্গে কারা জড়িত আছেন। জড়িতদের আইনের আওতায় আনতে হবে। আমরা বিচারবহির্ভূত প্রতিটি ঘটনার পূর্ণাঙ্গ তদন্ত চাই। দেখেছি, প্রতিটি ঘটনার তদন্ত একটা পর্যায়ে গিয়ে থেমে যায়। তাই প্রতিটি ঘটনার স্বাধীন তদন্ত হওয়া দরকার।
২০২২ সালে বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে আসকের পর্যবেক্ষণ তুলে ধরে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন সংস্থাটির পরিচালক নিনা গোস্বামী ও সমন্বয়ক ফজলুল কবির। আসকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিদায়ী বছরে সারা দেশে ৪৭৯টি রাজনৈতিক সংহিংসতার ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনায় নিহত হয়েছেন ৭০ জন। আহত হন ৬ হাজার ৯১৪ জন। এ বছর বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন ১৯ জন। শুধুমাত্র র্যাবের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে ৪ জন নিহত হয়েছেন।
এছাড়া আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হেফাজতে আরো ১৫ জন নিহত হয়েছেন। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে রাজশাহী, চট্টগ্রাম ও ঢাকা বিভাগে মামলা হয়েছে ২২৪৯টি। অপহরণ, গুম ও নিখোঁজ হয়েছেন ৫ জন। নারী নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে ১ হাজার ৬৯৪টি। খুন হয়েছে ১২৬ জন নারী। ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ৯৩৬ জন। অ্যাসিড সন্ত্রাসের শিকার হয়েছেন ১২ জন নারী। শিশু নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে ১ হাজার ৪৫টি। এ ধরনের ঘটনায় নিহত হয়েছে ৪৭৪ শিশু।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, বিদায়ী বছর সীমান্তে হত্যার শিকার হয়েছেন ২১ জন। গণপিটুনিতে মারা গেছেন ৩৬ জন। কারা হেফাজতে মৃত্যু হয়েছে ৬৫ জনের। এছাড়া ২০২২ সালে সংখ্যালঘুদের ওপর ১২টি হামলার ঘটনা ঘটেছে। ২১০ জন সাংবাদিক নির্যাতন ও হয়রানির শিকার হয়েছেন বলে আসকের এই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।
এসডব্লিউএসএস/১৩৪৫
আপনার মতামত জানানঃ