উদার গণতান্ত্রিক সূচক ও নির্বাচনভিত্তিক গণতন্ত্রের সূচকে বাংলাদেশের অবস্থা গত বছরের তুলনায় আরও খারাপ হয়েছে। গতবারের তুলনায় বাংলাদেশের অবস্থান এক ধাপ পিছিয়েছে। সুইডেনভিত্তিক গবেষণাপ্রতিষ্ঠান ভ্যারাইটিজ অব ডেমোক্রেসির (ভি-ডেম) প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে।
গতকাল বৃহস্পতিবার প্রতিবেদনটি প্রকাশিত হয়েছে। ভি-ডেমের এবারের প্রতিবেদনের শিরোনাম ‘ডিফাইঅ্যান্স ইন দ্য ফেস অব অটোক্রাটাইজেশন’। সাত বছর ধরে বৈশ্বিক শাসনব্যবস্থা নিয়ে ‘গণতন্ত্র প্রতিবেদন’ প্রকাশ করে আসছে সুইডেনের গোথেনবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভি-ডেম ইনস্টিটিউট।
ভি-ডেমের এবারের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, উদার গণতান্ত্রিক সূচকে (লিবারেল ডেমোক্রেসি ইনডেস্ক) ১৭৯টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৪৭তম। স্কোর শূন্য দশমিক ১১। গতবারের চেয়ে স্কোর কমেছে শূন্য দশমিক ০২। আগেরবার বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১৪৬তম।
প্রতিবেদনে ‘নির্বাচনভিত্তিক গণতন্ত্রের সূচকে’ (ইলেকটোরাল ডেমোক্রেসি ইনডেক্স) বাংলাদেশের অবনমন হয়েছে। সূচকে বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থান ১৩১তম। স্কোর শূন্য দশমিক ২৮। স্কোর কমেছে প্রায় শূন্য দশমিক ০৩। আগেরবার অবস্থান ছিল ১৩৫তম।
লিবারেল (উদার) কম্পোনেন্ট ইনডেস্কে বাংলাদেশের অবস্থান ১৫৫তম। ইগলিট্যারিয়ান (সমতা) কম্পোনেন্ট ইনডেস্কে ১৬৫তম। পার্টিসিপেটরি (অংশগ্রহণমূলক) কম্পোনেন্ট ইনডেস্কে ১৪২তম। ডেলিবারেটিভ (সিদ্ধান্তমূলক) কম্পোনেন্ট ইনডেস্কে বাংলাদেশ ১৪৫তম অবস্থানে আছে।
ভি-ডেম ইনস্টিটিউটের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শাসনতান্ত্রিক দিক থেকে বাংলাদেশ আছে ‘নির্বাচনভিত্তিক স্বেচ্ছাতন্ত্র’ (ইলেকটোরাল অটোক্রেসি) বিভাগে। এর অর্থ হলো এ দেশে গণতন্ত্র অপস্রিয়মাণ। আর সে জায়গায় ধীরে ধীরে স্থান করে নিচ্ছে স্বেচ্ছাচারী শাসন। বাংলাদেশের অবস্থান আগের প্রতিবেদনেও এমনটাই ছিল।
বাংলাদেশের প্রতিবেশী ভারতও আছে ‘নির্বাচনভিত্তিক স্বেচ্ছাতন্ত্র’ বিভাগে। ভারতের গণতান্ত্রিক পরিস্থিতিরও অবনতি হয়েছে। উদার গণতান্ত্রিক সূচকে ভারতের অবস্থান ৯৭তম। নির্বাচনভিত্তিক গণতন্ত্রের সূচকে ১০৮তম। উভয় ক্ষেত্রে ভারতের অবনমন ঘটেছে।
