মাছে ভাতে বাঙালি; একটি বহুল প্রচলিত প্রবাদ। মাছ ছাড়া যেন আমাদের এক বেলার আহারও হয় না। কিন্তু এই মাছ নিয়েই একটি দুঃসংবাদ পাওয়া গেছে। আর তা হল, বিশ্বের বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবনের তিনটি প্রধান নদী পশুর, রূপসা ও মোংলা নদীর অন্তত ১৭ প্রজাতির মাছ ও তিন প্রজাতির শেলফিশ সংক্রমিত হয়ে পড়েছে মাইক্রোপ্লাস্টিকে।
সম্প্রতি ‘সায়েন্স অব দ্য টোটাল এনভায়রনমেন্ট’ জার্নালে প্রকাশিত গবেষণা প্রতিবেদনে এমন তথ্য উঠে এসেছে।
গবেষণা থেকে বলা হয়-প্লাস্টিক বর্জ্য কর্ণফুলীকে পরিণত করেছে চরম মাত্রায় দূষিত নদীতে। এ নদীতে চট্টগ্রাম শহরের প্রায় ৪০ শতাংশ প্লাস্টিকের ঠাঁই হয়। এরপরই রয়েছে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমে রূপসা নদী, যেখানে ফেলা হয় প্রায় ৩১ দশমিক ৭ শতাংশ পর্যন্ত প্লাস্টিক বর্জ্য।
সুন্দরবনের তিন নদীর পানিতে মাইক্রোপ্লাস্টিকের বিষয়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় (জাবি), বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালস (বিইউপি), বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশনের ফুড সেফটি অ্যান্ড কোয়ালিটি ডিভিশন, বাংলাদেশ কাউন্সিল অব সায়েন্টিফিক অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল রিসার্চের (বিসিএসআইআর) ইনস্টিটিউট অব ন্যাশনাল অ্যানালিটিক্যাল রিসার্চ অ্যান্ড সার্ভিসেস এবং ব্রাজিলের তিনটি বিশ্ববিদ্যালয় যৌথভাবে গবেষণাটি করেছে।
এতে বলা হয়, ইউরোপিয়ান ফুড সেফটি অথরিটি গাইডলাইন অনুযায়ী সুন্দরবনের পশুর, রূপসা ও মোংলা নদী থেকে ২০ প্রজাতির ১৪১টি নমুনা সংগ্রহ করা হয়। ওই ২০ প্রজাতির মাছের গ্যাস্ট্রোইনটেস্টাইনাল ট্র্যাক্টে মাইক্রোপ্লাস্টিকের উপস্থিতি সবচেয়ে বেশি পাওয়া গেছে, যার পরিমাণ প্রতি গ্রামে ৭ দশমিক ৩৩ থেকে ২০৫ দশমিক ৬১ কণা।
পেশিতে এর পরিমাণ প্রতি গ্রামে ৫ দশমিক ৩৭ থেকে ৫৪ দশমিক ৩০ কণা। যেসব প্রজাতির মাছে মাইক্রোপ্লাস্টিক পাওয়া গেছে এর মধ্যে রয়েছে- বোম্বে ডাক (লইট্টা), বেঙ্গল ইয়েলোফিন সি ব্রিম (দাতিনা), স্পেকলড শ্রিম্প (হরিণা চিংড়ি), ইলিশ (তেনুয়ালোসা ইলিশা), টলি শাদ, গোল্ডলাইনড সিব্রেম (পোয়া), ইন্ডিয়ান অয়েলড সার্ডিন (ফাইসা), ফিরগেট টুনা (সুরমা), বেররামুন্ডি (ভেটকি), লার্জ হেড রিবন ফিশ (ছুরি), পেইন্টেড টেইলড গোবি (চেমো), লং হুইস্কার (টেংরা), লং হুইস্কার ক্যাটফিশ (আইর), স্পটেড স্ক্যাট (চিত্রা), লেন স্যাপার, স্পটেড আর্চারফিশ (চোরোই) ও গোল্ড স্পটেড গ্রেনাডিয়ারস অ্যানচোভি।
হরিণা চিংড়ির পেশিতে সর্বাধিক পরিমাণে প্লাস্টিকের কণা ছিল, প্রতি গ্রামে এর পরিমাণ ৫৪ দশমিক ৩০। দাতিনা সর্বনিম্ন প্রতি গ্রামে ৫ দশমিক ৩৭ কণা বহন করেছিল। গ্যাস্ট্রোইনটেস্টাইনাল ট্র্যাক্টে সর্বাধিক মাইক্রোপ্লাস্টিকের বাহক হলো চেমো। সেখানে প্রতি গ্রামে কণার পরিমাণ ২০৫ এবং সর্বনিম্ন সুরমা মাছে আছে প্রতি গ্রামে ৭ দশমিক ৩৩।