ভি-ডেমের প্রতিবেদনে উদার গণতান্ত্রিক সূচকে শীর্ষ তিন স্থানে আছে যথাক্রমে ডেনমার্ক, সুইডেন ও নরওয়ে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২২ সাল নাগাদ বিশ্বের মোট জনসংখ্যার ৭২ শতাংশ স্বেচ্ছাতন্ত্রের মধ্যে ছিল। ১০ বছর আগে তা ছিল ৪৮ শতাংশ। আর বিশ্বের মোট জনসংখ্যার মাত্র ১৩ শতাংশ উদার গণতন্ত্রে বাস করে। উদার গণতান্ত্রিক দেশের সংখ্যা কমে দাঁড়িয়েছে ৩২।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২২ সালে ৩৫টি দেশে মতপ্রকাশের স্বাধীনতার অবনতি ঘটেছে। গণমাধ্যমের ওপর সরকারি সেন্সরশিপ বেড়েছে ৪৭টি দেশে। সুশীল সমাজের সংগঠনগুলোর ওপর সরকারি দমন-পীড়ন বেড়েছে ৩৭টি দেশে।
উল্লেখ্য, গণতন্ত্র অবশ্যই এক ধরনের ব্যবস্থা। বৈশিষ্ট্যপূর্ণ এক সমাজব্যবস্থা। এক ধরনের সিস্টেম। সবার আশা-আকাঙ্ক্ষা ধারণ করে গণতন্ত্র। গণতন্ত্র সবার জীবনকে স্পর্শ করে। সবার জন্য রচনা করে এক বলিষ্ঠ জীবনবোধ। সমস্বার্থের মোহনায় সবাইকে করে সম্মিলিত। সমস্বার্থের সুষম বন্ধনে সবাইকে করে সংগ্রথিত। সাম্য, মৈত্রী ও সৌভ্রাতৃত্বের উপত্যকায় সবাইকে করে সংগঠিত। এই ব্যবস্থায় সংখ্যাগুরু যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি গুরুত্বপূর্ণ সংখ্যালঘুও। অন্যদিক থেকে গণতন্ত্র এক প্রক্রিয়াও বটে। এই প্রক্রিয়ায় ব্যক্তি স্বীকৃত হয় স্বতন্ত্র, অনন্য, এককরূপে। কারও ওপর নির্ভরশীল সে নয়। নয় কারও মুখাপেক্ষী। আপন মহিমায় সবাই ভাস্বর। তার সম্মতি ছাড়া তাকে শাসন করার কারও অধিকার নেই। তার সম্মতি ছাড়া তার ওপর কর ধার্য করার ক্ষমতা নেই কারও। তা ছাড়া যে কোনো নীতিনির্ধারণে এই প্রক্রিয়ায় সর্বাধিক সংখ্যক ব্যক্তির ইচ্ছা হয় প্রতিফলিত। সবার সম্মতি নিয়েই সমাজব্যবস্থা হয় পরিচালিত। সংখ্যাগুরু আর সংখ্যালঘু তাই একত্রে কাজ করে।
আর এদিক থেকে বলা যায়, গণতন্ত্র এক ধরনের নৈতিকতা। পরিশীলিত এক কর্মপ্রবাহ। রুচিকর এক যৌথ উদ্যোগ। পরিচ্ছন্ন ও সচেতন এক পদক্ষেপ। গোপনীয়তার জমাট বাঁধা অন্ধকার ছাপিয়ে গণতান্ত্রিক কার্যক্রমের সূচনা হয় সর্বসাধারণের সমক্ষে, মুক্ত আলোয়। ষড়যন্ত্রের অন্ধকার গুহা থেকে বেরিয়ে আসে সামগ্রিক কর্মকাণ্ড। বেরিয়ে আসে প্রকাশ্য দিবালোকে। সবাইকে সঙ্গে নিয়ে চলতে হয় বলে সম-মানসিকতা প্রতিফলিত হয় রাজনৈতিক কার্যক্রমে। অন্যের দিকে তাকিয়ে সবাই নির্ধারণ করে নিজেদের পদক্ষেপ। নিয়ন্ত্রণ করে নিজেদের আচার-আচরণ। আমার জন্য যা পীড়াদায়ক অন্যের কাছে তা সুখকর হতে পারে না। আমি যা খুশি করব, তা তো হতে পারে না। এই সত্যের ভিত্তিতে তৈরি হয়েছে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি। এই সংস্কৃতির চর্চা ছাড়া গণতন্ত্রের চর্চা সম্ভব নয়।
গণতন্ত্রের কৌশল রুচিসম্মত। তার চর্চা হয় অবাধ ও মুক্ত পরিবেশে। নীরবে নয়, তারস্বরে। নির্জনে নয়, জনারণ্যে। সুতরাং একটি রাজনৈতিক ব্যবস্থা হিসেবে গণতন্ত্র হলো উন্নত জীবনের প্রতিশ্রুতি। সুরুচির প্রতীক। স্বাচ্ছন্দ্য ও স্বাতন্ত্র্যের প্রতিচ্ছবি। সাম্য, মৈত্রী ও সৌভ্রাতৃত্বের নিশ্চিত নীড়। প্রক্রিয়া হিসেবে গণতন্ত্র হলো সহযোগিতার সূত্র। আস্থা ও বিশ্বাসের অন্তরঙ্গ সুর। সমঝোতার ক্ষেত্র। মুক্তবুদ্ধির বিস্তীর্ণ অঙ্গন। এদিক থেকে গণতন্ত্র যেমন উপায়, তেমনি উপেয়। সমাজ জীবনের যেমন লক্ষ্য, তেমনি মাধ্যমও। গন্তব্য ও পথ দুই-ই।
সফল গণতন্ত্রের ক’টি অঙ্গীকার রয়েছে। এক. গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সরকার যে ক্ষমতা প্রয়োগ করে তা জনগণের ক্ষমতা। সরকার আমানত হিসেবে সেই ক্ষমতা ধারণ করে প্রয়োগ করে রাজনৈতিক সমাজের অনুমোদিত পন্থায়, ঐকমত্যের ভিত্তিতে। সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য অর্জনে ব্যর্থ হলে অথবা সমাজ কর্তৃক অনুমোদিত পন্থা অনুসরণে ব্যর্থ হলে সরকার ক্ষমতাচ্যুত হয়। গণতান্ত্রিক এই সত্য স্বীকৃত হতে হবে। দুই. গণতন্ত্রে ব্যক্তি প্রাধান্যের পরিবর্তে প্রতিষ্ঠিত হয় আইনের প্রাধান্য। প্রতিষ্ঠিত হয় আইনের রাজত্ব। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় আইন সর্বজনীন। আইনের প্রতি আনুগত্য, কোনো ব্যক্তির প্রতি নয়, তা তিনি যতই প্রভাবশালী হোন না কেন অথবা যত উঁচু পদে অধিষ্ঠিত থাকুন না কেন।
গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার আর একটি অঙ্গীকার হলো আইন মেনে চলতে হবে, যদিও তা খারাপ আইন হয়ে থাকে। আইন প্রণয়ন করেন জনপ্রতিনিধিরা। আইন পরিবর্তনও করেন তারা। গণতন্ত্রে সবাই আইন মেনে চলে। মন্দ আইন হলে তা পরিবর্তিত হয় কিন্তু যত দিন তা পরিবর্তিত না হচ্ছে ততদিন তা মানতেই হবে। তিন. গণতন্ত্রের পরিবেশ সম্পূর্ণ ভিন্ন। এখানে জোরের যুক্তির পরিবর্তে যুক্তির জোর কার্যকর হয়। সামাজিক বন্ধন সুদৃঢ় হয় সমঝোতা ও বিশ্বাসের ভিত্তিতে। সুষ্ঠু গণতন্ত্রের জন্য যেমন প্রয়োজন গণতান্ত্রিক কাঠামো, তেমনি প্রয়োজন গণতান্ত্রিক মন। প্রয়োজন কাঠামোর সর্বস্তরে স্পন্দিত অন্তঃকরণ। কাঠামোকে সিক্ত করার জন্য গণতান্ত্রিক চেতনার ঘন আস্তরণ।
গণতান্ত্রিক সমাজ গঠনে দুই-ই অপরিহার্য। কাঠামো সৃষ্টি করে নৈতিক এক পরিমণ্ডল। রচনা করে গণতান্ত্রিক সমাজের প্রাথমিক পর্যায়। কিন্তু গণতান্ত্রিক কাঠামোয় গণতান্ত্রিক মনের প্রসার ঘটানো, কাঠামোকে প্রাণোচ্ছল করাই চূড়ান্ত পর্ব।
উল্লিখিত বিষয়গুলো গণতন্ত্রের অন্যতম শর্ত। আমরা গণতন্ত্র গণতন্ত্র যত কথাই শুনছি না কেন কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে এসব শর্তের কোনো উপস্থিতি কি বিদ্যমান ব্যবস্থার মধ্যে লক্ষ্য করা যায়? যায় না। আর তাই গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ বলার প্রশ্নই ওঠে না।
এসডনলিউ/এসএস/১৪০৫
আপনার মতামত জানানঃ