গবেষণায় আরও বলা হয়েছে, এক প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তি প্রতি সপ্তাহে ৩০০ গ্রাম মাছের পেশি গ্রহণ করে থাকলে বছরে তিনি ৭৪ হাজার ২৮২টি মাইক্রোপ্লাস্টিক কণা গ্রহণ করছেন। আর শিশুরা সপ্তাহে ৫০ গ্রাম মাছের পেশি গ্রহণ করে থাকলেও বছরে ১২ হাজার ৩৮০টি কণা গ্রহণ করছে।
টক্সিন কার্সিনোজেন তৈরি করে এমন ১০টি পণ্যের মধ্যে রয়েছে পলিথিন ও প্লাস্টিক আইটেম। মানুষ যদি তা সেবন করে তাহলে খুব বেশি ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকে।
এ ধরনের মাছ খাওয়ার মাধ্যমে মানুষের পেটে মাইক্রোপ্লাস্টিক যায়। যদি এটি পেটে জমতে থাকে, তবে পাঁচনতন্ত্র ধীরে ধীরে কাজ করা বন্ধ করে দেবে। যদি এটি রক্ত সঞ্চালন ব্যবস্থায় প্রবেশ করে, তবে লিভার ও কিডনি ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
গত ২০২১ সালে বাংলাদেশের এক গবেষণায় দেখা এক্সায় ৭৩ শতাংশ মাছে রয়েছে মাইক্রোপ্লাস্টিক বা প্লাস্টিকের ক্ষুদ্র কণা।
দেশি মাছের ওপর এই গবেষণাটি চালায় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগ। বাজারে পাওয়া যায় এমন দেশি মাছের ওপর গবেষণা করে জানা যায় যে ১৫ প্রজাতির মাছে প্লাস্টিকের এই ক্ষুদ্র কণার উপস্থিতি রয়েছে।
যেসব প্লাস্টিক পলিমার পাওয়া গেছে তার মধ্যে রয়েছে হাই ডেনসিটি পলিথিলিন, পলিপ্রোপাইলিন-পলিথিলিন কপোলাইমার এবং ইথিলিন ভিনাইল এসিটেট।
এই গবেষণা রিপোর্টটি সম্প্রতি পরিবেশ বিষয়ক আন্তর্জাতিক জর্নাল সায়েন্স অব দ্য টোটাল এনভায়রনমেন্টে প্রকাশিত হয়।
যেসব মাছের পেটে মাইক্রোপ্লাস্টিক পাওয়া গেছে তার মধ্যে রয়েছে রুই, তেলাপিয়া, কই, কালিবাউশ, বেলে, টেংরা, কমন কার্প, পাবদা, পুঁটি, শিং, টাটকিনি, বাইন, বাটা, মেনি ও বাছা।
তার মধ্যে টেংরা, টাটকিনি ও মেনি মাছে বেশি পরিমাণে মাইক্রোপ্লাস্টিক পাওয়া গেছে।
ঢাকার কাছে সাভার ও আশুলিয়ার দুটো স্থানীয় বাজার থেকে এসব মাছ কেনা হয়েছে যা দেশের নদী নালা, খাল বিল, পুকুর ও জলাশয়ের স্বাদু পানিতে পাওয়া যায়।
এরপর সম্প্রতি বিশ্বের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো মায়েদের বুকের দুধে সন্ধান মিলেছিল মাইক্রোপ্লাস্টিকের। আর এর ফলে মারাত্মক ঝুঁকির মুখে পড়তে পারে নবজাতক শিশুর স্বাস্থ্য; এমন শঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা।
সদ্য সন্তান জন্ম দেয়া ৩৪ জন সুস্থ মায়ের কাছ থেকে দুধের নমুনা সংগ্রহ করেন গবেষকরা। তা নিয়ে গবেষণায় তারা মাইক্রোপ্লাস্টিকের সন্ধান পান। এই গবেষণা করেছেন ইতালিয়ান একটি গবেষক দল।
গবেষণাটি পলিমার সাময়িকীতে প্রকাশিত হয়। গবেষকরা দেখতে পেয়েছেন ওইসব মায়ের চারভাগের তিন ভাগের বুকের দুধেই মাইক্রোপ্লাস্টিকের অস্তিত্ব আছে। মায়ের গর্ভে থাকা অবস্থায় নবজাতকের শরীরে, মানুষের মস্তিষ্কে আর সর্বশেষ মায়েদের বুকের দুধে সন্ধান মিললো এই প্লাস্টিকের।
এসডব্লিউএসএস/১৬৫৫
আপনার মতামত জানানঃ